
অভিশাপ থেকে মুক্তির প্রত্যয়
# জেলা প্রশাসকের আশ্বাসে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন শহরবাসী
# সবাই সচেতন হলে দ্রুত একটি ভালো ফল পেতে পারি : জেলা প্রশাসক
যানজট নারায়ণগঞ্জ শহরবাসীর জন্য এখন আর সাধারণ কোন সমস্যা নয়। দীর্ঘ দিনের ভোগান্তিতে যানজটের এই সমস্যা এখন নারায়ণগঞ্জবাসীর অভিশাপে রূপ নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-৫ ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পদের জন্য যারাই নির্বাচন করেন, প্রতিবারই নির্বাচনের পূর্বে তারা যে ওয়াদা করেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো যানজট নিরসন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়রও নির্বাচনের পূর্বে নারায়ণগঞ্জ শহরকে আধুনিক, বাসযোগ্য এবং নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন। তবে এসব জনপ্রতিনিধিরা একবার নির্বাচিত হলে পরে যাটজট নিরসনে আর কোন ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না।
বরং একে অপরের দোষ ও সমালোচনা করতে করতেই সময় পার করে দেন। নারায়ণগঞ্জে যারা বিভিন্ন দপ্তরের অভিভাবক হিসেবে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে আসেন তারাও নতুন অবস্থায় নারায়ণগঞ্জবাসীকে স্বপ্ন দেখান, কিন্তু যেকোন কারণেই হোক না কেন, একটা সময় তারাও বিষয়টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ এর জেলা প্রশাসক পদে মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞার যোগদানের পর নতুন করে একটি যানজট মুক্ত শহরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নারায়ণঞ্জবাসী।
যানজট নারায়ণগঞ্জ শহরবাসীর দীর্ঘ দিনের সমস্যা। তাদের মতে এখানে বড় বড় কথা বলে, উন্নয়নের বিভিন্ন স্বপ্ন দেখিয়ে যারাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন, পদ পাওয়ার পর তারা তাদের সেসব ওয়াদার কথা বেমালুম ভুলে যান। এখানে যারাই প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে আসেন, তারাও অনেক স্বপ্ন দেখান, যানজট নিরসনের ঘোষণা দেন। কিন্তু দুই-চার-ছয় মাস পর তারাও তাদের সেসব অঙ্গীকারের কথা ভুলে যান।
এরমধ্যে এক শ্রেণির তথাকথিত সূধীজন আছেন, যারা শহরের যানজট নিরসনে, শহরের উন্নয়নে নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু যানজট নিরসনে কার্যকর কোন পন্থা বের করে তা বাস্তবায়নের দাবি করলে তাদের আঁতে ঘা লাগে। ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার নামে বিভিন্ন ফতোয়বাজদের মতো যুক্তি তর্ক উপাস্থাপনের মাধ্যমে সেসব পন্থা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে নিজেদের আধিপত্য জাহিরের অপচেষ্টায় লিপ্ত হন বলেও অভিযোগ আছে। তাই অনেক সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কোন সদিচ্ছা থাকলেও সেসব ফতোয়াবাজদের কারণে তা আর বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে যায়, সম্ভব হয় না।
শহরের নয়ামাটি এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনারা যতই লেখালেখি করেন না কেন, এই শহরের যানজটের চেহারা কখনও পরিবর্তন হবে না। আমি ঢাকায় যাত্রার উদ্দেশ্যে ১নং রেলগেট এলাকার বন্ধন কাউন্টার থেকে বাসে চড়ার এক ঘন্টারও বেশি সময় পর চাষাঢ়ার কাউন্টারে পৌছি। যেখানে এই সময়ের মধ্যে আমার ঢাকায় গিয়ে পৌছার কথা। তিনি আরও বলেন, আপনারাতো মিডিয়ার লোক, বলেনতো, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় সময় থেকে কতক্ষণ আগে রওয়ানা দিবো, তা নির্দিষ্ট করে বলে দিতে পারেন কি না! তিনি বলেন, যানবাহনতো দূরের কথা এই সড়ক দিয়ে হেটে চলাচল করাও কষ্টকর এবং ঝুকিপূর্ণ।
নিতাইগঞ্জ এলাকার শেখর হালদার বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন এবং বাস টার্মিনাল এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা না করবেন, ততক্ষণ এই যানজট নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে না। তিনি প্রশ্ন করে জানতে চান, যেখানে রেলস্টেশন ও বাস টার্মিনালের অবস্থান, তার আশেপাশে কোন আবাসিক এলাকা আছে কি? তিনি বলেন, টানবাজার, নিতাইগঞ্জ, পাইকপাড়া, দেওভোগ এবং আমলাপাড়ার একটি অংশের মানুষ যারা এই স্থান দুটো ব্যবহার করেন, তারা কিন্তু হেটে আসেন না।
তাদেরও রিকশাযোগে আসতে হয়। তাই এখানে আসতে যে খরচ হয়; প্রায় সেই খরচেই তারা চাষাঢ়াও যেতে পারেন। মাঝখান দিয়ে যানজটের কারণে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হয়। তারমতে, একটি মহল নারায়ণগঞ্জবাসীর যানবাহন খরচ বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে এগুলো সরিয়ে নিতে বাধা দিচ্ছেন। অথচ শহরের লক্ষ লক্ষ বাসিন্দা যুগের পর যুগ ধরে যে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে; তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তিনি বলেন, ডাবল রেল লাইন বাস্তবায়ন হলে এবং তা যদি সত্যিই বর্তমান রেলস্টেশন পর্যন্ত থাকে তাহলে নারায়ণগঞ্জবাসীর ভোগান্তি আরও বাড়বে, একই সাথে যানজট নিরসন প্রশাসনের জন্য আরও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
যানজট নিরসনের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ এর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, আমরা সব সময় আশা নিয়েই কাজ করি। জনগণের ভোগান্তি দূর করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং অমার সব সময় সেই ভোগান্তি দূর করার চেষ্টা করি। গতকাল (মঙ্গলবার) থেকে চেম্বার অব কমার্স, বিকেএমইএ যানজট নিরসনে কাজ করার জন্য আমাদের কিছু জনবল দিয়েছে। আমরা সেভাবে একটি ওয়ার্ক প্ল্যান করেছি, আশা করি কিছুটা হলেও যানজট লাগব হবে।
যানজট নিরসনের অন্তরায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরটা খুব ছোট হলেও এর জনসংখ্যা অনেক, কিন্তু সে তুলনায় প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাটের অভাব আছে। যেসব রাস্তা আছে, তা-ও পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি। এ ধরণের একটি বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে রাস্তগুলো যে মানের হওয়া উচিৎ সে ধরণের হয়নি। এছাড়াও যেখানে সেখানে যেভাবে মার্কেট এরিয়া করে ফেলা হয়েছে, সরকারি জায়গা অল্প অল্প করে যেভাবে দখল করে নিয়েছে, তাতে রাস্তাগুলো আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি রাস্তাগুলো দিয়ে শহরের ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি যানবাহন চলাচল করে।
যানবাহনগুলো রাস্তায় চলাচলের যেসব নিয়মকানুন আছে তা না মেনে চলাচল করে। যেখানে সেখানে, পার্কিং, গাড়ি স্ট্যান্ড করে। আমাদের এখানে অনেক যাত্রী আছে যারা নির্দিষ্ট স্থানে না নেমে যেখানে খুশি রাস্তার মাঝখানে তাদের পছন্দ মতো জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সেখানে নামতে চায়। এরফলেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। এখানে বেশকিছু হকার আছে যারা ভ্যানগাড়ি ও চৌকি দিয়ে রাস্তার বেশ একটা অংশ দখল করে নিয়েছে।
আমাদের এখানকার মানুষকেও দেখি তারা সেখান থেকেই ভিড় করে কেনাকাটা করে। ফলে হকাররাও সেখানে বসতে উৎসাহিত হয়। আমরা মীর জুমলা রোড উদ্ধার করার পরও বেশ কতবার মোবাইল কোর্ট করেছি। তারপরও তা বেদখল হয়ে যায়। তাই আমাদের নাগরিক হিসেবেও সচেতন হওয়ার দরকার আছে। না হলে আমাদের পক্ষেও যানজট নিরসনের কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। আমার সবাই সচেতন হলে দ্রুত একটি ভালো ফল পেতে পারি।