জেলাজুড়ে তীব্র সমালোচনা, কড়া প্রতিবাদ আর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে
৫০ টাকা ভাড়ায় ফিরলো উৎসব-বন্ধন

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
-copy-68a96062386a1.jpg)
৫০ টাকা ভাড়ায় ফিরলো উৎসব-বন্ধন
জ্বালানি তেলের দাম কমায় এবং দেশের কোথাও বাস ভাড়া না বাড়লেও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস ভাড়া ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু জেলাজুড়ে সাধারণ জনগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, সামাজিক সংগঠন, সাংবাদিক ও সর্বস্তরের মানুষের তীব্র সমালোচনা- কড়া প্রতিবাদ আর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে অবশেষে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে পূর্বের ন্যায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে উৎসব ও বন্ধনের ভাড়া ৫০ টাকাই থাকছে। শুক্রবার (২২ আগস্ট) সকালে জেলা প্রশাসকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও নারায়ণগঞ্জ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা জানান,‘অনিবার্য কারণবশত গত ২০ আগস্ট বন্ধন ও উৎসব পরিবহনের বর্ধিত ভাড়ার বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হলো। সেহেতু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বন্ধন ও উৎসব পরিবহনের ভাড়া পূর্বের ন্যায় বহাল থাকবে।’
এরআগে বুধবার (২০ আগস্ট) বিকেলে জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ বাস ভাড়া বাড়ানো নিয়ে পরিবহন মালিক, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস ভাড়া ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২০ আগস্টের ওই সভায় সভায় আলোচনায় উঠে আসে, নারায়ণগঞ্জ পরিবহন খাত থেকে ২০২৪ সনের ৫ আগষ্টের আগে কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে বেড়াতো ওসমান পরিবার। তাঁর ভাগ আওয়ামী লীড়ের সড়ক ও সেতু পরিবহন মন্ত্রলায়ের পলাতক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত পৌঁছাতো এমন গুঞ্জন রয়েছে। ২০০৮ সনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ওসমান পরিবার নারায়ণগঞ্জের সকল পরিবহন নিয়ন্ত্রণে নেন। তাদের কথা যারা শুনেন নাই, তাদের পরিবহন বন্ধ করে দিতেও তারা কর্ণপাত করেন নাই বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের আগষ্টের পরে পরিবহন মালিকরাও অকপটে শিকার করেন তৎকালিন ডিসি মাহমুদুল হাসানের কাছে। সেই সাথে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের পরিবহন খাত থেকে কারা চাঁদা নিচ্ছে তাদের যেন নাম প্রকাশ করা হয়। যদিও পরিবহন সেক্টরের মালিকরা তা প্রকাশ করেন নাই। তাছাড়া সভায় বাস ভাড়া বাড়ানো নিয়ে পরিবহন মালিকরা হৈ চৈ শুরু করেন। এমনকি তারা কথার প্রেক্ষিতে হরতাল ধর্মঘট দেয়ার হুমকি প্রদান করেন। তাছাড়া ওসমান পরিবারের জায়গাটা পরিবহন সেক্টরে কারা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তা নিয়ে আলোাচনা তৈরী হয়েছে।
এই সভায় নারায়ণগঞ্জে ২০২৪ সনের ৫ আগষ্টে আগে ওসমান পরিবার পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি করেছে এক বৈঠকে পরিবহন মালিকারা জাননা বলে মন্তব্য করেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি বলেন, আগের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হাসান যখন পরিবহন ভাড়া নিয়ে সকলের সাথে আলোচনায় বসেন তখন পরবিহন মালিকদের প্রতিনিধি রওশন আলী ওই সভায় বলেছেন তারা পরিবহন থেকে বড় একটি হিস্যা বা চাঁদার টাকা ওসমান পরিবারকে দিত। গত বছরের ৫ আগষ্টের পরে যেহেতু কাউকে চাঁদা দিতে হয় না তাহলে পরিবহনের ভাড়া কমাতে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। পরিবহন মালিকদের কয়েকজনও গতকালকের এই সভায় বলেন এটা ৫ আগষ্টের আগে ছিল, এখন নেই।
মহানগর বিএনপির আহবায়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, গত বছরের ৫ আগষ্টের সরকার পরিবর্তনের আগে কোন মিটিংয়ে আমাদের ডাকা হয় নাই। আজকের মিটিংয়ে রওশন আলী সকল বিষয়ে বার বার ভেটু দিতাছেন। অথচ আগের ডিসির সাথে যখন তার কক্ষে বসা হয় তখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডে পরিববহনের ভাড়া ৪৫ টাকা আর ৫৫ টাকা নিয়ে বার্গেনিং হচ্ছিল। তখন ৫০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেন প্রাক্তন ডিসি। এই ৫০ টাকা ভাড়া করার পিছনে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ৫ আগষ্টের পর থেকে কোন রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদা দিতে হয় না। যেহেতু এখন চাদাঁ দিতে হয় না, সে হিসেবে যাত্রীদেরকে সেই ছাড়টা পরিবহন মালিকদের দিতে হবে। আর যদি এখন নতুন করে কাউকে চাঁদা দিতে হয় তাহলে পরিবহন মালিকরা তাদের নাম প্রকাশ করুক এই সভায়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে অনেক পরিবহন মালিকরা এসে বলে তারা গাড়ি নামালে মালিক সমিতিতে নাম না লেখালে তা সড়কে চলতে দেয়া হয় না। কোন মালিক গাড়ি নামাতে চাইলে তাদেরকে জিম্মি করে রাখে পরিবহন মালিক সমিতি। জনগণের যাতে ভোগান্তি হয় তারা সেটা চান। আমরা এটাও জানি যারা পরিবহনের বাসের মালিক রয়েছে, তারা কি টাকা পায়, আর সমিতিতে আপনারা কত টাকা রেখে দেন? মালিকরা প্রকৃত টাকা পায় না , এরকম বহু বিচার আমাদের কাছে আসে। আমরাও ৪ হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া নিছি, সেখানে বাসের মালিক পাইছে ১৫শ’ টাকা, আর বাকি টাকা সমিতির নামে মধ্যসত্ত্বভোগিরা নিয়ে যায়। ওই দিক দিয়া মালিকদের আটকে রেখে এদিক দিয়ে জনগণের উপর বেশি ভাড়া চাপিয়ে দিবেন, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। আমরা রাজনীতিবিদরা জনগণের কল্যাণে কথা বলবো, সেটাই স্বাভাবিক।
সভায় যাত্রী অধিকার ফোরামের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি বলেন, ৫ আগষ্টের পরে ভাড়া কমানোর দাবী করার কারণ হলো ২০১১ সনে যখন ২২ টাকা থেকে ৩১ টাকা ভাড়া বাড়ানো হলো তখন আমরা আপত্তি জানাই। সেই র্যাব-১১ থেকে দেয়া একটি চিঠি সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করি। সেই চিঠিতে উল্লে ছিল এই পরিবহন সেক্টর থেকে পরিবহন মালিক সমিতি প্রতি মাসে শামীম ওসমানকে এবং সেলিম ওসমান কত টাকা দিত তা উল্লেখ ছিল। তাই আমরা বলে আসছি এই চাঁদাটা যদি কমানো যায় তাহলে বাস ভাড়াও কমানো যাবে। এখননো আর নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার নেই সুতরাং কাউকে চাঁদা দিতে হচ্ছে না তাহলে ভাড়া কমাতে সমস্যা কি। আর এজন্য ভাড়াটা কমানো হয়েছে।
জেলা সিপিবির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, গণপরিবহনের ভাড়া সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করা আছে। বিআরটিসি বাস যদি ৪০ টাকা ভাড়ায় ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রোডে চলাচল করতে পারে তারা কেন পারবে না। আমি সরকারের দাবী জানাবো বিআরটিসি বাস যেন ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রোডে বাড়িয়ে দেয়া হয়। তার এই দাবীর প্রেক্ষিতে পরিবহন মালিকসহ তাদের প্রতিনিধি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। রাষ্ট্রের নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করা হোক আমরা তা চাই। এসময় তার কথায় মহানগর শ্রমিক দলের সদস্য সচিব ফারুক ক্ষিপ্ত হয়ে যান।
জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘সড়কে পরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে এসপার রুলস আইনে যা আছে আমরা তা ফলো করবো। বিআরটিসি বাসের ডিমান্ড থাকলে আমরা অবশ্য কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবো। সকলের মতামতের ভিত্তিতে আমরা কারো পক্ষে বিপক্ষে যেতে চাই না। জামায়াতের নেতা যেমনটা বললেন পরিবহন মালিকরা চাইবেন ভাড়া বাড়াইতে আমরা জনগণ চাই কমাতে। এটাকে ব্যালন্স করার জন্য সরকারের প্রশাসনসহ আমরা আলোচনায় বসি। এখানকার পরিবহন মালিক, শ্রমিক জনগণ বাস দিয়ে চলাচল করবে। পরিবহন মালিকদের চাওয়া বাস ভাড়া ৬১ টাকা, বিআরটিসির কর্মকর্তারা বরছেন ৫২ সিট অনুযায়ী দুরত্বের ভিত্তিতে ৫৭ টাকা ভাড়া কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আমরা এটাকে ৫৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণকরতে পারি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া ঠিক থাকবে তা পুরো সপ্তাহ জুড়ে। এসময় ডিসিকে রফিউর রাব্বি বলেন এটা নির্ধারণ করা ঠিক হবে না।’ আপাতত যা ভাড়া আছে তা বলবৎ থাকুক। তার এই কথার পরে পরিববহন মালিকরা হৈ চৈ শুরু করেন। সেই সাথে তারা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জে বাসভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে নারায়ণগঞ্জ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। তারা আধাবেলা হরতালেরও ঘোষণা দেন। পরে হরতালের একদিন আগে ১৬ নভেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান বাস-মালিক ও যাত্রী অধিকার ফোরামের সঙ্গে বৈঠক করে বাসভাড়া কমিয়ে ৫০ টাকা নির্ধারণ করেন। এই সিদ্ধান্তের নয় মাসের মাথায় বাসভাড়া পুনরায় বাড়ানো হয়। যদিও নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা পথে সরকারি পরিবহন বিআরটিসির যেসব বাস চলে সেগুলোর ভাড়া ৪৫ টাকা। এদিকে, গত বুধবার বাসভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রাজনৈতিক, নাগরিক, ছাত্র ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা। বৃহস্পতিবার ছাত্র-জনতার ব্যানারে বাসভাড়া প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার ও শনিবার কর্মসূচি ঘোষণা করে গণসংহতি আন্দোলন ও যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম।