
নাসিকের ৭৭৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা
# প্রাধান্য পেয়েছে যানজট নিরসন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তা, ড্রেন নির্মান ও পুনঃনির্মাণসহ নাগরিক সুবিধাদি ও সেবার মান
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) এর মেয়রকে অপসারণের পর এই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ বাজেট ঘোষণা করেছেন নাসিক প্রশাসক এ এইচ এম কামরুজ্জামান। নতুন কোন করারোপ ছাড়াই গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সেমিনার রুমে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের রাজস্ব ও উন্নয়নসহ মোট ৭৭৫ কোটি ৩৩ লক্ষ ৭৮ হাজার ১৫৮ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন প্রশাসক।
যার বিপরীতে মোট ৬৭৮ কোটি ১৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ১৩৮ টাকা ব্যয় ধরা হয় বলে জানায় নাসিক। বছর শেষে ঘোষিত বাজেটে ৯৬ কোটি ৪০ লক্ষ ২১ হাজার ০১৯ টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। এটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠনের পর ১৪তম বাজেট। এর আগে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারে পতনের পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) এর দায়িত্ব থেকে মেয়রকে অপসারণ করার প্রশাসক হিসেবে নাসিকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন কামরুজ্জামান। এরপর তিনি গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য ৫৪৪ কোটি ২৯ লাখ ৩ হাজার ৭৯৬ টাকার সংশোধিত বাজেট ঘোষণা করেন।
এবারের বাজেটে ব্যয়সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে নাসিক প্রশাসক এএইচএম কামরুজ্জামান বলেন, এই বাজেটে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার, ক্রীড়া উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা নিরসন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, যানজট নিরসন, সড়ক বাতির উন্নয়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর নাগরিক সুবিধাদি ও সেবার মান উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন, সচিব নূর কুতুবুল আলম, নির্বাহী প্রকৌশলী আজগর হোসেন, সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলগণ, সংবাদ কর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ।
বাজেটে আয় ব্যয়ের খাত: চলতি বাজেটে আয়ের খাতে সবমিলিয়ে মোট আয় ধরা হয়েছে ৬২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যার মধ্যে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২১৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। পানি সরবরাহ আয় ২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা, সরকার প্রদত্ত উন্নয়ন সহায়তা থেকে ৩৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প ১৭০ কোটি টাকা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকল্প সহায়তা (ডিপিপি) বাবদ ১২০ কোটি টাকা, রাজস্ব খাত থেকে আগত উন্নয়ন আয় ৫৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ব্যয়ের খাতে সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যেখানে রাজস্ব সাধারণ ব্যয় ১৯৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা,
পানি সরবরাহ বাবদ ব্যয় ২৭ কোটি টাকা, রাজস্ব উন্নয়ন ব্যয় ৮২ কোটি টাকা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ৫৬ কোটি ৭৫ হাজার টাকা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (ডিপিপি) বাবদ ১৪৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প সহায়তা ১৭০ কোটি টাকা। নাসিক এর নিজস্ব অর্থায়নে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও গণপরিসর উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮২ কোটি টাকা।
বাজেটে বলা হয় নাসিকের বিদ্যমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতিকরণে ২০ কিলোমটিার পানির সঞ্চালন পাইপলাইন এবং ৩০০ কিলোমিটার বিতরণ পানির পাইপ লাইন স্থাপন, কিছু ডিএমএ স্থাপন, ৩৫ হাজার সংখ্যক হোল্ডিং-এ পানি সরবরাহ লাইন ও স্মার্ট মিটার সংযোগকরণ, ৩৫ কিমি ড্রেন নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ, ৫ হেক্টর ভূমিতে পার্ক, যুবসমাজের তারুণ্যের বিকাশসহ অর্থনৈতিক ও জীবনমান উন্নয়নে খেলার মাঠ,গণপরিসর ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হবে।
নগরবাসীর স্বাস্থ্য, পরিবেশগত উন্নয়ন, সামাজিক সংহতি, কমিউনিটি সংশ্লিষ্টতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং নাসিক আওতাধীন খাল, পুকুর ও গণপরিসর পুনরুদ্ধারসহ সংস্কারের মাধ্যমে সংরক্ষণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ আছে বলে জানান তিনি। এরই মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর কদমরসুল ব্রিজ নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলে জানান নাসিক কর্তৃপক্ষ।
নাসিক জানায়, স্বাস্থ্যসম্মত ও আধুনিক উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংগ্রহ ও অপসারণের জন্য জালকুড়িতে স্থায়ী ডাম্পিং গ্রাউন্ড এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কদমরসুল অঞ্চলে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক, নারায়ণগঞ্জ বরাবর ২৩৪ কোটি টাকা জমা প্রদান করা হয়েছে। পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য ঋষিপাড়া ও ইসদাইরে ৩৬৯টি ফ্ল্যাট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সকল ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনস্বরূপ ১৬নং ওয়ার্ড সংলগ্ন নাগবাড়িতে সাধু নাগ মহাশয় মন্দির নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের কাজ চলমান আছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নাসিকের আওতাধীন এলাকায় শহীদদের আত্মত্যাগের স্থানে তাদের নামখচিত ৩৪টি ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ স্থাপন এবং শহীদদের জন্য বিভিন্ন ওয়ার্ডে ৪টি কবর সংরক্ষণসহ উন্নয়ন কাজ চলমান আছে। সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের অনুদান প্রদান এবং নাসিকের তহবিল হতে সঞ্চয় ও ক্ষুদ্র ঋণ পরিচালনা করছে। এছাড়া, টিসিবি স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের নিকট সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে বলেও জানায় নাসিক।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৯৫ কোটি ৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৮৮ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৮৮ কোটি ২৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৬ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন নাসিকের তৎকালীন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের সব সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম কামরুজ্জামান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব নেন।