বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শাওন
যুবদল নেতা শাওন হত্যার বিচার চায় পরিবার

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
-copy-68b59db90141c.jpg)
যুবদল নেতা শাওন হত্যার বিচার চায় পরিবার
# নিহত শাওনের ঘটনাটি এখনো আমার মাঝে জাগরিত হয়: সাখাওয়াত
# শাওন হত্যায় জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে : যুবদল নেতা সাদেক
নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে যুবদল কর্মী শাওন আহম্মেদ নিহত হন। তখন এই ঘটনায় অজ্ঞাত নাম দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দেয়। যা নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে। আজ বিএনপির ৪৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে জেলা মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা র্যালী সহ নানা কর্মসূচি পালন করবে। কিন্তু শাওন হত্যায় ইতোমধ্যে ৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে এখন্ োবিচার নিয়ে ধোয়াশায় রয়েছে পরিবার।
তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরে জাতীয়তাবাদি দলের বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে দলটির নেতা-কর্মীদের সাথে সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে যুবদল নেতা শাওন আহম্মেদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তখন এ ঘটনায় ২০২২ সালের ২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেছিলেন নিহত শাওনের ভাই মিলন। এই ঘটনায় তখন পুলিশের দেয়া এজহার কপিতে স্বাক্ষর করে নিহত শাওনের ভাই মিলন প্রধান মামলা করেন। যার মামলা নং ৩/৯/২২। ওই মামলায় বিএনপির পাঁচ হাজার অজ্ঞাত নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। যদিও পরবর্তিতে মামলাটি খারিজ হওয়ায় কোন বিচার পায় নাই ভুক্তভোগি পরিবার।
এদিকে ২০২৪ সনের ৫ আ্গষ্টে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত বছরের ২১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত যুবদল কর্মী শাওনের ভাই মিলন মিয়া।ওই মামলায় আসামি করা হয় তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি মঞ্জুরুল হাফিজ, পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল,ও সাবেক এমপি শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু সহ ৫২ জনকে আসামী করা হয়।
নিহত শাওনের ভাই মিলন প্রথম মামলা হওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, ‘এই মামলার বিষয়ে তিনি বা তার পরিবারের কেউ কিছু জানেন না। তখন পুলিশ তাদের কাছে একটি সাদা কাগজে সই নিয়েছে। যা পরে মামলার কপি হিসেবে জানানো হয়।
পরবর্তিতে গত ২০২৪ সনের ২১ অক্টোবরে দায়ের করা মামলায় সদ্য সাবেক পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া, তৎকালীন জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকেও আসামি করা হয়েছে। এছাড়া মামলাটিতে সাবেক এসপি ছাড়াও ৩৭ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ ১০০-১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। তৎকালীন ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক মাহফুজুর রহমান কনকের হাতে থাকা 'চাইনিজ রাইফেল' থেকে ছোড়া গুলি যুবদল কর্মী শাওনের শরীরে বিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসক। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সংঘর্ষে বিএনপির প্রায় ৩০০ নেতাকর্মী আহত হয়েছিলেন বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ‘নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের পর পুলিশি পাহারায় দাফন করা হয়। জানাজা ও দাফনের সময় নিহতের পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। তৎকালীন পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় শাওনের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের ওপর তৎকালীন প্রশাসনের প্রচণ্ড চাপ ছিল এবং তারা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল।
মামলার বাদী মিলন বলেন, আমিসহ আমার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের জিম্মি করে সাদা কাগজে আমার স্বাক্ষর নিয়ে বিএনপির অজ্ঞাতনামা পাঁচ হাজার লোকের নামে মিথ্যা মামলা করতে বাধ্য করা হয়। পরে আদালতে এই মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দিলে তাতে আমার আপত্তি নেই মর্মে জোরপূর্বক জবানবন্দি দিতেও বাধ্য করা হয়। ঘটনার তিনদিন পর ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নারায়ণগঞ্জের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলার পিটিশন দাখিল করেন। যদিও পরবর্তীতে আবেদনটি খারিজ করে দেয় আদালত। আদালত মামলাটি খারিজ করে দেওয়ার পেছনেও তৎকালীন পুলিশ, প্রশাসন, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘নগ্ন হস্তক্ষেপ’ ছিল বলে মামলার এজাহারে অভিযোগ করেছেন মিলন।
অপরদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপির সহযোগি সংগঠন যুবদেলর সক্রিয় কর্মী ছিলেন যুবদল নেতা নিহত শাওন। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা সিভিল সার্জনের সাথে যোগসাজস করে ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালের ্ সাবেক আর এমও ডা. ফরহাদের মাধ্যমে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে নিহত শাওনের পোষ্টমর্ডেম রিপোর্ট পাল্টিয়ে দেন। নিহত শাওনের ডাক্তারির রিপোর্টে বলা হয় সে আঘাতে জখম হয়ে মারা যান। অথচ আমাদের প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানাযায়, ২০২২ সনের ১ সেপ্টম্বর নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ডিবি পুলিশের এসআই মাহফুজুর রহমান কনককে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলিতে মারা যান।
তখন এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এসআই কনকের নামে কোনো রাইফেল ইস্যু ছিলনা, আছে পিস্তল। তিনি অন্য কারও চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়েন যা নিয়মের ব্যত্যয়। ওই সংঘর্ষের সময় তার গুলিতে যুবদল নেতা শাওন নিহত হন বলে দাবী বিএনপির নেতৃবৃন্দের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শাওন হত্যা চুরান্ত রিপোর্টে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা উল্লেখ্য নেই। সেখানেও উল্লেখ্য করা হয়েছে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির নেতা কর্মীরা ইট-পাটকেল ছোড়েন, ককটেল বিস্ফোরণ করে ও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে থাকলে তখন ইট-পাটকেল ও অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে শাওন মাথায় ও বুকে গুরুতর জখম হয়ে মারা যান। পরে রাস্তায় থাকা লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক শাওনকে মৃত ঘোষণা করেন। অথচ তখন সকল মিডিয়াতে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবদল নেতা শাওন মারা যান।
আদালত সুত্রে জানা যায়, যুবদল নেতা নিহত শাওন হত্যার মামলার কোন বিচার পান নাই। এফ আর টি ৪০ নং অনুযায়ী পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০২৩ সনের ৩১ আগষ্ট চুড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করেন। আর এই রিেেপার্টে উল্লেখ্য রয়েছে সে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মারা যান। ২০২৩ সনের ১২ অক্টোবর এই মামলাটি খারিজ করে দেয় আদালত। এতে কের বিচার থেকে বঞ্চিত হন নিহত শাওনের পরিবার।
মহানগর বিএনপির আহাবয়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খাঁন বলেন, ২০২২ সনের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে আমরা র্যালী করেছিলাম। তখন পুলিশ প্রশাসন আমাদের উপর লাটি চার্জ শুরু করে, একই সাথে আমাদের নেতাকর্মীদের উপর গুলি বর্ষন করতে থাকে। তখন যুবদল নেতা শাওন প্রধান আমার সামনে পুলিশের গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ওই সময় হয়ত এই গুলি আমার উপরে বিদ্ধ হতে পারত শাওন যদি সামনে না থাকত। হয়ত এই গুলিটি আমার শরীরে লাগতে পারত, আমিও হয়ত তার মত জীবন হারাতে পারতাম। কারন শাওন যখন ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় তখন আমি তার লাশটি আমার কুলে নিয়ে তাকে হসপিটালে নিয়ে যাই। ওই সময় শাওনের শরীর থেকে যে গরম রক্ত বের হয়েছিল সেই রক্তে আমার জামার কাপড়সহ হাত লাল হয়ে যায়। সেই দিনের ঘটনাটি এখনো আমার মাঝে জাগরিত হয়। আমি তা এখনো অনুভব করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, গত ১৫ বছর বিচারহীনতার রাজনীতি ছিল বাংলাদেশে। আমাদের সামনে প্রকাশ্যে পুলিশ গুলি করেছে। আমরা মামলা দিয়েছি কিন্তু সেই মামলা পুলিশ নেই নাই। উল্টো শাওন হত্যায় বিএনপির অজ্ঞাত নেতা কর্মীদের পাচঁ হাজার আসামী করা হয়। সরকার পতনের পর ২০২৪ সনে ২১ অক্টোবর শাওনের ভাই বাদী হয়ে ন্যায় বিচার চেয়ে মামলা করেন। যা তদন্ত অবস্থায় আছে। আমরা আশা করি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাবে শাওনের পরিবার।
নিহত শাওনের ভাই মিলন জানান, আমার ভাই শাওন হত্যার বিচার চাই। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তারা আমাদের হুমকি ধমকি দিয়ে বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। আমরা আমাদের ভাই হত্যার বিচার চাই।
জেলা যুবদলের আহবায়ক সাদেকুর রহমান সাদেক বলেন, যুবদল নেতা শাওনকে নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারা তখন মিথ্যাচার করেছিল। কিন্তু তাদের মিথ্যাচার কোন কাজে আসে নাই। আমরা যুবদল নেতা শাওন হত্যার বিচারের দাবী জানাই। যারা এই হত্যার সাথে জরিত তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।