হুইল চেয়ারে বসেই চালাতেন ফতুল্লার অন্ধকার জগত

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

হুইল চেয়ারে বসেই চালাতেন ফতুল্লার অন্ধকার জগত
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার 'ক্রাইম জোন' খ্যাত কুতুবপুর ইউনিয়নে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে থাকে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততা আর রাজনৈতিক নেতাদের পত্যক্ষ্য ও পরোক্ষ মদদে ফতুল্লার পাগলার কুতুবপুর যেন অপরাধীদের নিরাপদ জোন। যেখানে চলছে রমরমা মাদক ব্যবসাসহ সড়ক পথে, নদী পথে বিভিন্ন কায়দায় চাঁদাবাজিসহ বহু অপকর্মের অভয়ারন্য। যেখানে রাজনৈতিক দল হিসেবে ও প্রধান দুই বড় দলের কোন ভেদাভেদ নেই। যখন যে দল আসে সেখানকার সন্ত্রাসীরা তখনই সেই দলের ছত্রছায়ায় অপকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। এদিকে এই কুতুবপুর ইউনিয়নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শারীরিক প্রতিবন্ধীর তকমা ব্যবহার করে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ছিলেন অনেকেই। তারা পঙ্গু অবস্থায় হুইল চেয়ারে বসে নিয়ন্ত্রণ করতে কুতুবপুরের নানান অপকর্ম।
এদিকে কিছু বছর পূর্বে শেখ হাসিনাকে মা বলে ভাইরাল হয়েছিলেন কুতুবপুরের বাকপ্রতিবন্ধী ছাত্রলীগে নেতা সাঈদ শেখ। পরবর্তীতে শামীম ওসমানের সাথে বিভিন্ন পোগ্রামে দেখা করে কথা বলে, ছবি তুলে এলাকায় টাইম লাইনে উঠে আসেন। পরবর্তীতে শামীম ওসমান তার নেতাকর্মীদের বলে দিয়েছিলেন যেহেতু ছেলেটা ছাত্রলীগ করে সেই ক্ষেত্রে তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগী করতে। এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দলীয় পোগ্রামে ছেলেটিকে লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু পরবর্তীতে ৫ আগষ্টের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো তাকে ও এলাকায় দেখা যায়নি। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে রাজধানীর গুলিস্তানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে সাঈদ শেখ (২১) নামের তরুণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। সাইদুলকে বাক্প্রতিবন্ধী হিসেবে উল্লেখ করেন অনেকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে এ বিষয়ে মতামত জমা দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কারা কর্তৃপক্ষ সেই বিশেষজ্ঞ মতামত জমা দিতে পারেনি। কিন্তু ইতিমধ্যে ৯ দিন হাজতবাস করা সাঈদ শেখের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে গতকাল তাঁর জামিন মঞ্জুর করেছেন ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) জাকির হোসেন।
জামিনের আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৫ আগস্ট গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সাঈদ শেখকে। এজাহার অনুযায়ী, সাঈদ শেখ আওয়ামী লীগের মিছিলে যান। তিনি এর আগেও আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি টেলিভিশনে বক্তব্য দেন। সাঈদ শেখের ব্যাপারে কারাগারের চিকিৎসকের প্রতিবেদন তলব করা হয়। চিকিৎসকের সেই প্রতিবেদন আদালতে জমা দেননি। আসামিপক্ষ পক্ষ থেকে সাঈদ শেখকে প্রতিবন্ধী দাবি করা হয়েছে। আসামি ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। আসামির হাজতবাস ৯ দিন। আসামির শারীরিক অবস্থা, হাজতবাস ও তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিবেচনায় ৫০০ টাকা মুচলেকায় জামিন মঞ্জুর করা হয়।
এর আগে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। সেখান থেকে জানা যায়, আসামি সাঈদ শেখ প্রতিবন্ধী কি না, সে বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আসামি প্রতিবন্ধী কি না, সে বিষয়ে ঢাকার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেটি আদালতে জমা দেওয়া হবে।
সাঈদ শেখের আইনজীবী কায়েস আহমেদ বলেছেন, তাঁর মক্কেল একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেওয়া প্রতিবন্ধীর সেই কার্ড আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগ হয়েও প্রতিবন্ধী হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ছাড় পেলেন এই শেখ সাঈদ।
এদিকে কুতুবপুরের অন্যতম লেংরা সন্ত্রাসী মীর হোসেন মীরু যিনি ডাকাতির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে গুলিতে পঙ্গু হতে হয়েছে আরো পনেরো বছর আগেই। তাতেও খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, জমি দখল ছাড়তে পারেননি কুতুবপুরের বহুল আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী, ৪টি হত্যাসহ ১৯টি মামলার আসামি মীর হোসেন মীরু। শতাধিক দুর্ধর্ষ ক্যাডার নিয়ে হুইল চেয়ারে বেেস পুরো কুতুবপুর ইউনিয়নকেই অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন কুতুবপুরের আতঙ্ক মীরু।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুর থেকে আশির দশকের কুতুবপুরে আসেন মীরুর বাবা দিনমজুর নুরু মিয়া হতদরিদ্র নুরু মিয়া বসবাস করতেন কুতুবপুরের বৌবাজারে বেড়ায় ঘেরা এক ছাপড়া ঘরে সেখানেই শৈশব-কৈশোর কেটেছে একসময়ের ছিঁচকে সন্ত্রাসী মীরুর ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভাড়ায় ডাকাতি ও ছিনতাইকারী দলের সদস্য হিসেবে কাজ করে আসা মীরুকে ডাকাতির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে গুলিতে পঙ্গু হয়ে যায় মীরু এরপর সন্ত্রাসের অন্ধকার ও কলঙ্কিত জগতের অধিপতি হয়ে যান মীরু অস্ত্রধারী শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে কুতুবপুরবাসীকে জিম্মি করেন। যাকে ঘিরে মীরুকে তাই স্থানীয় জনসাধারণ কুতুবপুরের ভাইরাস নামেও আখ্যা দেন। এসপি হারুনের সময়কালে শীর্ষ সন্ত্রাসী মীরুকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের হেফাজতে একদিন থাকার পরে পরের দিন পুরো মুখ রুমালে ঢেকে আদালতে আসে মীরু। তখন আদালতপাড়া গুঞ্জন ওঠে, জিজ্ঞাসাবাদে এসপি হারুনের জামাই আদরে মীরুর চোখ-মুখ ফুলে যাওয়াতেই লজ্জায় রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকেছিলেন মীরু মীরুর শেল্টারেই কুতুবপুরজুড়ে চলছে অবাধে মাদক, সন্ত্রাস, জুয়ার মহামারি চলছে মীরু বাহিনীর সন্ত্রাসীদের মধ্যে তার ভাগিনা ও বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড শাকিল ওরফে কিলার শাকিল, কিলার আকতার, মীরুর ভাতিজা রিয়াজ, কালা জাহাঙ্গীর, রসুলপুরের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রবিন, চিতাশালের নাডা খোকন ওরফে পাইক্কা খোকন, বটতলার নাবিল, রসুলপুর মুরগীর ফার্মের আবির, চিতাশালের রিকশাচোর মালেক, বৌবাজার বটতলার হাসান, নয়ন, চয়ন, সোহাগ, সিয়াম, হাসান-২, রেললাইনের জনি, চিতাশাল মুসলিমপাড়ার খবির ওরফে লেবার খবির, মোহন ওরফে জুয়াড়ি গাঞ্জুটি মোহন, বটতলার মেম্বার লিটন, বৌবাজারের দিপু, রসুলপুরের পায়েল। এদিকে ২০২০ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগে মীর হোসেন মীরুকে ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর গ্রেফতার করেছিলো ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ। ঐ বছর ৭ অক্টোবর রাতে পাগলা রেলস্টেশন এলাকায় ৪ যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত ও গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করার ঘটনায় দায়ের করা মামলা তাকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ৩ মার্চে মীরু বাহিনীর এক সদস্য হত্যা মামলার আসামীকে গ্রেফতার করে বিপাকে পড়েছিলো ফতুল্লা থানা পুলিশ। এদিন মীরু বাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে সেই সন্ত্রাসীকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। একই বছর ১০ ফেব্রুয়ারি শাহী বাজার এলাকায় ডিস ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ হলে ডিস ক্যাবল কর্মচারী শাজাহান নামে একজনকে প্রকাশ্যেই কুপিয়ে হত্যা করে মীরু বাহিনী। এ সংঘর্ষে আরও ৬ জনকে কুপিয়ে ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহতও করে তারা। মীরুকে প্রধান আসামী করে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। একই বছর ৫ জানুয়ারি মীরু বাহিনীর ৩ সন্ত্রাসীকে অস্ত্র, গুলি ও এক হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনা পুলিশ বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানা অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি এবং সালাউদ্দিন হাওলাদার নামে এক ব্যবসায়ী চাঁদাবাজির অভিযোগে দ্রুত বিচার আইনে আরও একটি মামলা করে। ২০১২ সালের ৩ নভেম্বর রাতে নিজ বাসা থেকে মীরু এবং তার সহযোগী ইকবালকে ৫ রাউন্ড গুলিভর্তি একটি পিস্তল ও ১৩ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে র্যাব-১০। এঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় মীরুর বিরুদ্ধে দুইটি মামলা হয়। ২০১৩ সালের ১৪ অক্টোবর এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে মীরু ও তার ক্যাডাররা ভাঙ্গাপুল এলাকায় গিয়ে জাকের পার্টি নেতা হোসেনের বাড়ির সামনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ২০১৪ সালে মীরুর বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নেয়ার অপরাধে এই বছরের ২৮ এপ্রিল রাতে স্থানীয় দুই সহোদর আব্দুর রহমান ও সজলকে শাহী বাজার এলাকার একটি দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায় মীরু বাহিনী। পরে তাদের এলোপাথাড়ি কুপিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সড়কের পাশে ফেলে রেখে যায়। এঘটনায় মামলা হলে মামলাটি তুলে নিতে মীরু তার শ্যালক আরিফ, শরিফ ও রিয়াজ, রাজিবসহ ১৫-২০ জনের একটি দল ওই বছরের ১২ মে রাত ১২টায় আব্দুর রহমান ও সজলদের বাড়িতে বোমা হামলা চালায় এ ঘটনায় ফতুল্লা থানায় আরও একটি মামলা দায়ের হয় মীরু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের ১০ জুন নূরুল হককে নামে এক ব্যবসায়ীকে তার মায়ের সামনেই পিটিয়ে হত্যা করে এই সন্ত্রাসী বাহিনী। ফতুল্লা মডেল থানায় মীরুর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়। একই বছরের ১৯ মার্চ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানোর অভিযোগে এক ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী মীরুসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর দু’দিন আগে এক এএসসি পরীক্ষার্থীকে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় এলাকাবাসীর উপর হামলা চালায় মীরু বাহিনী। এ হামলায় ২০ জন নিরীহ এলাকাবাসী আহত হয়। কিন্তু গত ৫ আগষ্টের পরবর্তী সময়ে পালিয়ে থাকলে ও এখনো অপরাধের কলকাঠি গুলিস্থান বসে বসে নাড়ছেন এই সন্ত্রাসী মিরু।
একইভাবে মীরুর মতো হুইল চেয়ারে বসে কুতুবপুরের পাগলার চাঁদাবাজিসহ বহু অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন শ্রমিকলীগ নেতা কাউসার আহম্মেদ পলাশের সহযোগী পিয়াস আহম্মেদ সোহেল। যিনি পলাশের ছত্রছায়ায় পঙ্গুত্ব অবস্থায় পাগলা এলাকায় শ্রমিকদের উপরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতেন এই সোহেল। তা ছাড়া পাগলা নদীরপাড়ের বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা-বানিজ্যে গড়ে তুলেছিলেন। শুধু তাই নয় তার বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা, বিভিন্ন মিটিং মিছিলে শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করা করলে তাদেরকে পাগলা নদীরপাড়ে তার টর্চার সেলে এনে করা হতো অত্যাচার। এ ছাড়া নৌপথে চাঁদাবাজি ছিলো তার প্রধান আয়ের উৎহ। সেই সকল চাঁদাবাজি পাগলা নদীরপাড়ের হুইল চেয়ারে বসেই এই লেংড়া পিয়াস আহম্মেদ সোহেল সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। বর্তমানে কুতুবপুরে প্রতিবন্ধী হওয়ায় নানা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করেও ছাড় পান এসব সন্ত্রাসীরা। কাকতালীয় হলেও কুতুবুপুর ইউনিয়নেই এসব ব্যক্তিদের নানা অপরাধের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর গত একবছরে এই ইউনিয়নেরই শারীরিকভাবে নানা ত্রুটি থাকা কয়েকব্যক্তি দুর্ধর্ষ মীরু, সোহেলের শুন্যস্থান পূরণ করে চলেছেন। তারাও একই কায়দায় সন্ত্রাসী গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছেন।