শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অগ্নিঝুঁকিতে না’গঞ্জের হোসিয়ারী পল্লী

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ৫ মে ২০২১  

ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঝুঁকির মধ্যেই পরিচালিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি পল্লীগুলো। শঙ্কা প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, হোসিয়ারি পল্লীর ভবনগুলো একটির সাথে আরেকটি লাগোয়া। সেফটি ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিটি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। বৈদ্যুতিক তারগুলো উন্মুক্ত। স্টোর নীতিও মানছে না ব্যবসায়ীরা। ফলে যেকোন সময়ে ঘটতে পারে আরো বড় ধরনের দূর্ঘটনা।


ইতিমধ্যেই শহরের নয়ামাটিতে অবস্থিত হোসিয়ারী পল্লীতে পরপর দুটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। সবশেষ গত ৩ মে নয়ামাটি এলাকার অর্চনা মার্কেটের চার তলায় একটি হোসিয়ারি গোডাউনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।


এর আগে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে নয়ামাটি এলাকার ৮ তলা ভবনের নিচ তলার হোসিয়ারিতে অগ্নিকান্ডের ঘটেছিলো। উভয় ঘটনায় তাৎক্ষনিক ভাবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে আসলেও আশপাশে পানির উৎস না থাকায় এবং সরু গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে না পারায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয় ফায়ার ফাইটারদের।


নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানিয়েছেন, হোসিয়ারী পল্লীর ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ন। একটির সাথে আরেকটি লাগোয়া। অভ্যান্তরিন গলিগুলো সরু। অনেক স্থানেই পানির উৎস নেই। এখানে পানিবাহি গাড়ি নিয়ে ভেতরে যাবার মত পর্যাপ্ত সড়ক ব্যবস্থাও নেই। ফলে দূর্ঘটনা ঘটলে তা নিয়ন্ত্রনে আনতে বেগ পেতে হয়। তাছাড়া সেফটি ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিটি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। স্টোর নীতি মানছে না ব্যবসায়ীরা। বৈদ্যুতিক তারগুলো উন্মুক্ত। যেকোন সময়ে বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।’


তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মালামালগুলো যত্রতত্র করে রাখে। বৈদ্যুতিক তার গুলোও উন্মুক্ত ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এর আগেও তাদেরকে আমরা বহুবার নোটিশ দিয়েছি। ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পরও আমরা তাদের সতর্ক করে নোটিশ দেই। গত কয়েক মাস যাবত নতুন করে নোটিশ দেয়া শুরু করেছি। আমরা জানতে পেড়েছিলাম, হোসিয়ারিগুলো নির্দিষ্ট একটি জায়গায় স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু এখনো কোন স্থান চুড়ান্ত হয়েছে বলে জানতে পারিনি। হোসিয়ারিগুলো নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।’


কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিপ্তরের কর্মকর্তা সৌমেন বড়–য়া দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানিয়েছিলেন, ‘যেসকল ভবনে হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, এগুলোর বেশির ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ন। হোসিয়ারিগুলো কলকারখানা অধিদপ্তরের সঠিক নিয়মাবলী মেনে পরিচালিত হচ্ছে না। তাই প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মত হোসিয়ারি থাকলেও তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা বাধ্যতামূলক, তাই মামলা দেয়া হচ্ছে। গত অর্থবছরে ৪৭টি হোসিয়ারির বিরুদ্ধে মামলা হয়। চলতি বছরে ১৩টি সহ মোট ৬০টি মামলা রুজু হয়। লাইসেন্স বিহীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হবে বলে জানান তিনি।’


শঙ্কা প্রকাশ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে যেকোন সময়ে আরো বড় ধরনে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিদ্যুৎ, টিঅ্যান্ডটি, স্যাটেলাইট কেব্লসহ বিভিন্ন তারের জঞ্জাল রয়েছে। সেখান থেকে অগ্নিকান্ডের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আরো একটি চকবাজার বা চুরিহাট্টার মত ভয়াবহ ট্র্যাজেডির আশঙ্কা বিদ্যমান। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়েছে, তারাও শঙ্কা প্রকাশ করেছে।’


জানা গেছে, ১৯২১ সালে বাবু সতীশ চন্দ্র পাল নারায়ণগঞ্জ জেলার টানবাজার এলাকায় বাংলাদেশের প্রথম হোসিয়ারি কারখানা গড়ে তোলেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে শিল্পনগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ। বর্তমানে নয়ামাটি এলাকাটি এ ব্যবসার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠলেও শহরের উকিলপাড়া, দেওভোগ ও টানবাজার এলাকা হোসিয়ারি পল্লী হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। তথ্য বলছে, এসব হোসিয়ারি পল্লী থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়।      


তবে, শতবর্ষী এই হোসিয়ারি শিল্প নারায়ণগঞ্জসহ গোটা দেশের অর্থনীতি ও পোষাক চাহিদা পূরনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখলেও বর্তমানে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে তা পরিচালিত হচ্ছে। অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিতো বটেই, ঝুঁকিপূর্ন হয়ে পড়েছে টানবাজার, নয়ামাটি ও উকিলপাড়া এলাকার হোসিয়ারি ভবনগুলোও। বহু পুরাতন ও জারাজীর্ণ ভবনগুলোতে যুগের পর যুগ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন হোসিয়ারি মালিকরা। এতে যেকোন সময়ে বড় ধরনের দূর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে নারায়ণগঞ্জেও যেকোন সময়ে ঘটতে পারে চুরিহাট্টা ও আর্মানিটোলার মত ভয়াবহ দূর্ঘটনা।
 

এই বিভাগের আরো খবর