শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আবারও মাঠে হেফাজত

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০২২  


 
# ডিসেম্বরে আসছে ত্রিমূখী কর্মসূচী
# রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তারা
 
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রীক ইসলামী সংগঠন। যা ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীর (প্রয়াত) নেতৃত্বে গঠন করা হয়। এই সংগঠনটি প্রথম আলোচনায় আসে নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং পরে জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে।

 

 

তবে দেশ ও দেশের বাহিরে এই সংগঠনটি ব্যাপক আলোচনায় উঠে আসে ২০১৩ সালের ৫ মে। সে সময় ১৩ দফা দাবি তুলে ধরে সারাদেশ থেকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বরে জড়ো করে সরকার পতনের হুমকিতে ধারাবাহিকভাবে অবস্থানের ঘোষণা দেয় তারা।

 

 

মূলত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শাহবাগে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্য তারা এই কর্মসূচী ঘোষণা করেন বলে জানা যায়। সেই ঘটনাটি সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে আর সামনে বাড়তে পারেনি।

 

 

এরই মধ্যে দলীয় প্রধানের মৃত্যু ও নেতৃত্বের কয়েক দফা পরিবর্তন এবং বিভিন্ন নাটকীয় ঘটানার কারণে বেশ কিছুদিন পর্দার অন্তরালে ছিল সংগঠনের কর্মকাণ্ড। তবে আবারও মাঠ গরম করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন সংগঠনটি। সভা-সমাবেশ ও সম্মেলনসহ কমিটি পূনর্গঠন এবং দেশব্যাপী কর্মসূচীর মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তি জোরদার করার প্রক্রিয়া শুরু করছেন বলে জানা গেছে।

 

 

এরই মধ্যে আগামী ১৭ ডিসেম্বর গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে এই ‘ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনের’ ডাক দিয়েছে সংগঠনটি। অন্যদিকে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির মহাসমাবেশের ডাক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও ডিসেম্বরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচীর ঘোষণা দেওয়ায় তিন দলের এই ত্রিমূখী কর্মসূচীতে রাজপথ উত্তপ্ত থাকবে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর।

 

 

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে হেফাজতের এই কর্মসূচীকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। অনেকেই আবার বিএনপির ডাকা কর্মসূচীর সাথে তাদের ডাকা কর্মসূচীর সম্পর্ক খুঁজে দেখছেন। তাই বলা বাহুল্য বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন প্রকার ইঙ্গিত কি না বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে এসেছে।

 

 

কেউ কেউ আবার ২০১৩ সালের সেই আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করবে কি-না এমন প্রশ্নও করছেন। যদিও বিভিন্ন মিডিয়ায় হেফাজত নেতৃবৃন্দ সেরকম কোন ঘটনা নয় বলে দাবি করে তারা রাজনৈতিক কোন কর্মকাণ্ডে যাচ্ছেন না বলে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন।

 

 

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কর্মসূচীতে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয় হেফাজত। এরপর থেকে অবশ্য সরকারী দল হেফাজতের উপর নরম হওয়ার নীতি অবলম্বন করেন এবং হেফাজতের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে এনে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করার চেষ্টা করেন।

 

 

সরকার ও হেফাজতের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ হিসেবে হেফাজতের বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে সরকার। কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা দেন সরকার। যার ফলস্বরূপ ২০১৮ সালে ঢাকায় একটি শোকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করেন এবং ‘কওমি জননী’ উপাধি প্রদান করেন হেফাজত।

 

 

এর আগে হেফাজতের প্রস্তাব অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু পাঠ্যবইয়ে সংশোধনী আনে সরকার। সে পর্যন্ত অনেকটা ভালই ছিল তাদের সম্পর্ক। তবে দৃশ্যপট আবারও পাল্টাতে শুরু করে শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর। তখন হেফাজতের আমিরের দায়িত্ব পেয়ে জুনায়েদ বাবুনগরী কমিটিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন।

 

 

বাদ পড়েন আগের কমিটির নেতৃবৃন্দ। জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর সংগঠনটির আমিরের দায়িত্ব নেন শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। সর্বশেষ ২০২১ সালে বেশ কিছু ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নাম।  

 

 

২০২১ সালের মার্চে  ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরোধীতা করে বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের গুলি ও সরকার সমর্থকদের হামলায় হতাহত হওয়ার অভিযোগে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে তারা। সেই ঘটনায় রাস্তা অবরোধ গাড়িতে অগ্নি সংযোগসহ ব্যাপক নাশকতার অভিযোগে হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়।

 

 

তবে সবচেয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয় ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল মামুনুল হকের নারী ঘটিত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর এই মামুনুল হক হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব নির্বাচিত হন এবং ২৬ ডিসেম্বর হেফাজতের এক সভায় তাকে ঢাকা মহানগরীর মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 

 

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে একজন নারীসহ অবকাশযাপন করার অভিযোগে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাকে অবরুদ্ধ করে লাঞ্ছিত করে এবং প্রশাসনকে খবর দেয়। যদিও মামুনুল হক তাকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবি করেন। মামুনুল হকের সেই রিসোর্টে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

 

 

সেই বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে হেফাজতের কর্মীরা সেখানে জড়ো হয়ে রিসোর্টে ভাঙচুর চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। মামুনুল হক দাবী করেন জিজ্ঞাসাবাদের নামে কিছু মানুষ তাকে ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে হেনস্তা করেছেন। এই ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

 

 

এই মামুনুল হক ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজত আন্দোলনে নেতৃত্বের জন্য গ্রেফতার হয়েছিলেন। সেসময় তিনি ‘কারাগার থেকে বলছি’ নামক একটি বইও রচনা করেন, যা ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়।

 

 

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের দু’দিন আগেও তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় বলে জানা যায়। ২০২১ সালের সেই নারী ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সারাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা সহ অর্ধশতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরপর প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় যাবত অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল হেফাজত।

 

 

সম্প্রতি সংগঠন সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটি সম্প্রসারণ এবং চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় কমিটি পুনর্গঠনসহ সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরে ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউনের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।

 

 

বিষয়টি জানার জন্য ডিআইটি জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুল আওয়াল ও হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সাবেক সভাপতি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের মোবাইলে চেষ্টা করা হলে মোবাইল রিসিভ করেননি তারা।

এস.এ/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর