বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আবারো আতঙ্কের জনপদ নারায়ণগঞ্জ

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২৫ মে ২০২২  

# বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার লোভে এসব অপকর্ম করে : আনিসুর রহমান দিপু
# আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন না : রফিউর রাব্বি

 

প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত এক সময়ের ব্যবসা বাণিজ্যের শহর এই নারায়ণগঞ্জের সুনামের খ্যাতি বাংলাদেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে পাট ও সুতা, হোসিয়ারি সামগ্রী এবং তৈরি পোশাক রপ্তানী ছাড়াও চাল, ডাল, লবনসহ বিভিন্ন পাইকারী ব্যবসায় দেশ জুড়ে নারায়ণগঞ্জের সুনাম ছিল। সেই সুপরিচিত নারায়ণগঞ্জ এখন অপহরণ,

 

গুম, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নদীদখল, ভূমিদস্যুতার মতো ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক খুন, অপহরণ, জখম ও সন্ত্রাসীর হামলার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ হয়ে উঠেছে এখন আতঙ্কের জনপদ।

 

পত্রিকার পাতা কিংবা অনলাইন পোর্টালে চোখ রাখলে এখন এসব ঘটনা ছাড়া অন্যকোন সংবাদ যেন দেখাই যায় না। বিশেষ করে আমরা যদি গত এক যুগের মধ্যে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ সদর ও সদর সংলগ্ন এলাকাগুলোর চিত্রের দিকে তাকাই তাহলেও এর ভয়বহতা লক্ষ্য করা যায়।

 

গত ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নিখোঁজ হয় ত্বকী। এরপ দু’দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর একটি ঘাটে বস্তাবন্দি অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই সময় এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলাসহ হত্যার বিচার চেয়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করা হয়। গঠন করা হয় ত্বকী মঞ্চ। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সদর উপজেলার লামাপাড়া এলাকা থেকে

 

সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করার তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত ওই সাতজন হলেন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু যুবলীগ কর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও তাঁর গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, লিটন,

 

শেখ রাসেল জাতীয় শিশু–কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম। আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

 

আলোচিত এ মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত।

 

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে নিজ বাসায় এক মা নাজনীন (২৬) ও তার দুই মেয়ে নুসরাত (৮) ও সুমাইনা (২)কে গলা কেটে হত্যা করা হয়। তাঁদের লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন স্থানীয় লোকজন। গত ১ মার্চ নগরীর নিতাইগঞ্জ ডাইলপট্টি এলাকায় মাতৃভবন নামের এক ভবনের ৬ তলার একটি ফ্ল্যাট বাসায় রামপ্রসাদ চক্রবর্তীর স্ত্রী রুমা চক্রবর্তী (৪৬) ও তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে ঋতু চক্রবর্তী (২২) খুন করা হয়।

 

এ ঘটনায় রক্তমাখা ধারালো ছুরিসহ জুবায়ের (৩২) নাকে এক যুবককে আটক করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল দুপুরে শহরের ইসদাইর রেললাইন এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ী শামীম (৩০)কে প্রকাশ্যে কুপিয়ে এবং হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

 

ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মো. আলী ও আসিন নামের দুজনকে আটক করা হয়েছে। সর্বশেষ হত্যার শিকার হন নাসিক ১৪ নং ওয়ার্ডের শুভ্রত মণ্ডল জয় (২২) নামের এক যুবক। এর মধ্যে আরও বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আছে যা স্বল্প পরিসরে বর্ননা করা সম্ভব না। একই সাথে গাড়ি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে হত্যার ঘটনাতো হরহামেশাই ঘটছে।

 

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, শুধু নারায়ণগঞ্জেই না, সারা দেশেই এগুলো বেড়ে গেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা যখন ঘনিভূত হয় তখন এই সমস্যাগুলো প্রকট আকারে দেখা যায়।

 

জিনিসপত্রের দাম, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এগুলো একটি বিষয়। অন্যদিকে যখন একটি এলাকায় গণতন্ত্র চর্চা বন্ধ থাকে, তখন এমনিতেই এগুলো বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন না। সরাকার বিরোধী যারা আছে তাদেরকে দমন পীড়নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যস্ত থাকে। যার ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা অবনতি হচ্ছে।

 

জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য এডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, প্রযুক্তির বিস্তারের যে পজেটিভ নেগেটিভ সাইড আছে তার নেগেটিভ কারণগুলোর মাধ্যমে তাদের মধ্যে একটি নেগেটিভ চেতনা তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব ঘটনার বেশিরভাগই বাচ্চাকাচ্চারা করতেছে।

 

সমাজ পতিরাও  এদের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। কিশোরদের মাধ্যমে যেসব হত্যাকান্ড ঘটতেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার চেয়ে বিভিন্ন পজেটিভ প্রক্রিয়ায় যদি তাদের সমাজের মূল ধারায় আনা যায়। অনেক রাজনৈতিক নেতা তাদের আধিপত্য বিস্তারে তাদের ব্যবহার করছে। আগে যেমন রাজনীতির একটা পজেটিভ দিক ছিল।

 

রাজনীতিতে আসার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের জন্য কিছু করা। এ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ছাত্ররা ছাত্র-রাজনীতিতে আসতো। এখন ভাই জিন্দাবাদ, এবং ভাইকে খুশি করার জন্য যেকোন অন্যায় করতেও তারা দ্বিধাবোধ করছে না। ভাই যে নির্দেশ দিবে, সেটা ভাল হোক কিংবা মন্দ হোক, ভাইয়ের কাছে নিজেকে বড় হিসেবে প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা এবং বিভিন্ন অপকর্ম করে ভাইয়ের নজরে চলে আসা।

 

ভাইয়ের নজরে আসলে, ভাই তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিবে। সেই আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে কোন অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব ঘটনা ঘটার বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল সেই ঘটনার মূল কারণটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আরেকটা বিষয় হলো এইসব বিষয়ে যে মামলা হয় ভূক্তভোগী বা তার পরিবারকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে মামলাটাকে আপোষ করে ফেলে। এসব এইসব অপরাধীরা দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি পায় না। যার ফলে অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হয়।

 

সোজা কথা এইসব ঘটনায় দৃষ্ঠান্ত মূলক শাস্তি দিতে হবে। এই সব ঘটনার বেশির উৎপত্তিই হয় মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। সমাজের শিশু কিশোররা খুব সহজেই মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। মাদকের বড় বড় কারবারীরা এই সব শিশুদের ব্যবহার করতেছে। এই সব ব্যবসায় শিশু কিশোরদের হাতে কাঁচা টাকা চলে আসছে।

 

এসব টাকা ভাগাভাগি নিয়েও শিশুদের মধ্যে এসব অপরাধ বেড়ে চলছে। ফলে আগামী প্রজন্ম অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। এখন রাজনীতির চর্চা, সাংস্কৃতির চর্চা বা খেলাধুলার চর্চা নাই।

 

এই বিভাগের আরো খবর