বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আবারো আলোচনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ, পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক

প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : আবারো আলোচনা-সমালোচনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না তাদের। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) যোগদানের পর সিদ্ধিরগঞ্জে অপরাধ দমনে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করলেও তার কথায় আস্থা রাখতে পারছে না এলাকাবাসী। অপরাধ দমন ও অপরাধীদের নিয়ে গণমাধ্যমে দেয়া ওসি কামরুল ফারুকের বক্তব্যের মাত্র ১২ ঘন্টার মাথায় টক অব দ্যা নারায়ণগঞ্জ হয়ে উঠেছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা।

 

থানার উপ-পরিদর্শক কামাল হোসেন (এসআই) ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মোমেন আলম নিজেদের ডিবি ও র‌্যাব পরিচয় দিয়ে শুক্রবার বিকালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থেকে মফিজুল ইসলাম মিঠু নামে এক যুবককে ধরে এনে দুইদিন আটকে রেখে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। বুধবার ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর তোলপাড় চলছে সর্বত্র। পুলিশের এমন আচরনে ক্ষুব্দ সিদ্ধিরগঞ্জের সাধারণ মানুষ।

 

অথচ ওসি কামরুল ফারুক গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন গুম, খুন, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতাসহ সকল অপরাধের লাগাম টেনে ধরছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে এসেছি সাধারণ মানুষেকে সেবা দেওয়ার জন্য। অতীতে সিদ্ধিরগঞ্জে যে সব মাস্তানি চলেছে তা আর চলতে দেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারী করে তিনি আরও বলেন, আইনের উর্ধ্বে কেউ নন। 

 

তিনি আরো বলেন, অপরাধ করলেই কোন ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজসহ সকল ধরনের অপরাধ মূলক কর্মকান্ড নির্মূল করা হবে। সাথে সাথে মূল হোতাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। দল বা ক্ষমতা কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবেনা। কিন্তু ওসির এই বক্তব্যের ১২ ঘন্টার মাথায় ঘটলো ন্যাক্কারজনক এই ঘটনা।

 

এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জ পুলিশ অতি উৎসাহিত হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে লোক ধরে নিয়ে আসেন, আবার ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন এ বিষয়ে দৃষ্টান্তমুলক ব্যবস্থা না নিয়ে অতীতের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটবে বারবার। আর দায়ভর সিদ্ধিরগঞ্জবাসীর কাধে এসে পড়বে। 

 

এরআগে চলতি বছরের ২০ জুলাই সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আলআমিন নগর এলাকায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে বাকপ্রতিবন্ধী সিরাজ নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। পরে ২১ জুলাই সকালে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে ৭৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত দেড় থেকে দুইশত জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। 

 

মামলায় আওয়ামীলীগ ও সহযোগি সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়। ফলে বিষয়টি নিয়ে স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার এবং ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ অফিসে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে।

 

অভিযোগ উঠে মামলার কপিতে বাদী সাখাওয়াত হোসেন নিজে সাক্ষর করেনি। স্বাক্ষর করেছে থানার পরিদর্শক সেলিম মিয়া। এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে পর্যায়ক্রমে থানার ওসি মীর শাহীন শাহ পারভেজ, পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম মিয়া ও এস আই সাখাওয়াত হোসেনকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

 

কয়েক বছরের বিতর্কের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনার মধ্যে, ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল আলোচিত ৭ খুনের পর সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের কর্মকান্ড নিয়ে সারাদেশে বিতর্ক সৃষ্টি হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সকল অফিসার ও কষ্টেবলদের প্রত্যাহার করে নেয়। 

 

২০১৭ সালের ২৩মে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকার একজন বিধবা নারীর জমি দখলে দখলকারীদের সহযোগিতার অভিযোগে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরাফত উল্লাহ, পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল হোসেন ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওমর ফারুককে প্রত্যাহার করেন পুলিশ সুপার। 

 

পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছিলেন, তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকার মৃত হোসেন আলী সাউদের স্ত্রী আসমা বেগমের অভিযোগের পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেন।

 

তারপরও থেমে থাকেননি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর সোমবার রাতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম সানারপাড় বাঘমারা এলাকায় ডিউটিরত অবস্থায় এলাকার চিহিৃত মাদক স¤্রাট সেলিমকে আটক করে। এসময় সেলিম ও তার সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নিতে উপ-পরিদর্শক মোঃ রফিকুল ইসলামসহ তার সঙ্গীয় ফোর্সেদের উপর হামলা চালায়। 

 

হামলায় উপ-পরিদর্শক মোঃ রফিকুল ইসলামের বাম হাতে দায়ের কোপ লাগে ও শরিরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পায়। পরে ৬’রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে মাদক স¤্রাট সেলিমকে রামদাসহ আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এ ব্যাপারে পুলিশের উপর হামলার মামলা হয়েছে। 

 

অপরদিকে একই দিন সন্ধায় থানার উপ-পরিদর্শক মোঃ মিজানুর রহমান খাঁন মাদক অভিযানে বের হলে থানাধিন পাইনাদী সিআইএ খোলা এলাকার ২’মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। এসময় এলাকার চিহৃত মাদক ব্যবসায়ীরা উপ-পরিদর্শক মোঃ মিজানুর রহমান খাঁনকে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে তাকে আটক করে ধৃতদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে উপ-পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম(২) মিজানুর রহমানকে উদ্ধার করে নামকা ওয়াস্থে শালিশী করে থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনায় থানায় কোন মামলা হয়নি। 

 

একই বছরের ১৩ জুলাই মহাসড়কে টহলরত এক পুলিশ পিকআপ ভ্যানে পিছন দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী লেগুনা পরিবহন ধাক্কা দেয়। লেগুনার ধাক্কায় পুলিশের উপ-পরিদর্শক মোঃ নাছির উদ্দিনসহ ৬ পুলিশ আহত হয়। আহতদের মধ্যে উপ-পরিদর্শক মোঃ নাছির উদ্দিন মাথায় আঘাত পাওয়ায় গুরুত্বর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উক্ত ঘটনায় সামান্য কিছু অর্থের বিনিময় রফা-দফা করেন ওসি আব্দুস সাত্তার।

 

একই বছরের ১৪ সেপ্টম্বর মিজমিজি আব্দুল আলীর পুল এলাকায় উপ-পরিদর্শক মকবুল হোসেন কর্মরত অবস্থায় এলাকার চিহৃত মাদক ব্যবসায়ী রুস্তুম আলীকে মাদকসহ গ্রেফতার করে। এসময় একদল মাদক ব্যবসায়ী উপ-পরিদর্শক মকবুলের কাছ থেকে মাদক ব্যবসায়ী রুস্তুমকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে মারদর করে আটক করে রাখে। 

 

পরে উপ-পরিদর্শক রাসেল আহম্মেদ মুকবুলকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এ ঘটনায়ও থানায় মামলা দায়ের করা হয়নি। 
 ২৫ সেপ্টম্বর আব্দুল আলী পুল এলাকায় চিহৃত মাদক ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করলে তার সহযোগীরা উপ-পরিদর্শক মামুন-উল- আবেদসহ সঙ্গীয় ফোর্সদের উপর হামলা চালিয়ে শহিদুলকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। হামলায় উপ-পরিদর্শক মামুন-উল- আবেদ আহত হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়। 

 

এরআগে ২৪ সেপ্টম্বর নিয়ম মাফিক নদীতে অপরাধ দমনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি দল একজন এএসআই এর নেতৃত্বে রাতে টহল ডিউটি করে থাকে। এরই ধারাবাহীকতায় এএসআই মোঃ রুহুল আমিন ৪ জন কনেষ্টবল নিয়ে রাতে নদীতে টহলে বের হয়। এসময় এসও ঘাট নদীর পাড়ে দেখতে পায় একদল চোর তৈল চুরি করছে। 

 

তাৎখনাত চোরদের ধাওয়া করে ৪ জন তেল চোরকে আটক করতে সক্ষম হলেও বাকিরা পালিয়ে যায়। চোরদের থানায় নিতে নদীর পারে আসলে তেল চোর আশ্রাফের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ও সেবী পুলিশের উক্ত দলটিকে অবরোধ করে লাঞ্চিত করে। 

 

পুলিশের সাথে আশ্রাফের তর্ক-বির্তকের মধ্যে তার ইশারায় অন্যান্য  মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীরা ধৃত ৪ তেল চোরদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তেল চোর ধরার ঘটনায় পুরুস্কার হিসেকে চোরদের বিচার না করে সহকারী উপ-পরিদর্শক রুহুল আমিনকে অন্যত্র বদলী করা হয়। 

 

একই বছর ২০১৭ সালের ২৩ মে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (সার্বিক) মোঃ আব্দুস সাত্তার মিয়া যোগদানের পর ৫ মাসে ৬ পুলিশ অফিসারসহ বেশ কয়েক জন কনষ্টবল অপরাধীদের হাতে মার খেয়েছে।

 

এছাড়াও গত বছরের ২৬ এপ্রিল রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের আটি হাউজিং এলাকায় মাসুম নামে এক যুবককে নারী দিয়ে ব্লাক মেইলিং করে ৫০ হাজার টাকা আদায় করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে যায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মাশিকুর রহমান শান্ত।  পরে ২৭ এপ্রিল পুলিশ সুপার মঈনুল হক মাশিকুরকে প্রত্যাহার করে নেয়। 

 

এ বিষয়ে জানতে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক-অঞ্চল) মেহেদী ইমরান সিদ্দিকী বলেন, পুরোনো ঘটনাগুলোকে নিয়ে এ মুহুর্তে কোন মতামত দিতে পারছিনা। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ প্রমানিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। 
 

এই বিভাগের আরো খবর