বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

আ’লীগের জন্ম বায়তুল আমান, মিউচুয়েল ক্লাব নাকি রোজ গার্ডেন?

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১  

আওয়ামী লীগের জন্ম কোথায়? এই প্রশ্ন এখন নারায়ণগঞ্জের ‘হট টপিক’। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে দু’টি পক্ষ দুই ধরনের কথা বলছে। গত বুধবার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এক বক্তব্যে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া এলাকার মিউচুয়েল ক্লাবে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু মিউচুয়েল ক্লাবের ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন।

 

পরবর্তীতে এই কমিটি ঢাকার রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে এই সভা ও আওয়ামী লীগের জন্ম নিয়ে দ্বিমত রয়েছে ওসমান পরিবারে। তাদের মতে, চাষাঢ়ায় বায়তুল আমানে আওয়ামী লীগের জন্ম। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন ওসমান পরিবারের সদস্য নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ একেএম সেলিম ওসমান।

 

তবে বঙ্গবন্ধুর লেখ অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও গোয়েন্দা নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে, বায়তুল আমানে সভাটি হওয়ার কথা থাকলেও ১৪৪ ধারা জারি করায় ওইদিন সভাটি হয়েছিল মিউচুয়েল ক্লাবে। তবে আওয়ামী লীগের (তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ) কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল রোজ গার্ডেনে। মূলত রোজ গার্ডেনকেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাস্থল হিসেবে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়। এজন্য সংরক্ষণের হন্য রোজ গার্ডেনের ভবনটি কিনেও নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

 


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনে উল্লেখ রয়েছে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের সময় মওলানা সাহেব সমর্থন করেছিলেন। টাঙ্গাইলে মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সভা ডাকা হল, কি করা যায় ভবিষ্যতে! আলোচনা হবার পরে ঠিক হল, আরেকটা সভা করা হবে নারায়ণগঞ্জে। সেখানে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। মওলানা ভাসানী, আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক সাহেব আরও অনেক মুসলিম লীগ কর্মী ও নেতা যোগদান করবেন বলে ঠিক হল। সভার আয়োজন করেছিল আলমাস আলী, আবদুল আউয়াল, শামসুজ্জোহা ও আরও অনেকে। খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএও সমর্থন দিয়েছিলেন।

 

সভার পূর্বে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। আমরা পাইকপাড়া ক্লাবে সভা করলাম। বিভিন্ন জেলার অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন। এই সময় শামসুজ্জোহার উপর মুসলিম লীগের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা আক্রমণ করেছিল। দুঃখের বিষয়, এই কর্মীরাই নারায়ণগঞ্জে মুসলিম লীগ গঠন করেছিল এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। এখন যারা এদের উপর আক্রমণ করেছিল তাদের প্রায় সকলেই পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিল। প্রত্যেক জেলা ও মহাকুমায় মুসলিম লীগ ভেঙে দিয়ে এডহক কমিটি গঠন করেছিল। প্রায় সমস্ত জায়গায় মুসলিম লীগ কমিটিতে শহীদ সাহেবের সমর্থক বেশি ছিল বলে অনেক লীগ ও পাকিস্তানবিরোধী লোকদের এডহক কমিটিতে নিতে হয়েছিল। কিন্তু জনসাধারণ মুসলিম লীগ বলতে শুধু পুরানা লীগ কর্মীদেরই বুঝত। মাওলানা ভাসানী সাহেবের সভাপতিত্বে এই সভা হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, প্রথমে দুইজন প্রতিনিধি করাচিতে জনাব খালিকুজ্জামান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং আমাদের দাবি পেশ করবেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পৃষ্ঠা ১০১ ও ১০২)।

 


গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের ১৫ মে তারিখে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় মিউচুয়াল ক্লাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাবেক কাউন্সিলরদের একটি রুদ্ধদ্বার সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এই সভায় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা রাখেন। বৈঠকে ময়মনসিংহের মাওলানা হামিদ খান (ভাসানী) বক্তৃতা শুরু করেন। সভায় আলোচনার বিষয়টি জানা সম্ভব হয়নি। কারণ এটি একেবারে একটি গোপন একটি বৈঠক ছিল এবং সাধারণ কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না। (গোয়েন্দা নথিতে বঙ্গবন্ধু)

 

গোয়েন্দা রিপোর্টে আরও জানা যায়, একদিন পর ১৭ মে তারিখে নারায়ণগঞ্জের পাবলিক লাইব্রেরীতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ১৫০০ লোক উপস্থিত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এই সভায় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা রাখেন। আরও বক্তব্য দেন প্রফেসর কাজী কামারুজ্জামান, ময়মনসিংহের মৌলভি শামসুল হক ও বরিশালের শমসের আলী। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন, ওসমান  আলী খান এম এল এ, ঢাকার আতাউর রহমান, নারায়ণগঞ্জের আলমাস আলী ও আব্দুল আউয়াল, তিপ্পেরার হাজি রমিজুদ্দিন। (গোয়েন্দা নথিতে বঙ্গবন্ধু) আওয়ামী লীগের জন্ম নিয়ে এর পূর্বেও কথা বলেছেন নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ রাজনীতিবিদ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন।

 

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের জন্ম নারায়ণগঞ্জে নয় রোজ গার্ডেনে হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৩০ জুন চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রমিক লীগের উদ্যোগে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এক অলোচনা সভায় তিনি এই কথা বলেন। ওইদিন আনোয়ার হোসেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৪৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন হয়েছিল। অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগের জন্ম নারায়ণগঞ্জে।

 

আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিলো ঢাকার রোজ গার্ডেনে। জাতির জনক শেখ মজিবুর রহমান নারায়ণগঞ্জের বায়তুল আমানে বসতে চেয়েছিলেন সভা করার জন্য। কিন্তু যখন তিনি নারায়নগঞ্জের বায়তুল আমানে বসতে পারলেন না তখন তিনি বিকল্প উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। যখন পাইকপাড়া জল্লারপাড়ের মিউচুয়েল ক্লাবের সামনে আসলেন তখন ওই এলাকার মুরুব্বীরা তাকে বসতে দিলেন। আর আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে সুরক্ষা দিলেন যাতে তাকে কেউ আক্রমন করতে না পারে। এই হলো নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের ইতিহাস।’

 


নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তো রোজ গার্ডেনেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তবে মওলানা ভাসানী সাহেবসহ বঙ্গবন্ধু আসছিলেন নারায়ণগঞ্জে মিটিং করত। কিন্তু তখন সরকার ১৪৪ জারি করে। পরে পাইকপাড়ার মিউচুয়েল ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। সেখানে আওয়ামী লীগের গঠন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। ফেরার পথে মিছিলে হামলা হয়। ওই হামলায় জোহা ভাই, আলমাস আলীরা মাইর খাইছিল। আমি এগুলো খাঁজা ভাইয়ের (বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রয়াত খাঁজা মহিউদ্দিন) কাছ থেকে শুনেছি। শাহেদ আলী মজনু ভাইও এই সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্ম রোজ গার্ডেনেই।’
 

এই বিভাগের আরো খবর