শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ইতিহাসের নির্মম পদাবলী

রফিউর রাব্বি

প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২২  


# এ গণহত্যায় শহিদ হন এখানকার ১৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই যেমনি গৌরবের তেমনি শোকের। প্রতিদিন অসংখ্য স্বজন হারিয়েছি আমরা, শত্রুকে পরাজিত করে ক্রমাগত এগিয়ে গিয়েছি বিজয়ের দিকে। একাত্তরের ২৯ নভেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেমনি এক শোক ও গৌরবের দিন। দিনটি বক্তাবলী গণহত্যা ও প্রতিরোধের দিবস হিসেবে পরিচিত।

 

 

২৫ মার্চ ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার দুইদিন পর ২৭ মার্চ দুপুরে পাক সেনারা নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে গেলে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সে রাতে শহরে না ঢুকে নারায়ণগঞ্জ সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে কাটিয়ে ২৮ মার্চ সকালে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরে ঢোকে হানাদার বাহিনী।

 

 

যুদ্ধকালীন গোটা নয় মাস নিরীহ মানুষের উপর তারা চালায় বর্বরোচিত নির্মম নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ। সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও রয়ে গেছে তাদের সে নির্যাতন ও বর্বরতার অসংখ্য চিহ্ন। নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত হয়েছে ১০৯টি গণহত্যা, রয়েছে ৩৩টি বধ্যভূমি ও  রয়েছে ৪৬টি নির্যাতনকেন্দ্র। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরপরাধ নিরীহ মানুষদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।

 

 

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল ধলেশ্বরীর পাড় ধরে বক্তাবলীর বাইশটি গ্রাম। বক্তাবলী ও আলীরটেক দুটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে বক্তাবলী পরগনা। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে চলে যাওয়ার সহজ ও নিরাপদ যাত্রাপথটি ছিল এই বক্তাবলী।

 

 

বক্তাবলীর পূর্বে ও দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী আর উত্তরে বুড়িগঙ্গা। দক্ষিণ আমেরিকার আটলান্টিকের পাড়ে লম্বা সরু দেশ চিলির মতো এ বক্তাবলী। দুই নদীর মাঝখানে বক্তাবলীর বাইশটি গ্রাম যেন দুপুরের ঘাসের ওপর বিছিয়ে রাখা মায়ের ভেজা কাপড়।

 

 

২৯ নভেম্বর রাতে যখন ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা বক্তাবলী পরগনা তখন নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় রাত সাড়ে তিনটায় পাকবাহিনী তিনদিন থেকে ঘিরে ফেলে গোটা বক্তাবলী। প্রথমে তারা গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর বুকে অবস্থান নেয়।

 

 

সুবেহ সাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে শুরু করে। সে দিন প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে তারা গ্রামে অগ্রসর হতে সাহস করে না। সে সময় মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল ও কানাইনগর হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড় সংলগ্ন ডিক্রির চর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা।

 

 

যার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সে দিন পাকসেনাদের উপস্থিতি সাথে সাথেই টের পেয়ে যান এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অন্যদিকে কুয়াশা একটু কাটতে থাকলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাক সেনাবাহিনী। তখন সকাল প্রায় সাতটা।

 

 

মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের প্রতিরোধ শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য মাহফুজুর রহমান পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রথম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রতিরোধের শুরুতেই পাঁচজন পাকসেনাকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা এবং আহত হয় বেশ কিছু পাকসেনা।

 

 

পাকসেনারা পাঁচটি লাশ ও আহত দুই জনকে কাঁধে নিয়ে পিছু হটে যায়। এখানে প্রায় দুই ঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এ দুই ঘণ্টা প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ তখন মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হন। এর পরপরই পাকবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর।

 

 

পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে পিছু হটেন। আর তখনই শুরু হয় পাকবাহিনীর তাণ্ডব। তারা ডিক্রির চর নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসাথে হত্যা করে চল্লিশ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়ের পাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেয়া দলবদ্ধ গ্রামবাসীদের আগুন দিয়ে পুরিয়ে হত্যা করে।

 

 

শীতের সকালে রাজাপুরের হলুদ সরিষা ক্ষেত লাল হয়ে ওঠে, পড়ে থাকে লাশের পর লাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শহীদুল্লাহ্, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে তারা। সে দিন বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাক হানাদারবাহিনী। বক্তাবলী পরগনার বাইশটি গ্রামই গানপাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

 

 

দেশে যে কয়টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বক্তাবলী তার মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিরোধ হয়েছে, পাকসেনাদের হত্যা করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা শহিদ হয়েছেন। অথচ নির্মম আমাদের বাস্তবতা ! আজ পঞ্চাশ বছর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ ছাত্রদের তালিকায় যেমনি এ বক্তাবলীর শহিদদের নাম নেই, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের শহিদদের তালিকাতেও এ ১৩৯ জনের একজনেরও নাম নেই।

 

 

অথচ এ একটি মাত্র অঞ্চল যেখানে কোনো একজনও রাজাকার বা স্বাধীনতা-বিরোধী ছিলেন না। এ বাইশটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই গ্রামবাসী মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস নিজেরা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয় নেয়া মানুষদের খাইয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। এ গ্রামগুলোর ছাত্র, যুবক, চাষাভূষা- প্রতিটি মানুষই ছিলেন প্রকৃত অর্থে মুক্তিযোদ্ধা।

 

 

বক্তাবলীর সন্তানহারা, পিতাহারা, স্বজনহারা শহিদ পরিবারগুলোতে এখনও আহাজারি, বুকফাটা আর্তনাদ। আজ বেঁচে থাকার জন্যে, টিকে থাকার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করেও মানবেতর জীবনযাপন করছে অনেক শহিদ পরিবার।

 

 

একথা সত্য যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের যেমন কোন ভূমিকা নেই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় নামে যে একটি মন্ত্রণালয় আমাদের আছে তাদেরও কোন ভূমিকা নেই।

 

 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদগুলোতে আমরা দেখে এসেছি বিএনপি’র শাসনামলে সংসদ কার্যালয়ে জিয়াউর রহমানের ছবি তুলে তাদের জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে, স্বৈরশাসক এরশাদের সময় এরশাদের ছবি তুলে তার গুণগান করতে, আজ বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলে জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন।

 

 

ইতিহাস বিকৃতির দায় বিএনপি, জামায়াত আর স্বাধীনতা বিরোধীদেরই শুধু নয়, পক্ষের শক্তি বলে পরিচিত আওয়ামী লীগেরও তা কম নয়। আহমদ ছফা বলেছিলেন, একাত্তরে যারা একবার রাজাকার-আলবদরে নাম লিখিয়েছেন তারা সারা জীবনই রাজাকার আর স্বাধীনতা বিরোধী। কিন্তু যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বা ক্যাম্পে গিয়ে নাম লিখিয়েছেন তাঁরা সারাজীবনই মুক্তিযোদ্ধা নন।

 

 

দেশের ক্রান্তিলগ্নে পদে পদে তাঁদের দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা থাকতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ করেও যারা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনার রাজনীতিতে যুক্ত হন, মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা বিরোধী কর্মে লিপ্ত হয়ে দেশ ও মানুষের বিপক্ষে দাঁড়ান তারা মুক্তিযোদ্ধা থাকেন কি করে?

 

 

ভুল-ত্রুটি থাকলেও দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা রয়েছে। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সহায়তা পেয়ে থাকেন। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য পঞ্চাশ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের কোন তালিকা এখানে তৈরী করা যায় নি। শহিদ পরিবারগুলো সরকার বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন সহায়তা পায় না।

 

 

বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের এত এত প্রতিশ্রুতির জোয়ার ওঠলেও জোয়ারের সে ঢেউ পঞ্চাশ বছরেও বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর পাড়ে শহিদদের গ্রাম বক্তাবলীতে এসে আঘাত করেনি। এ এক নির্মম বাস্তবতা। রফিউর রাব্বি : লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর