শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

উত্তর দক্ষিণ

প্রকাশিত: ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

পর্ব : ৭ 

হাসপাতালে এর মধ্যে তিন দিন কেটে যায়। প্রতিদিন সকালে ডাক্তার আসেন দলবলে। তাঁরা কত কিছু নিয়ে আলোচনা করেন। তার কিছু বুঝি বাকি অনেকাংশ দুর্বোধ্য মনে হয়। যেটুকু বুঝি তাতে মন খারাপ হয়ে যায়। আর যেটুকু বোধগম্য হয় না সেখানে আশা জাগে।

 

চতুর্থ দিন সকালে ডা.শফিউল আলম ফেরদৌস ভাইয়ের ফোন- জামাল, কত নম্বর কেবিনে সীমা আছেন ? আমি জানালাম ৮১১। তিনি বললেন- আমি আসছি। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি চলে আসেন। সাথে নিয়ে আসেন প্রফেসর ডা. আনোয়ার স্যারকে। আনোয়ার স্যার ফেরদৌস ভাইয়ের সহপাঠি। তাঁরা একসাথে সিলেট মেডিকেল কলেজে পড়েছেন। আনোয়ার স্যার বিভাগীয় প্রধান, সার্জারি, অঙ্কোলজি। আনোয়ার স্যার ফেরদৌস ভাই দুজনে সীমার ফাইল নিয়ে বেশ কিছু সময় দেখলেন। তাঁরা দুজনে বেশ চিন্তিত মুখে কেবিন থেকে বের হয়ে এলেন। আমিও তাদের পিছনে পিছনে যাই। যাবার সময় দেখি সীমা করুণ ভাবে তাকিয়ে আছে। তার দ্রুত জানার উৎসুক কী বলেন তাঁরা। আমি ইশারা করি তোমার ভয় নেই, আমি আছি। তোমার কিছু হবে না।

 

আনোয়ার স্যার তখন চিকুনগুনিয়া জ্বরে ভুগছিলেন এবং তিনি তখন ছুটিতে ছিলেন। ফেরদৌস ভাই তাঁকে বাসা থেকে ডেকে আনেন। স্যার ব্যথায় ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিলেন না। তারপরেও ফেরদৌস ভাই আর আনোয়ার স্যার কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট সময় দিলেন। বিদায় নেয়ার পূর্বে আনোয়ার স্যার বললেন- রোগীর অবস্থা ভালো নয়। ফেরদৌস ভাই ইংরেজিতে বললেন- আমি তাদের আগেই জানিয়েছি।

 

ফেরদৌস ভাই আনোয়ার স্যারকে বিদায় দিয়ে এসে বললেন- এই হাসপাতালের ডিরেক্টর প্রফেসর ডা. মোয়ারফ হোসেন আমার অনুজ। এক সময় ঢাকা কলেজে আমার রুমমেট ছিলো। আমি তাঁর সাথে কথা বলে যাচ্ছি। যাবার আগে ফেরদৌস ভাই পুনরায় কেবিনে এসে সীমাকে বললেন- আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন।

 

ফেরদৌস ভাইকে লিফট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যাই। তিনি এখন যাবেন পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলায় ডিরেক্টর স্যারের রুমে। খুব ব্যস্ত মানুষ ফেরদৌস ভাই, খানপুর হাসপাতালের দায়িত্বে আছেন। প্রতিদিনই বেশ কিছু অপারেশন করতে হয়। সন্ধ্যায় বসেন চেম্বারে। রাত অবধি চলে রোগী দেখা। চিকিৎসক টাকা কামান। কিছু মানুষ শুধু ওইটুকু দেখে। কিন্তু যে সময় রোগী দেখাতে ব্যয় হয়। বা দেখতে বাধ্য হোন তাতে করে নিজেদের জীবনে ততটা আনন্দ থাকে বলে আমার মনে হয় না। এদেশে দিনরাত রোগী না দেখলেওতো চলে না। প্রতি ছয় হাজারে একজন ডাক্তার! তার মানে? অন্যদিকে নানা দূষণে এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

 

বিপদে মানুষের সহায়তা প্রয়োজন পড়ে। যে কোনো মানুষের বেলায়ই এ প্রয়োজনটুকু কখনও খুব জরুরি হয়ে পরে। নতুবা এর চেয়ে অসহায় সময় আর কিছু হতে পারে না। আর যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কেউ চলে যায়। তখন এ দাবি হয়ে ওঠে মূখ্য।

 

আমাদের জীবনে যখন ক্রান্তিকাল আসে তখন হাতে গোনা কিছু আপনজন সময়মতো কাছে পাওয়া যায়। দেখছি সবাই পারে না সঠিক সময় বিপদে সাহস দিতে। সকলে অর্থে না পারুক সামান্য কথায় বড় সান্তনাতো দেয়া যায়। সেটুকু দিতেও অনেকে কার্পণ্য করে। যদি বেশি বেশি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ফেঁসে যায়। অন্যদিকে তারা হয়তো ভুলে যায় একদিন তাদেরও এমন হতে পারে।

 

আমি এ বিপদে যাকে সর্বপ্রথম কাছে পেয়েছি সে আমার বন্ধু শাহাব। শাহাব আহমেদ। সে একজন ডাক্তার, লেখক। সবার উপর সে একজন নরম মনের মানুষ। তারপর ছোটো ভাই ময়েন। মাঈন উদ্দিন আহমেদ। যুগ্ম স্বাস্থ্য সচিব।

 

খুব সকালে যখন মোল্লা ভবন থেকে শাহাবকে আমি মেইল করি। তখন চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম। খুব আপন মানুষের সাথে কথা বললে যেভাবে নিজেকে আবেগ তাড়িত করে। ঠিক সেভাবেই মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে শাহাব সারা দেয়। চিকিৎসার প্রারম্ভিক বিষয়াদি শুরু হয়ে যায় তখনই। বিপদে এই যে কাউকে তড়িৎ পাশে পাওয়া তা কারোর জন্য বেঁচে থাকার বড় অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। 


এই ছোট্ট জীবনে মানুষ কতটুকুই আর ভালো থাকে? কয়েক মুহূর্ত যদি কেউ দিয়ে যায় সেটাই কম কি? আমি সব সময় মনে করি আমার ভাগ্য খারাপ। না, কিছ্ ুক্ষেত্রে আমার ভাগ্য অনেকের চেয়ে অনেকগুণে ভালো। অনেক মানুষের প্রচুর টাকা আছে। কিন্তু তারা মানবিক নয়। তারা টাকার পাহাড় গড়ে রেখেছে ঠিক। কিন্তু দেখলামতো বহু ভালোবাসা খুব কম সময়েই তাদের নসীব হয়। তারা একান্ত নিজেদের মধ্যে নিজেদের গণ্ডিতেই আবদ্ধ।

 

রাতের খাবার আজ কিছুটা আগে খেয়ে দেয়ে আমরা দুজন এখন কেবিনে শুয়ে আছি। ঘুম নেই দুজনের কারোর চোখে। তেমন কথাও খুঁজে পাই না যে বলা যায়। এই কেবিনটিতে সবই আছে নেই একটি টিভি ও একটি ফ্রিজ। যেহেতু ভিআইপি কেবিন সেহেতু থাকা উচিত ছিলো। আমি কথা বলি সীমার সাথে প্রচুর। সে-ও মুগ্ধ হয়ে শোনে। বিগত বেশ কিছু বছর কাজের মধ্যেই ডুবে ছিলাম। না এইকুল হলো না ওইকুল পেলাম! তখন কথা বলার সময় কোথায়। খরচ জোগাড় করতে করতেই জীবন যায়। আশা করি সামনে সময় হবে। নসীবে থাকতে হবে। তার মধ্যে কিছু মানুষতো থাকে প্রতিনিয়ত রাস্তা বড় করে রাখার। কাউকে কিছু বলবো না। শুধু বলি এইটুকু অযথা লোভে পড়ে বা অকারণে কারোর দীর্ঘ শ্বাসের কারণ হবেন না। এর থেকে বাঁচার রাস্তা পাওয়া যায় না। এই দুঃসহ সময়ে অদূর ভবিষ্যতের বড় দুর্ভাবনা মাথায় আসার পরও সব দিয়ে দিলাম। 

 

এখন সীমাকে যতটা সময় দেয়া যায়। যতটা কথা বলা যায়। তাই কত কথা সব খুঁজে খুঁজে বলতে থাকি। তবে সে সব কিছুর মধ্যে সে আশ্বাস চায়। বেঁচে থাকার আশ্বাস। আমিও ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি। এর মধ্যে রয়েছে চরম অর্থ সংকট। চিকিৎসা এবং অর্থের জোগান কীভাবে হবে এই রকম একাধিক ভয় কাজ করছে বর্তমানে। সীমার শরীরে ক্যান্সারের উপস্থিতি শোনার পর থেকে আমারও নিজের ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর শীতলতা অনুভব হয়। ক্যান্সার রোগটি এমনই। নিরাময় অযোগ্য হয়ে গেলে মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর কষ্ট দিতে থাকে অবিরাম। ওই ঘরের প্রতিটি সদস্য কবরের নিস্তব্ধতায় চলে যায়। সারাক্ষণ মনের মধ্যে শঙ্কা জেগে থাকে এই বুঝি চরম বিপর্যয় নেমে এলো।

 

সীমা আজ খুব চুপচাপ সময় কাটায়। আমি এক মুহূর্তের জন্যও তাকে চোখের আড়াল করি না। কি যে চাপা এক কষ্ট সে ভোগ করছে তা ভাষায় প্রকাশ করার যোগ্যতা আমার নেই। তার অসহায় স্থির দৃষ্টিতে যে বেঁচে থাকার আকুলতা হৃদয়ের গোপনতম কুঠুরিতে গিয়ে আঘাত করে। বার বার আঘাত করে। আমার মনে হয় আমি মরে গেলে ক্ষতি নেই। সে বেঁচে থাকুক। মরতে সবারই হবে। তার কোথাও ব্যত্যয় নেই। কিন্তু প্রিয়জনের মৃত্যু তার আগে কেউ কামনা করে না। প্রিয়জনের শব বহন করার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই থাকে। তারপরেও কখনও বহন করতে হয়। সে বহন করার সময় ভিতরে যে ভাঙন দেখা দেয় তা সবাই দেখতে পায় না। নদীর পাড় ভাঙার মতো কোনোদিন সে স্থলে ভূমি আর জাগে না। এই ভগ্ন হৃদয়ে তার বাকি জীবন কাটাতে হয়।

 

সীমার সাথে আমার পরিচয় পর্বটি বেশ মধুর। ওরা তখন সবে আইন কলেজে এসেছে। ওর মামা আর আমি একই স্কুলে পড়ি। আবার আমরা সহপাঠি। বন্ধুটি ক্লাসে বেশ চুপচাপ থাকে। পোশাকে আশাকে সব সময় বেশ ভদ্র মার্জিত। কয়েকটি কারণে তার প্রতি আমার দৃষ্টি পড়ে। সবাই কমবেশি তার প্রতি অনুরক্ত। ভদ্রতা, নিরুত্তাপ, আপন মনে বসে থাকা। নিজের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। আমার যে কারণ খুব বেশি নজর কাড়ে তাহলো তার দুটি স্বরে কথা বলা। কথা বলতে বলতে শেষের দিকে চিকন মিহি স্বর চলে আসা। 

 

যদিও পরের দিকে সেই অভ্যাস আর তার ছিলো না। তার আগে ওর দেখাদেখি আমিও কিছুদিন প্র্যাকটিস করেছিলাম এবং হয়েও গিয়েছিলো। একদিন আব্বার সাংঘাতিক রাগারাগিতে আমার পরবর্তি স্বরটি একেবারে না বলে কয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার আরও তিনটি গুণ ছিলো-অসম্ভব সুন্দর হাতের লেখা, হাওয়াইন গিটার বাজানো আর নিখুঁত ছবি আঁকা। সে ক্লাসে কাঠ পেন্সিল দিয়ে লিখতো। গুটি গুটি তার লেখাগুলো যেনো সাদা কাগজের স্বচ্ছ দীঘিতে অপরূপ পাশাপাশি জলকেলি করে!

 

আমি ক্লাসে নন ফেস। ভালো ছাত্র হিসেবে কিন্তু নয়। স্যারদের বিশেষ খেয়ালের বশবর্তিতে। আমার এক চাচা ছিলেন ওই স্কুলের শিক্ষক। আমার বড় চাচা ছিলেন তখন শহরে বেশ দাপটে মানুষ। হয়তো তাদের বলার কারণে আমার উপর আলাদা নজর রাখতেন। তাই প্রায়ই আমার সর্বাঙ্গে স্যারদের বেতের চিহ্ন বাসায় নিয়ে যাই। আমি নিয়ত জর্জরিত হই। এই স্যারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যিনি আমার গৃহশিক্ষকও, তিনি সবার পরিচিত সিদ্দিক স্যার। একদিন সিদ্দিক স্যার ক্লাসে এমন মারলেন যে আমি প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলাম, এরপর কখনও আর লেখা পড়া করবো না। 

 

কিরণ স্যারের মারের কথাতো ইতিহাস। প্রথমে আমার জ্বর হলো। তারপর অনেকটা অচেতন হয়ে পড়লাম। এর নিয়ে পরবর্তিতে স্কুলে বহু ঘটনা ঘটে যায়। বাবু কিরণ চন্দ্র স্যারের সে মার কিন্তু পড়াশুনার জন্য ছিলো না। আমি কোনো প্রকারেই সেদিন দোষী ছিলাম না। তার পরেও কঠিন মার পরে। নিরুদ'দার হাতে তৈরি দুটি বেত তিনি সেদিন আমার পিঠে ভাঙতে সমর্থ হোন। এমনি বহুকারণে শুধু ক্লাসে নয় পুরো স্কুলে আমি বেশ পরিচিত মুখ।


একদিন সেই বহু গুনে গুনান্বিত লাজুক বন্ধুটিকে দেখি মিশনপাড়ার মোড়ে। তাকে দেখেই ভীষণ আনন্দে জিজ্ঞাসা করি- তুই এখানে? তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটু হাসি দিয়ে বলে- এইতো আমরা এখন এখানে চলে এসেছি। ও হাত দিয়ে ইশারা করে আইন কলেজের সামনে দোতলা টিনের বাসাটি দেখায়। গ্রাম থেকে আসার পর আমার এই বাড়িটি ছিলো খুব প্রিয়। আমি প্রায়ই এই বাড়িটির দিকে খেয়াল করেছি। 

 

কারণ, নান্দনিক দোতলা টিনের বাড়ি। তার ভিতর বড় ঘন পত্রপল্লবিত একটি আম গাছ। অনেকটা বিশালাকৃতির খোলা ছাতার মতো পুরো বাড়িটি ছায়া দিয়ে রেখেছে। এই অনুভূতি একটু অন্যরকম। আমি খাঁটি গ্রামের মানুষ। জন্ম  গ্রামে। বাল্যকালের অনেকটা সময় কেটেছে গ্রামে। শহরে এমন কোথায় টিনের ঘর আম গাছ মিল রেখে বাড়ি দেখা যায়। আমার খুব ভালো লাগে এই বাড়িটি। সীমার প্রেমে পড়ার বহু আগে আমি এই বাড়িটির প্রেমে পড়ি।

 

বন্ধুটি যাবার আগে বলে যায়- বাসায় আসিস। আমার বাসা থেকে মাত্র দুই তিন মিনিটের পথ। তার উপর বন্ধুর আহ্বানে বন্ধু যাবে না? তাছাড়া এই বাড়ির উপর আমার পূর্ব থেকেই ভালোলাগা রয়েছে যেখানে। সময় করে অবসরের একদিন বন্ধুটির বাসায় যাই। সে-ও ঘরে নিয়ে বসায়। ঘরে তারা পিঠাপিঠি পাঁচজন। তাদের মধ্যে দুজন মামা ভাগ্নে। আর তিন জনের মধ্যে একজন খালা আর বাকি ভাগ্নিদ্বয়। 

 

ওই শেষের তিনজনের মধ্যে দুজন ছিলো অত্যাধিক হাসিখুশি। দুষ্টমিতেও কম যেতো না। তাদের মধ্যে একজনের হাসি ছিলো ভূবনমোহনী। কিন্তু সীমা ছিলো সব সময় চুপচাপ। অন্তত আমার সামনে দেখেছি। শুধু তার অচঞ্চল বড় বড় চোখে সব কিছু নিয়ে অপার বিস্ময়। 

 

বন্ধুটির মা ছিলেন অসম্ভব একজন সংসারী মানুষ। শত কাজের পরও তিনি বেশ পরিপাটি থাকতেন। নামাজ রোজা কোরআন পড়া এই নিয়ে তার বাকি সময় কাটে। আমার খুব ভালো লাগে। তিনি আমাকে খেতে বলেন। আমি খাই। আমাকে খেতে আসতে বলেন। আমি সময় মতো হাজির হয়ে যাই। আমি ভাবি না আমাকে শুধু কি বলার জন্য বলেছেন। নাকি আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ছিলো সে ডাক। আমি সহজ সরল গ্রামের মানুষ। আমার তাঁর ভালোবাসাটুকুই নজর কাড়ে।

 

এক সময় বহু খেয়েছি ওই বাড়িতে। দিনে রাতে কিংবা স্পেশাল কোনোদিনে। আমি প্রথম চাইনিজ খাবার খাই রেঁস্তোরায় বসে তাদের সাথে। তাদের সাথেই আমি মজা করে বড় প্লেটে হরেক রকম ফলসহ আইসক্রিম খেয়েছি তোপখানা রোডের ইগলু আইসক্রিমের দোকানে বসে। ছবি দেখেছি মধুমিতায়, অভিসারে একসাথে। কি আনন্দ ছিলো তখন! বারদি থেকে এসে প্রথম যাদের সান্নিধ্যে আধুনিকতার স্বাদ পেয়ে থাকি তবে তা পেয়েছি সীমাদের বাড়ি থেকে। ওরা সবাই আধুনিক মন-মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা শহরে মানুষ। শিল্প সংস্কৃতি কি ছিলো না তাদের অঙ্গনে! আমি দিন দিন অভিভূত হয়ে রয়েছি!

 

ভাবনাগুলো আজ সব এলোমেলো। ঘুম আসছে না। কঠিন অসুখ তার কি হতে পারে। এখন আমার করণীয় কী? কোনো কি মিরাকল ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই? তা আমি খুঁজতে থাকি। পর্যাপ্ত টাকা থাকলে অনেক কিছুই করা যেতো। বহু জায়গায় নিয়ে যাওযা যেতো। ফাঁকে ফাঁকে দর্শনীয়, তীর্থ স্থানগুলোতে নিয়ে যাওয়া যেতো। প্রতিটি সময় বিপুল আনন্দে ভরে রাখা যেতো। কোথায় টাকা পাবো? একেবারে নিঃস্ব ও নিঃস্বঙ্গতায় জীবন কাটলো। আামর প্রচুর আছে এই ভেবে তারা দূরে সরে গেলো! সব মিথ্যে। সব মিথ্যে। সুযোগ সন্ধানী কয়েকজন অতি নিম্নশ্রেণি মূর্খ ব্যক্তিদের প্রভাগাণ্ডা তাদের আমি সরাসরি ঘৃণা করি। তারাও আমার উপর চড়াও থাকে সর্বক্ষণ।

 

সীমা বোধহ ঘুমিয়ে আছে। অনেকক্ষণ সারা-শব্দ নেই। সীমার মুখটা দেখার জন্য খুব আস্তে আস্তে এসে ওর বেডের সামনে এসে দাঁড়াই। এখানে পাশেই সময় কাটাবো বলে নিঃশব্দে সিটার টেনে কাছে বসি। ও ঘুমিয়ে আছে। গভীর ঘুম। শান্ত মুখ। মনে হয় না এই মুহূর্তে তার কোনো দুশ্চিন্তা রয়েছে।

 

সীমা যেদিন আমার পাশে প্রথম শুয়ে ঘুমিয়েছিলো। ঘুম থকে ওঠেই অবাক ও আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। বড় বড় চোখ মেলে তাকায়। এমনিতেই তার বড় চোখ। তার উপর বিস্ময়মাখা দৃষ্টি তাকে আরও অপরূপ করে তোলে। এরপর নিঃশব্দে তার কপালে এক হাত রেখে দুচোখ ঢাকে। অন্যহাত অনেকক্ষণ আমার হাত ধরে রেখেছিলো। কিছু বলে নি তখন। কোনো কথা নয়। একটি শব্দও নয়। একটু পর বুঝলাম সে কাঁদছে। হাতে ঢাকা দুটি চোখ আনন্দে অশ্রু বিসর্জন করছে। সংগোপনে তার ধারা গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে বিছানায়। আমি বুঝে নেই তার প্রতিটি মনের কথা।

 

ওর সাথে আমার প্রতিটিক্ষণ প্রতিটি স্মৃতি জ্বলজ্বল করে। ক’জন বুঝবে এই ভালোবাসার মর্ম। ক'জনে বুঝবে আমার ভিতরের অভিমান। ক’জন জীবনের স্বল্পতম আনন্দ সম্পূর্ণ ভোগ করতে পারে। তারা জানে কি ভালোবাসা কারে কয়। আজ পুরানো বহু স্মৃতি আমার হৃদয়ে পুনরায় জেগে ওঠে অতি উজ্জ্বলিত হয়ে। সীমার সরল সুন্দর মুখশ্রীর মাঝে সকল স্মৃতি, সকল আনন্দ বার বার জেগে ওঠে। খুব ইচ্ছে করে এখন ওর হাতটা ধরি। ও জেগে ওঠতে পারে তাই মনের আহ্লাদটুক সাবধানে সংবরণ করি।

 

ঠিক তখনই দরজায় কারোর নক শোনা যায়। শব্দটা খুব আস্তে। মনে হয় যিনি নক করছেন তিনি দ্বিতীয়দফা নক করবেন না। বিষয়টা এমন ঘুমিয়ে না থাকলে তারা দরজা খুলবে। আর ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের কাঁচা ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। যারা দরজা বাহিরে আছেন বুঝতে অসুবিধা হয় না তারা খুব সুশিক্ষিত এবং সাবধানী। তবে সীমার এই সামান্য আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলেই অস্থির হয়ে ডাকে- জামাল। আমি সীমার হাতটা ধরি। বলি আমি এই যে। সে বলে তাড়াতাড়ি দরজা খুলো, দেখো কে এসেছেন। বললাম, দরজা খুলতেই যাচ্ছি। তুমি হঠাৎ এতো টেনশন নিও না। আমি আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলছি। দরজা খুলেই আমি অবাক হয়ে দেখি হাসপাতালের ডিরেক্টর স্যার সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর সাথে একজন জুনিয়র ডাক্তার।

 

প্রফেসর ডাক্তার মোয়ারফ হোসেন। প্রথমদিন যিনি সীমাকে দেখেছেন। তিনি আজ আবার দেখতে এসেছেন। বিগত কয়েক দিন তিনি আসতে না পারলেও সব খবরাখবর রেখেছেন। খুবই ব্যস্ত মানুষ তিনি। দিনে সময় করতে পারেন নি বলে রাতে দেখতে এসেছেন। সীমা তাঁকে দেখে বেশ খুশি। কিছু মানুষের মুখ দেখলেই খুব ভালো লাগে। ভরসা জাগে। তেমনি মানুষ একজন মোয়ারফ স্যার। তিনি সীমাকে আবার দেখলেন। আমরা খাবার খেয়েছি কি না জানতে চাইলেন। বিশেষ করে সীমা কতটুকু খাবার খেয়েছে তা ভালো করে জানতে চাইলেন। তাকে বেশি করে খাবার দিতে হবে বললেন। সীমার ওজন বাড়াতে হবে শীঘ্রই। সামনে টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা সমস্ত রিপোর্টে চোখ বুলালেন। এটাও বললেন আমি সব জানি। আমরা শীঘ্রই ব্যবস্থা নিচ্ছি।

 

যাবার আগে মোয়ারফ স্যার বলে গেলেন আজ সিনিয়র কনসালটেন্ড ডা.শফিউল আলম ফেরদৌস এসেছিলেন। ফেরদৌস, আমি ঢাকা কলেজে পড়াশোনার সময় রুমমেট ছিলাম। আপনাদের সম্পর্কে বলে গেছেন- নারায়ণগঞ্জে আপনারা বুটিক হাউজ চালান। শিল্পমনা মানুষ আপনারা। শহরে যথেষ্ট সুনাম আপনাদের। সব শুনে সীমার চোখদুটু আনন্দে চক চক করে ওঠে! (চলবে...)

 

এটিএম জামাল
সোনারাগাঁ ভবন, মিশনপাড়া, নারায়ণগঞ্জ
১৮ আগস্ট, ২০১৯

এই বিভাগের আরো খবর