বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

একজন ‘অসাধারণ’ মুন্নার জন্য হাহাকার

যুগেরচিন্তা ডেস্ক

প্রকাশিত: ৯ জুন ২০২১  

সুনীল ছেত্রীকে নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। দেশের হয়ে ১১৬ ম্যাচ খেলে ৭৪ গোল-আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোলের সংখ্যায় তিনি ছাড়িয়ে গেছেন লিওনেল মেসিকে; তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাস তো থাকবেই। মেসিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্যে যাঁদের গাত্রদাহ কোথায় আর্জেন্টিনা, কোথায় ভারতজাতীয় কথাবার্তা যাঁরা বলছেন, তাঁদের জন্য সমবেদনা ছাড়া আর কীই–বা করার থাকে! দেশের হয়ে ৭৪ গোল করা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। যে খেলোয়াড় সেই অসাধারণত্বকে ধারণ করেন, তিনি আর যাই হোক, সাধারণ কেউ নন। এই ‘সাধারণ’ আর ‘অসাধারণে’ যে ফারাক, সেটিই যে গত পরশু রাতে বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমিদের সামনে পরিষ্কার করে দিয়েছেন ছেত্রী।

 

সাধারণ ফুটবলারের সঙ্গে অসাধারণ প্রতিভাবান বা নিজেকে অসাধারণ বানিয়ে তোলা একজন ফুটবলারের যে পার্থক্য, সেটি নিয়ে ভাবতে গিয়েই আজ দিনপঞ্জির পাতায় চোখ আটকে গেল ৯ জুন। অন্ত্যত বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমিদের কাছে আজকের দিনটি বিশেষ। ৫৭ বছর আগে এই ৯ জুনেই আমরা পেয়েছিলাম এমন একজনকে, যিনি পরে নিজেকে ‘অসাধারণ’ ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশের ফুটবলে ‘অসাধারণ’ প্রতিভার যখন আকাল, বছরের পর বছর ধরে আমরা যখন হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছি তেমন কাউকে, তখন ৯ জুন বাড়িয়ে দেয় সেই হাহাকারকে।

 

আজ মোনেম মুন্নার জন্মদিন। ১৬ বছর আগে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলে তিনি আজও প্রাসঙ্গিক। একজন ফুটবলার হিসেবে তিনি নিজেকে দেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরাদের কাতারেই বসিয়ে গেছেন। কী খেলায়, কী চলনে-বলনে, তিনি আজও অদ্বিতীয় এক তারকা। অনেকে বলতে পারেন, পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে কী লাভ! মোনেম মুন্না দারুণ খেলোয়াড় ছিলেন, তিনি অবসরে গিয়েছেন ১৯৯৭ সালে। পৃথিবী ছেড়েছেন ২০০৫ সালে, এরপর তাঁর মতো কারও আবির্ভাব তো ঘটেনি দেশের ফুটবলে তাহলে বারবার মোনেম মুন্নাকে টেনে আনার কী দরকার!

 

এত বছরে বাংলাদেশের ফুটবল কেন মোনেম মুন্নাদের মতো কাউকে দেখেনি, কেবল সে কারণেই তাঁদের নিয়ে আলোচনা হওয়াটা বেশি প্রয়োজন।ওই যে শুরুতে ‘সাধারণ’ ও ‘অসাধারণ’ ফুটবলারের ফারাকের কথা বলা হলো, বাংলাদেশের ফুটবলে যে ‘অসাধারণ’ কারও অভাব নিয়ে আক্ষেপ হলো, মোনেম মুন্নাকে নিয়ে ‘চর্বিত-চর্বন’ কিংবা যা-ই বলুন স্মৃতির সরণি বেয়ে আলোচনাটা করা যেতে পারে কেবল সে কারণেই।

 

মুন্না কী ছিলেন, কত বড় মাপের ফুটবলার ছিলেন, সেটি নিয়ে আলোচনা অনেক আছে। কেউ কেউ বলতে পারেন, মুন্নারা বাংলাদেশের ফুটবলকে কী দিয়েছিলেন? পরিসংখ্যান ঘেঁটে বের করতে পারেন, মুন্নাদের সময় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের বিভিন্ন খেলার ফল। জিজ্ঞেস করতে পারেন, এই মুন্নারা তো বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশীয় পর্যায়েও সাফল্য এনে দিতে পারেননি, তাহলে?

 

এসব কথাবার্তার মধ্যেও ফিরে যেতে হয় পুরোনো যুক্তিতেই। এই মুন্না যখন খেলতেন, তখন অন্ত্যত প্রতিপক্ষ আলাদা করে তাঁকে নিয়ে ভাবত। মুন্নার উপস্থিতি আতঙ্ক তৈরি করত প্রতিপক্ষের শিবিরে, রক্ষণে বা মাঠে মুন্নার উপস্থিতি আলাদা করে ভরসা জোগাত। নাহ্, আমাদের কেউ একজন আছেন! তিনি সাফল্য এনে দিতে পেরেছিলেন, নাকি পারেননি, সে হিসাব তো আলাদা, আলোচনাটাও ভিন্ন।

 

আজ থেকে অনেক বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলকে প্রশিক্ষণ দিতে এসেছিলেন জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। ফুটবল দুনিয়ায় এই কোচের খুব নামডাক। তিনি বাংলাদেশে আসার আগে নব্বই দশকের শুরুতে ঘানার মতো দরিদ্র দেশকে বিশ্ব যুব ফুটবলের শিরোপা জেতান। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর সৌদি আরবকে বিশ্বকাপে নিয়ে গেছেন। বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নপূরণ করেছিলেন টোগোর মতো দেশেরও। আফগানিস্তানের মতো দেশ, তাঁকে পেয়ে দূর লক্ষ্যের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু এই কোচ বাংলাদেশে দুই বছর মেয়াদে বেশির ভাগ সময়ই বসে কাটিয়েছিলেন।

 

১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতি প্রতিযোগীতায় শিরোপা জেতানো ছাড়া বাংলাদেশকে তিনি এনে দিতে পারেননি বড় কোনো সাফল্য। সেই ফিস্টার মুন্নাকে নিয়ে ছিলেন উচ্ছ¡সিত। ফিস্টার-মুন্না জুটির রসায়ন জমে উঠেছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তারাও ব্যর্থ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যও কম ছিল না। কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই ফিস্টার মোনেম মুন্না প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘মুন্না ছিল মনে রাখার মতো একজন খেলোয়াড় ও নেতা। তাঁর জায়গা আমার হৃদয়ে সব সময় থাকবে।’

 

কেবল ফিস্টার কেন মোনেম মুন্নার জায়গা বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমিদের হৃদয়েও সব সময় অটুটই থাকবে। আজ জন্মদিনে তাঁকে আরও বেশি করেই মনে পড়বে। মোনেম মুন্নার মতো অসাধারণ তারকাদের যে খুঁজে ফেরে বাংলাদেশের ফুটবল।

(প্রথমআলো থেকে নেয়া) লেখক- নাইর ইকবাল 
 

এই বিভাগের আরো খবর