মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ঔষধ কোম্পানির এমআরদের নিয়ন্ত্রণে ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২  

 

#  ক্ষুন্ন হচ্ছে রোগীর গোপনীয়তা
#  নিয়ম অমান্য করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে : সিভিল সার্জন

 

মধ্যবয়সী হতদরিদ্র রহিমা বেগম তার ছেলের অসুস্থতার কারণে প্রতিবেশির থেকে টাকা ধার করে আসলেন স্বনামধন্য এক হাসপাতালে। ডাক্তার দেখানোর পর তার প্রেসক্রিপশনে লেখা হয় এক গাদা ঔষধ। তা খাওয়ার পর ও তেমন কোনো ফল না পাওয়ায় তিনি চলে যান ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে ডাক্তার তার এক গাদা ঔষধ এর পরিবর্তে লিখে দেন মাত্র ২টা ঔষধ। যা খাওয়ার পর সুস্থ হয়ে যান রহিমা বেগমের ছেলে। এমন গল্প শুধু রহিমা বেগমের ই নয়। এমন গল্প লাখো পরিবারে কান পাতলেই শোনা যায় অহরহ। কেউ টাকা ধার নিয়ে চিকিৎসকদের শরনাপন্ন হন। কেউ তার জমানো সঞ্চয় নিয়ে কেউবা টাকা সুদে নিয়ে এসে পর্যন্ত তার প্রিয় মানুষটাকে চিকিৎসা করাচ্ছেন। কিন্তু কতিপয় ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারিতায় এবং অসদুপায়  অবলম্বনের ফলে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে।

 

অভিযোগ আছে, মাসোহারার লোভ দেখিয়ে রোগীর প্রেসক্রিপশন এ নিজের কোম্পানির ঔষধ লিখতে বাধ্য করেন কতিপয় ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। যে ডাক্তার যত বেশি ঔষধ লিখবে তার মাসোহারা পাওয়ার লিষ্ট তত বড়। নিজ নিজ ব্রান্ডের ঔষধ লিখতে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয় কতিপয় ডাক্তারদের পিছনে। এই লোভে কতিপয় ডাক্তার নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অনেকসময় অপ্রয়োজনীয় ও তুলনামূলক কম কার্যকর ঔষধ লিখে দেন। এতে করে বেশি দাম ও কম কার্যকর ঔষধ দুই দিক দিয়েই প্রতারিত হচ্ছে ভোক্তা। যথাযথ চিকিৎসা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসাসেবা প্রত্যাশীরা। চরম অস্বস্তিতে পরছেন দুস্থ্য রোগীরা। যে ডাক্তাররের রোগী বেশি তার মাসোহারার পরিমান ও বেশি।

 

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে শহরের ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের আঙিনায় ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের আনাগোনাই যথেষ্ট। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত  ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের দৌড়াত্ব পরিলক্ষিত হয়।কোনো কোনো হাসপাতাল নোটিশ আকারে লিখে দেয় ডাক্তারদের সাথে বিক্রয় প্রতিনিধিদের সাক্ষাত এর সময়। শুধু মাত্র বেসরকারি হাসপাতাল নয়। সরকারি হাসপাতাল গুলোতেও চলে মাসোহারার রমরমা বাণিজ্য। বিক্রয় প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্যে ভোগান্তী পোহাতে হয় রোগী ও তার স্বজনদের।

 

তামান্না নামের এক রোগীর স্বজন জানান, ডাক্তার এর চেম্বার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে একদল বিক্রয় প্রতিনিধি ঘিরে ধরে তাদের। তারপর তাদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে তারা। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছবি তুলতে দিতে বাধ্য হন তারা। তিনি এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন এহেন কর্মকান্ডের ফলে রোগীর গোপনীয়তা সম্পূর্নভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি এসব বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন।

 

তিনি আরোও জানান বিক্রয় প্রতিনিধিদের ছবি তোলার পিছনের কারণ হলো তারা দেখেন ডাক্তার তাদের কোম্পানীর ঔষধ লিখেছেন কিনা। ডাক্তারও আগেই তাদের ঔষধ কোম্পানির ফাদে পা দিয়ে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তাদের কোম্পানীর ঔষধ লিখতে বাধ্য হন।

 

এ বিষয়ে এক সনামধন্য ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধির সাথে কথা বললে তিনি নাম প্রকাশ করার শর্তে জানান তারা আসলে ঔষধ কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে ডাক্তারদের সাথে ডিল করেন যে ডাক্তার তার কোম্পানির ঔষধ টি প্রেসক্রিপশনে লিখবেন । এর বিনিময়ে তিনি মাসে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা পাবেন। তিনি আরোও জানান, এই টাকার পরিমান মাসে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পরিমান লাখের গন্ডি ও পার করে।

 

যার যত বেশি রোগী সে তত বেশি টাকা নেন এর জন্য। কোনো কোনো ডাক্তার আবার নিজ থেকেই এমন প্রতিনিধিদের সাথে ডিল করে থাকেন। তবে প্রতিনিধি নিজ থেকে ডিল করুক বা ডাক্তার নিজ থেকে ডিল করুক, যেই করুক না কেনো এটা যে নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এর ফলে চিকিৎসা প্রার্থীরা যেমন যথোপযুক্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না তেমনিভাবে চিকিৎসা ব্যয় ও বহুগুন বেড়ে  যাচ্ছে।  

 

স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে এক বিষ্ময়কর তথ্য সামনে আসে। সেখানে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এর এক গবেষনায় দেখা গেছে অতিরিক্ত এ ব্যয়ের কারনে দেশে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত থাকছেন অন্তত ১৬ শতাংশ রোগী।

 

দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া ৯৭ ভাগ রোগীই ঔষধ পান না হাসপাতাল থেকে। তাদের প্রয়োজনীয় ঔষধ কিনতে হয় বাহিরের ফার্মেসি থেকে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই মাসোহারার রমরমা বানিজ্যের পশরা সাজিয়ে বসেছে ডাক্তার ও ঔষধ কোম্পানিগুলো। ঔষধ কোম্পানির ৫৮ ভাগ জনবলই মার্কেটিং এ কাজ করে। ঔষধ কোম্পানির ২৭ ভাগ আয় খরচ করা হয় মার্কেটিং এ নিযুক্ত কর্মীদের পিছনে। ডাক্তারদের মাসোহারার চাহিদা দিন বাড়ার ফলে ঔষধ কোম্পানিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ঔষধের দাম বৃদ্ধি করে দিয়েছে। এর পিছনে কোম্পানিগুলোর যুক্তি হলো কাচামাল এর দাম বৃদ্ধি। তবে এর আসল কারণ যে মাসোহারার পরিমান বৃদ্ধি তা কারো অজানা নয়।

 

ঔষধ কোম্পানিগুলোর এমন আক্রমনাত্মক কালো থাবা থেকে নারায়নগঞ্জবাসীর রক্ষা কবচের ব্যাপারে সিভিল সার্জনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিজি মহোদয়ের যে আইন আছে তাতে সপ্তাহে ২ দিন ১ ঘন্টা করে ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সাথে ডাক্তারদের সাক্ষাৎ এর সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি নারায়নগঞ্জে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে শুধুমাত্র প্রতি মঙ্গলবার ১২ টা থেকে ১ টা ভিজিট করার টাইম নির্ধারন করে দিয়েছি। এই সময়সীমা এখানে মান্য করা হয়। কেউ জদি গোপনে ডুকে অথবা কোনো ডাক্তার জদি কাউকে প্রশ্রয় দেয় এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে এর বাইরে কারো একসেস নেই। এর ব্যত্যয় যদি ঘটে সেই কোম্পানির লোকের নাম ঠিকানা আমাকে দিবেন। আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।

 

তবে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যপারে তিনি বলেন বেসরকারি হাসপাতালগুলো ঐভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। একটা ডাক্তার এর মানবিকতার উপর নির্ভর করে সে কিভাবে  চলবে। সে কোন কোম্পানির ঔষধ লিখবে এটা জদি সে কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লিখে তবে এটা দুঃখজনক বলা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। তিনি আরোও বলেন প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা তাদের হ্যাবিট হয়ে গেছে। এটা উচিত না।

 

এটা তাদের জব রেসপনসিবিলিটির মধ্যে পরলেও এটা দৃষ্টিকটু ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে ভিড় করে প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলে রোগীকে বিব্রত করা ঠিক নয়। এতে রোগীর গোপনীয়তা ক্ষুন্ন হয়। তিনি পরামর্শ দেন যেনো কোনো রোগী তার প্রেশক্রিপশনের ছবি কাউকে তুলতে না দেন। রোগীকেই সর্বপ্রথম সচেতন হতে হবে। তবে সুধীজনরা চাচ্ছে এর একটা সুষ্ঠু সমাধান। তারা চাচ্ছে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা। টাকা খরচ করেও যদি তারা সঠিক চিকিৎসা না পান। এর থেকে বোধ হয় আর হতাশার কিছু হয় না।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর