মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বাদুড় বিশেষজ্ঞদের দাবি

করোনা বাদুড় থেকে ছড়ায়নি!

প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল ২০২০  

ছবি: সংগৃহিত

ছবি: সংগৃহিত

ডেস্ক রিপোর্ট: বিশ্বজোড়া মহামারী যে নভেল করোনাভাইরাস তার উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে মতভেদ রয়েছে। উহানের ‘ওয়েট মার্কেট’ থেকে যখন এই ভাইরাস ছড়ানোর কথা প্রথম সামনে আসে, বিজ্ঞানীরা দাবি করেছিলেন বন্যপ্রাণীর শরীর থেকেই এই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে এই বন্যপ্রাণী কী হতে পারে?


বন্যপ্রাণী কী হতে পারে? অধিকাংশ বিজ্ঞানীর ধারণা নয়া করোনাভাইরাস অর্থাৎ সার্স-কভ-২ এসেছে বাদুড়ের থেকেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এমনও বলছেন যে বাদুড় থেকে সরাসরি মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম। এমনকি বাদুড়ের মধ্যে যে ভাইরাস মিলেছে সেও এই মারণ ভাইরাস অর্থাৎ সার্স-কভ-২ নয়।


এরপরে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে শুধু বাদুড় নয় কোনো মধ্যবর্তী বাহক রয়েছে, সেটা হতে পারে প্যাঙ্গোলিন। কারণ বাদুড় ও প্যাঙ্গোলিন দুই প্রাণীর শরীরেই এমন ভাইরাল জিন মিলেছে যার সঙ্গে সার্স-কভ-২ এর সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু প্যাঙ্গোলিনও সচরাচর মানুষের সংস্পর্শে আসে না যদি না চোরাচালান বা অন্য কোনো কারণ হয়। তাহলে সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেনের প্রকৃত উৎস কী? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনও বিজ্ঞানীদের নাগালের বাইরে।

 
দক্ষিণ এশিয়ার ৬টি দেশের বাদুড় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই মারণ ভাইরাসের জন্য বাদুড়কেই কাঠগড়ায় তোলার কোনও মানে হয় না। কারণ বাস্তুতন্ত্রে বাদুড়ে, চামচিকেদের অনেক অবদান রয়েছে। ফুলের পরাগমিলন থেকে, বীজ ছড়িয়ে গাছের বংশবৃদ্ধি, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নাশ ইত্যাদি। মারণ ভাইরাসের জন্য বাদুড়কেই দায়ী করে অনেক জায়গাতেই এই প্রাণীর হত্যা শুরু হতে পারে, যার কারণে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যে বড় আঘাত আসতে পারে। 


দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ইনস্টিটিউট ও সায়েন্স রিসার্চ ফার্মের ৬৪ জন বাদুড় বিশেষজ্ঞ এই ব্যাপারে নিজেদের মতামত জানিয়ে বাদুড় সংরক্ষণের আবেদন জানিয়েছেন। এই ভাইরাসের মহামারীর জন্য যে বাদুড় দায়ী নয় এবং কেন নয়, সে বিষয়ে তাঁদের গবেষণার রিপোর্টও সামনে এনেছেন। 


বার্লিনের লেইবনিজ ইনস্টিটিউট ফর জু অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চের গবেষক রোহিত চক্রবর্তী বলেছেন, যে বাদুড়ের প্রজাতির মধ্যে সার্স-কভ-২ এর মতো ভাইরাসের খোঁজ মিলেছে তার নাম ঐড়ৎংবংযড়ব ইধঃ (জযরহড়ষড়ঢ়যঁং ধভভরহরং)। এই বাদুড় মানুষের সংস্পর্শে খুব একটা আসে না। বা এলেও কোনোরকম সংক্রামক রোগ ছড়ায় না।


রোহিত বলছেন, এই বাদুড়ের একটা অংশের মধ্যে রেটজি-১৩ ভাইরাস পাওয়া গেছে যার জিনের সঙ্গে সার্স-কভ-২ ভাইরাল জিনের ৯৬% মিল আছে। এখান থেকেই অনেকের ধারণা তৈরি হয়েছে যে এই বাদুড়ই হলো মারণ ভাইরাসের বাহক। কিন্তু সেটা একেবারেই নয়। 


কেন? তার অনেক কারণ। রোহিত বলছেন, প্রথমত, সব ভাইরাসেরই মানুষের শরীরে ঢোকার জন্য একটা বিশেষ বাহক প্রোটিনের দরকার হয়। সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেনের জিনোম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এই ভাইরাস দেহকোষের ঢোকার জন্য যে বাহক প্রোটিনের সঙ্গে জোট বাঁধে তার নাম এসিই-টু (অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম-২)। কিন্তু বাদুড়ে পাওয়া রেটজি-১৩ ভাইরাল স্ট্রেন এই বাহক প্রোটিনের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে না। তাই মানুষের শরীরে ঢোকার কৌশল তাদের জানা নেই।
 
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের গবেষক কস্তুরী সাহা ও রোহিত দু'জনেই জানিয়েছেন, দ্বিতীয় কারণ হলো, এমন ভাইরাসের মানুষের সমাজে মহামারি হতে ৪০ থেকে ৭০ বছর সময় লেগেছে। এর মাঝে বহুবার বিবর্তিত হয়েছে ভাইরাস। হতেই পারে তাদের জিনের গঠনের অসংখ্য বার বদল হয়েছে। কিন্তু বাদুড় থেকে এই সার্স-কভ-২ আসেনি।


কস্তুরী বলছেন, অনুমান করা হচ্ছে ৪০ থেকে ৭০ বছর আগে বাদুড়ের এই ভাইরাস রেটজি-১৩ এবং সার্স-কভ-২ দুইয়েরই একই উৎস ছিল। সেই উৎস বাদুড় নাও হতে পারে, অন্য প্রাণীও হতে পারে। একই পূর্বসূরী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে আসায় এই দুই ভাইরাসের জিনের মিল রয়েছে। আর শুধুমাত্র এই মিল দেখে বলা যায় না বাদুড়ের ভাইরাসই আসলে সার্স-কভ-২। 


তৃতীয়ত, রোহিত বলছেন, এই ৪০ থেকে ৭০ বছর ভাইরাসের জন্য বিশাল সময়। যে কোনো ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরি করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। সেখানে এত বছরে কয়েক লক্ষ ভাইরাস জিনোম তৈরি হয়ে গেছে। হতেই পারে, তাদেরই কোনো একটি জিনের গঠন বদলে এমন প্রাণঘাতী চেহারা নিয়েছে। সুতরাং বাদুড় এই ভাইরাসের উৎস সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না।


বিজ্ঞানীরা বলেন, বাদুড় ৬৬ রকম ভাইরাসের বাহক। কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে মানুষকে সংক্রামিত করছে কোনো বাদুড় এমন তথ্যের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। নিপা ভাইরাসের সময়ই জানা গিয়েছিল বাদুড় থেকে মধ্যবর্তী বাহক শূকরের মাধ্যমে মানুষে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। নিপা ভাইরাসের বাহক তিন রকম বাদুড় যার মধ্যে একটা পরিচিত টেরোপাস হাইপোমেলানাস। এর বাইরে মহামারি ছড়ানোর জন্য বাদুড়ের সরাসরি ভূমিকার কথা খুব একটা জানা নেই।

 
আইআইএসসির গবেষক কস্তুরী বলছেন, মহুয়া মধুকা লম্বাফোলিয়া, নেপালের চিউরি প্রত্যন্ত এলাকার প্রয়োজনীয় এই গাছের পরাগসংযোগে বিশেষ ভূমিকা আছে বাদুড়দের। ফল খাওয়া বাদুড়রা ম্যানগ্রোভ ও অন্যান্য গাছের বংশবৃদ্ধির জন্য জরুরি। ইন্দোনেশিয়ায় কোকোয়া চাষীরা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভুট্টা চাষীরা বাদুড়দের থেকে বিশেষ উপকৃত। প্রতি বছর বাদুড়দের কারণেই কয়েক লক্ষ কোটি টাকা কীটনাশকের খরচ বেঁচে যায়।  


দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সায়েন্স ইনস্টিটিউটে ছড়িয়ে থাকা ৬৪ জন ভারতীয় বিজ্ঞানী এই ব্যাপারে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন। গবেষকদের মধ্যে রয়েছেন, বার্লিনের লেইবনিজ ইনস্টিটিউট ফর জু অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চের গবেষক রোহিত চক্রবর্তী, বেঙ্গালুরু ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের (আইআইএসসি) কস্তুরী সাহা, তিরুঅনন্তপুরম আইআইএসসির বাহিরাথান মুরুগাভাল, মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাঙ্কের ডক্টর শেষাদ্রী কে এস, নেপাল মিড-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ডক্টর পুষ্প রাজ আচার্য, পুণে আইসারের রাম মোহন, ব্রিটেনের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির ডক্টর পার্বতী বেণুগোপাল, শ্রীলঙ্কার এগ্রিকালচার বায়োলজির অধ্যাপক তারক কুসুমিন্দা, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটির গবেষক ডক্টর ভেঙ্কটেশ নাগারঞ্জন রাধা-সহ অনেকে।


বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বিটা-করোনাভাইরাসের পরিবারেরই সদস্য সার্স-কভ-২ ভাইরাসের উৎস অজানা। বাদুড়ের শরীরে যে ভাইরাস পাওয়া গেছে তার সঙ্গে এর মিল থাকলেও, সার্স-কভ-২ অনেকটাই আলাদা। বাদুড় থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়। বদুড়ের মল-মূত্র থেকেও ছড়ায় না সার্স-কভ-২। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) দক্ষিণ এশিয়ার যে দুই বাদুড় প্রজাতির মধ্যে ব্যাট-করোনাভাইরাসের খোঁজ দিয়েছিল তারাও সার্স-কভ-২ এর থেকে আলাদা।


ইন্ডিয়ান ফ্লাইং ফক্স এবং যে ধরনের বাদুড় ফল খায় তাদের শরীরে পাওয়া গিয়েছিল ব্যাট-করোনাভাইরাস, কিন্তু এই দুই প্রজাতির বাদুড় ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম নয়, মানুষের ক্ষতি করেছে এমনও জানা যায়নি। তাই ভয়ের কোনো কারণ নেই। আইসিএমআরের এপিডেমিওলজিক্যাল ও কমিউনিকেবল ডিজিজের প্রধান ডক্টর রমন আর গঙ্গাখেদকরই এমন কথা জানিয়েছেন। পরবর্তীকালে আইসিএমআরের অন্যান্য গবেষকরাও এই কথা বলেছেন। (সূত্র: দ্য ওয়াল)