শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কালিরবাজারে পাকিস্তান বাহিনীর গাড়িতে বোমা হামলা

বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হুদা

প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হুদার লেখা নারায়ণগঞ্জ শহরের কালির বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর গাড়িতে অপারেশনের কাহিনী।

 

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হুদা : একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম কলেজের ডিগ্রী পরীক্ষার্থী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ২রা মে হাজিগঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগরতলা যাই। তবে আগরতলা যেতে হেঁটে তিন দিন সময় লাগে। সেখানে আমাদের এলাকার আরো কয়েকজন এক সঙ্গে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেই।

 

 

পরে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করার জন্য দেশের ভিতরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি এবং আমার অধিনে আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা  বেশ কিছু অস্ত্র-গোলাবারুদ  নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে আসি। এসেই এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কোথায় কিভাবে পাকিস্তানীদের উপর হামলা করা যায় তা নিয়ে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পরিকল্পনা করতে থাকি।

 

 

ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফিরে আমরা অনেক অপারেশন করেছি। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যস্ত কালিবাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়িতে বোমা হামলার অপারেশন ছিল আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়।

 

 

কারণ ব্যস্ত শহরের মধ্যে পাকিস্তান বাহিনীর উপর  হামলা করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমরা সেই কাজটি করতে গিয়ে চরম সাফল্যে পেয়েছিলাম। একই সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দিত ও গৌরবান্বিত হয়েছিলাম । সেই ঘটনার পরে নারায়ণগঞ্জ শহরে পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে চরম ভীতি দেখা দিয়েছিল।

 

 

তাদের চলাফেরাও অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছিল। আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের খুশির কারণ ছিল যে সফল একটি অপারেশন করে আমরা নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিতে পেরেছিলাম।

 

 

তখন নারায়ণগঞ্জ শহরের কালিবাজার এর কাছে টেলিফোন ভবনে পাকিস্তান সৈন্যদের একটি বড় ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্প থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে অত্যাচার নির্যাতন করতো এবং মানুষকে ধরে এনে হত্যা করত।

 

 

এ প্রেক্ষাপটে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সেই ক্যাম্প থেকে বেরোনোর পরপরই সৈন্যদের উপর হামলা করবো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কাজ শুরু করে দেই। আমার অধীনে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল ছিল। আমরা পরিকল্পনা করি, কালিরবাজার এলাকার যে কোন একটি উঁচু ভবন থেকে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর গাড়ির উপর বোমা হামলা করার।

 

 

এই অপারেশনটি করার জন্য আমি, নুরুল হক আর সুলতান পরপর দুইদিন কালিবাজারের গিয়ে শ্রমিকের ছদ্মবেশে পুরো এলাকা রেকি করি। কালিবাজার ছিল টিএনটি অফিস থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে। সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর একটি বড় ক্যাম্প ছিল। আমি ভেবে দেখলাম, শহরের অন্যান্য রাস্তায় পাকিস্তান বাহিনীর গাড়ি কখন যায় তার ঠিক নেই।

 

 

কিন্তু ওদের ক্যাম্পের মধ্যে গাড়ি আসা-যাওয়া করবেই। এলাকা রেকি করে বুঝলাম, কালিরবাজার পোস্ট অফিসের রাস্তার উত্তর দিকে জালাল হাজির বিল্ডিং এর দোতলায় উঠে পাকিস্তান বাহিনীর উপর বোমা হামলা করা অনেক সহজ হবে।  সেই স্থানটি তিন রাস্তার মোড় ছিল, এখনো তেমনই আছে।

 

 

এক মাথা কালিবাজার হতে এক নম্বর রেলগেট এবং এক মাথা বর্তমানে সেই সময়ের কায়দে আজম রোড, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু রোডের গ্রীনলেস ব্যাংক পর্যন্ত রাস্তা।

 

 

প্রথম দুইদিন ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয় দিন আমি, নুরুল হক, কানু চন্দ্র , সুলতান প্রমুখ অপারেশনে যাই। অপারেশনে যাওয়ার  আগে আমাদের ক্যাম্পে বসে একটি বোমা তৈরি করি।  আমি একটি খালি বড় ডানোর ডিব্বায় একটি এন্টি পার্সোনাল মাইনের ডেটনেটর খুলে সেখানে আলাদা একটি ডেটনেটর লাগাই।

 

 

সঙ্গে বিশ সেকেন্ডের একটি প্রাইম কড যুক্ত করি। ডিব্বার নিচের দিকে চিহ্ন কেটে রাখি। ডিব্বার খালি জায়গায় এবং উপরে লবণ দিয়ে ভর্তি করে ঢাকনা লাগাই। পাকিস্তানী বাহিনী ডিব্বা দেখলেও যেন বুঝতে না পারে এতে বোমা আছে।

 

 

সেখানে হোসেন মহাজনের একটি কাপড়ের দোকানে আমাদের গ্রামের চান মিয়া দাদা নামে এক কর্মচারী ছিলেন। ভবনের দোতলায় উঠার আগে আমি তাকে চুপিসারে বলি, আপনি নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। এ কথা বলে আমি দোতালায় উঠি, আমার হাতে বোমা ছিল।

 

 

দোতলায় এক ডেন্টিস্টের দোকান ছিল। তিনি আমাকে দেখে দোতলার বারান্দায় এসে বলেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ডিব্বার মধ্যে কি আছে? আমি সাথে সাথে ডিব্বা খুলে খালি ডিব্বা দেখিয়ে বলি, আমার বাবা গরুর ভুষি কিনতে গেছে। বাবা এলেই চলে যাবো। ডাক্তার আমাকে বলে, দিনকাল ভালো না, তুমি যুবক, তোমার বাবা এলে সাথে সাথেই চলে যেও। ডাক্তার আমাকে সন্দেহ করতে পারেনি।

 

 

তখন রোজার মাস ছিল। ঠিক ইফতারির ৫-৭ মিনিট পূর্বে দেখতে পাই একটি পিকআপ জিপে চড়ে  ছয় জন সৈন্য কোর্টের রাস্তা দিয়ে টেলিফোন ভবনের ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। গাড়িটি আমার ২০ গজের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমি বোমা নিক্ষেপ করি।

 

 

বোমাটি হানাদার বাহিনীর পিকআপ গাড়িতে  গিয়ে পড়ে  প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে থাকা ৪জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। আমরা সাথে সাথে দোতলা থেকে পিছন দিক দিয়ে নেমে আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডার সামনে দিয়ে পশ্চিম দিকে দ্রুত পালিয়ে যাই। সে সময় রাস্তার দুই দিকে ছোট ছোট কাপড়ের দোকান ও হোটেল ছিল এবং রাস্তা ছিল খুবই সরু।

 

 

আমরা রাস্তার পশ্চিম দিকে এগুলোর সময় দেখতে পাই কেউ কেউ বোমা বিস্ফোরনের আওয়াজকে ইফতারের সাইরেন দেয়া হয়েছে মনে করেছে। তারা ইফতার করা শুরু করে দেন। আমরা হেটে কায়দে আজম রোডে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু সড়ক) এসে একটি রিকশা নিয়ে খানপুর আমাদের গোপন আস্তানায় চলে যাই।

 

 

পাকিস্তানী বাহিনীর উপর সেই বোমা হামলা পুরো নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। একদিকে পাকিস্তান বাহিনী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে মূল শহরের ব্যস্ত এমন অপারেশনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে অনেক সাহস সঞ্চয় হয়েছিল।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর