শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব এখন আতঙ্ক

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২২ মে ২০২২  

# সহজে জামিন পাওয়াও অন্যতম কারণ : শরীফ উদ্দিন সবুজ
# কিশোর গ্যাং বিস্তারে বড় ভাইদের ভূমিকা আছে : আমির হোসে স্মিথ
# আপনার সন্তান কখন কেথায় যায় খেয়াল রাখতে হবে : পুলিশ সুপার

 

নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক সময়ের সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে যে বিষয়টি তাহলো কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ। যদিও এটি একটি সামাজিক সমস্যা, কিন্তু বর্তমানের অপরাধের সম্রাজ্যে কিশোর গ্যাং ক্রমেই আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার এমন কোন উপজেলা বা থানা নাই যেখানে কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব নেই। তবে নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীর প্রতি পাড়া-মহল্লাসহ এর আশেপাশের এলাকাগুলোয় (সদর, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর এলাকায়) কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

যেই কোমল বয়সে লেখাপড়া ও খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করার কথা। সেই বয়সেই এখন খুন জখমসহ দুই গ্রুপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা এখন তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া, ধারালো অস্ত্র হাতে দলবেঁধে চলা, পথিমধ্যে প্রকাশ্যে কাউকে কুপিয়ে জখম করা তাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার গ্যাং আকারে সংঘবদ্ধ হওয়ায় ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পায় না।

 

আবার প্রায় ক্ষেত্রেই এসব কিশোরদের পিছনে শেলটার হয়ে কাজ করছে। তাই কিশোর গ্যাং প্রশাসনের জন্য রীতিমতো বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিশোরদের এই গ্যাং-এ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ধনীর দুলাল ও হতদরিদ্র পরিবারের উঠতি বয়সের কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে। যদিও এসব কিশোর গ্যাংয়ে দৃশ্যত পাড়া-মহল্লায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখার বিষয়টি উঠে আসে।

 

কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে কিংবা ছত্রছায়ার কাজটি করছেন ওইসব এলাকার রাজনৈতিক নেতা কিংবা স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে করে বিড়ম্বনায় পড়ছেন এই গ্যাংয়ে জড়িত কিশোরদের পরিবার, সেই এলাকা, স্থানীয় প্রশাসনসহ সমগ্র দেশ। পারিবারিক অসচেতনতার অভাব, প্রভাবশালী রাজনৈতিক বড় ভাইদের আশ্রয়সহ দারিদ্রতার কারণে বেড়ে চলেছে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য।

 

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, গত একমাসের কাছাকাছি সময়ের মধ্যে শুধু শহর সংলগ্ন এলাকাতেই কিশোর গ্যাংয়ের হাতে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ১৭ মে ফতুল্লার ইসদাইর এলাকায় প্রেম ঘটিত বিষয় নিয়ে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে স্কুল পড়ুয়া কিশোরদের হাতে খুন হয় দশম শ্রেণির ছাত্র ধ্রুব দাস।

 

এর আগে গত ২৫ এপ্রিল ফতুল্লার মাসদাইর শেরেবাংলা সড়কে কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা এক গার্মেন্টস শ্রমিককে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। গত ৬ এপ্রিল বুধবার সকালে ফতুল্লার ইসদাইর বাজার এলাকায় শামীম নামের এক যুবককে ডেকে এনে প্রকাশ্যেই কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা। খুনের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।

 

এদিকে গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জেরে মো. ইমন নামে এক যুবককে জবাই করে হত্যা করা হয়।  ২৯ জুন চাষাঢ়ায় রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকাতে মাদকের স্পট নিয়ে বিরোধে ২ কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে নিহত হন রাজমিস্ত্রী রুবেল। ২০২০ সালের আগস্টে বন্দরের ইস্পাহানী এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষের সময় এক পক্ষের ধাওয়ায় আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মিহাদ ও জিসান নামের দুই

 

শিক্ষার্থী মারা যায়। ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই শহরের খানপুর বরফকল এলাকায় বান্ধবীর মোবাইল ফোন ফিরিয়ে দিতে গেলে ফয়সাল নামের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করে পাঁচ কিশোর। একই বছরের ২৭ জুলাই ফতুল্লার দেওভোগে মোটরসাইকেলের লাইটের আলো চোখে পড়ার মতো তুচ্ছ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে শাকিলকে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাং।

 

অন্যদিকে কিশোর গ্যাংয়ের রক্তাক্ত হামলার ঘটনায় আহত হওয়ার ঘটনার সংখ্যাতো আরও অনেক বেশি। গত ১৭ মে শহর সংলগ্ন বন্দর উপজেলার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শান্ত ও জাহিদের নেতৃত্বে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় উভয় গ্রুপই থানায় অভিযোগ করেন বলে জানা গেছে। গত ১৪ মে একই দিনে ফতুল্লা,

 

সিদ্ধিরগঞ্জ শ্মশান ঘাটে ও বন্দর লাঙ্গলবন্দ বাজার এলাকায় পৃথক ৩টি হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় ফতুল্লার দেওভোগ পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় মিরাজুল ইসলাম দিপু, সিদ্ধিরগঞ্জে কলেজ শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিয়াদ ও বন্দরে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম রিফাত ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়। গত ১৩ মে রাতে নগরের গলাচিপা বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক

 

অগ্রবাণী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রাশিদ চৌধুরী ও পথচারী মো. জসিম। সেখানকার কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্র হাতে মহড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার সূত্র ধরে পত্রিকায় খবর প্রকাশকে কেন্দ্র করে তার ওপর হামলা হয়েছে বলে তার ধারণা করেন রাশিদ। গত ৩ এপ্রিল নগরীর জামতলা কেন্দ্রীয় ঈদগাহের সামনে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয় নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজের ছেলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহমেদ অন্তর।

 

নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজ জানান, বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের প্রাদুর্ভাব বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো করোনার অযুহাতে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা। এই সময় কিশোরদের অনলাইনে প্রবেশ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।

 

এর আগে অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত এসব মোবাইল ফোন দেওয়াই সমীচিন মনে করতাম না। বাধ্য হয়ে কাউকে দিতে হলেও বাটন ফোন দেওয়া হতো। এই সময় কিশোররা স্মার্ট ফোন পেয়ে কোথায় কোথায় চলে যায় তার কোন ঠিকানা নাই। বেশিরভাগই ইন্টারনেটে খুন-খারাবির গেম খেলে। এসব খেলতে খেলতে তাদের মনের মধ্যেও খুনের এক ধরণের ইচ্ছা তৈরি হয়।

 

এর জন্য অপরাধগুলো বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়ার এক ধরণের প্রবণতা আগে থেকেই আছে। পুর্নবয়স্করা সন্ত্রাস করলে বিভিন্ন সাজার শিকার হলেও অপ্রাপ্ত বয়স্করা খুব সহজেই জামিন হয়ে যায়। একটা ঘটনা ঘটলে যারা আসামী আছে তারা যদি ন্যুনতম শাস্তি পায় বা জেলখানায় থাকে তাহলে তাদের মনের ভেতর একটা ভয়ের সৃষ্টি হয়।

 

তাই তারা সহজে যেন জামিন না পায় সে বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন। তারপর যাদের আমি দায়ী করব তারা হলেন পুলিশ প্রশাসন। কারণ আমার মতে পুলিশ প্রশাসনের টহল পর্যাপ্ত না বলে আমি মনে করি। তবে তিনি জানান, শুধু প্রশাসন দিয়ে জোর খাটিয়ে অপরাধ কমানো সম্ভব না। এ ছাড়াও কিশোর অপরাধীদের ভালবাসা প্রদানসহ তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি ভাল ধারণার সৃষ্টি করতে হবে। মারামারি খুনাখুনি মানুষের জীবনকে পিছিয়ে দেয় কিশোরদের মধ্যে সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের এই ম্যাসেজ পৌছে দিতে হবে।

 

এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন স্মিথ বলেন, নারায়ণগঞ্জে বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের এতটাই উপদ্রব বেড়েছে যে, এখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে। সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষসহ কিশোর গ্যাংয়ের এই হামলার শিকার হচ্ছে তাদের সহপাঠী কিশোররাও। তিনি আরো বলেন, এই বিষয়ে পুলিশের যে ধরণের তৎপর হওয়ার কথা আমরা তাদের সেই তৎপরতা দেখছি না। কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে কিছু রাজনৈতিক নেতারাও আছেন যারা নেপথ্যে থেকে তাদের পরিচালনা করেন।

 

সেই মহলই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের শেল্টার দিচ্ছে। যার কারণে এই কিশোররা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পর্দার আড়ালে থেকে যারা কিশোর গ্যাংয়ের শেল্টার দিচ্ছে, পুলিশের উচিত তাদের খুঁজে বের করা। যতদিন পর্যন্ত নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত করা না যাবে ততদিন পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নারায়ণগঞ্জ জেলায় থামবে না।

 

এই বিষয়টা এখন নারায়ণগঞ্জের জন্য বড় ধরনের বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরবাসীও কিশোর গ্যাংয়ের কারণে আতঙ্কিত। কিশোররা না বুঝে এই ফাঁদে পা দেয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তারা খুব সহজেই জামিনে বের হয়ে আসে। সেই সুযোগেই রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা তাদের হাতে অস্ত্র ও মাদক তুলে দিচ্ছে, তাদেরকে ব্যবহার করছে।

 

তবে পুলিশ প্রশাসনের একার পক্ষে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব না উল্লেখ করে তিনি জানান, এই বিষয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েতসহ রাজনৈতিক বড় ভাইদেরও সচেতন হতে হবে। পিতামাতাকে খোঁজ রাখতে হবে তাদের সন্তান কোন্ সময় কোথায় যায়। সন্ধ্যার সময় কেন বাসায় আসছে না, কার সাথে মিশছে, কোন গ্যাং এর সাথে চলাফেরা করছে। কোন্ নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সে সারা দিন কাটাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত বাবা-মা সচেতন না হবে, ততদিন কিশোর গ্যাং বেড়েই যাবে।
 
 
এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মো. জায়েদুল আলম বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের দাপট বিস্তারের জন্য দায়ী তাদের প্রতি অভিভাবকসহ সমাজের লোকজনের সঠিকভাবে খেয়াল না রাখা। আমি মনে করি প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত, তার সন্তান কি করে, কোথায় যায়, সন্ধ্যার পর যেন বাহিরে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা। তিনি বলেন, সামাজিক লোক বলতে এখানে রাজনৈতিক ব্যক্তি ধর্মীয় ব্যক্তিসহ পিতা মাতারাও আছেন। কিশোররা যেন অপরাধে না জড়ায় এই জন্য সমাজের সকলেরই দায়-দায়িত্ব আছে। অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনার সন্তান সে ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক-না-কেন, বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণদের প্রতি খেয়াল রাখবেন, সে কখন কোথায় যায়। পুলিশ সুপার কিশোরদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমাদের সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ, তোমরা রঙিন স্বপ্নে বিভোর না হয়ে, বিভিন্ন ধরনের মোবাইল গেম থেকে বিরত থেকে লেখাপড়ার দিকে নজর দাও। তাহলে ভবিষ্যতে তোমরা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে। কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধী এই অপবাদ থেকে মুক্তি লাভ করবে।
 

এই বিভাগের আরো খবর