শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কোমায় যেভাবে গেল বন্দর আওয়ামীলীগ

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২১ মে ২০২১  

শীতলক্ষ্যার জলরাশি শহরের বুক থেকে বন্দরকে আলাদা করলেও হারাতে দেয়নি তার জৌলুশ। এই শীতলক্ষ্যাকে কেন্দ্র করেই সেই বৃটিশ আমল থেকে নদীর দুই তীরে সমানভাবে তাল মিলিয়ে পাট মিলসহ বিভিন্ন মিল কারখান তৈরি হওয়ায় বন্দর তার কদর বাড়িয়ে আপন মহিমায় নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর সে কারণেই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বন্দর সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে আসছে। আওয়ামীলীগের উৎপত্তি থেকে মুক্তিযুদ্ধে ভ‚মিকা রাখাসহ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বন্দরে আওয়ামীলীগের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরী হয়।

 

আওয়ামী লীগের অবস্থান এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, জাতীয়পার্টির স্বৈরশাসনের আমলে তৎকালীন সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান (প্রয়াত) স্বৈরাচার সরকারের প্রভাবশালী নেতা হওয়া পর বন্দরে জাতীয়পার্টির শক্ত অবস্থান তৈরী করার জন্য আওয়ামীলীগকে টক্কর দেয়ার চেষ্টা করে বারবার হানা দিয়েও ব্যর্থ হন। নাসিম ওসমান তখন সেখানে বিভিন্ন কৌশলে হানা দিয়েও আওয়ামীলীগকে কাবু করতে পারেনি। তবে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে ২০০৮ এ নবম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে। যখন আওয়ামীলীগ জাতীয়পার্টির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করে এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন জাতীয়পার্টিকে ছেড়ে দেয় তখন থেকেই ধীরে ধীরে সফল হতে শুরু করে নাসিম ওসমান।

 

নাসিম ওসমান তখন শুধু জাতীয়পার্টি নয় বন্দর আওয়ামীলীগেরও নীতিনির্ধারক হয়ে ওঠেন। বন্দর আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় বেশ কিছু নেতা নাসিম ওসমানের হাত ধরে এবং জ্বী-হুজুর টাইপে তেল মারতে শুরু করে ভাগিয়ে নেয় আওয়ামীলীগের শীর্ষ পদগুলো। তখন থেকে তাদের আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদেরকে পদ থেকে সরানোর সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারেনি কেউ। যারা ত্যাগী, বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসারী এবং আওয়ামী লীগকে মন থেকে ভালবাসেন তারা হয়ে পড়েন অভিভাবকহীন। বিভিন্ন সরকারী কর্মকান্ডসহ দলীয় কর্মকান্ডে জাতীয়পার্টি ও আওয়ামী লীগ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় সাইডআউটে চলে যায় আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতৃবৃন্দ।

 

তাদের অভিযোগ, নবম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে একাধারে এই আসনটি জাতীয়পার্টিকে ছেড়ে দেয়ায় অভিভাবকহীন হয়ে নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে আওয়ামীলীগ। সেখানে প্রথমে নাসিম ওসমান এবং তার মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরী হিসেবে তার ছোট ভাই সেলিম ওসমান এই দায়িত্বটি কাঁধে নেন। আর আওয়ামীলীগের স্বার্থলোভী নেতারা যার যার এলাকায় তাদের শীর্ষপদটি কিংবা আধিপত্য ধরে রাখতে জাতীয়পার্টি ঘেঁষা কমিটি বা দল তৈরী করে নেয়। আর এই সুযোগটি কাজে লাগায় বিএনপির কিছু স্বার্থবাদী নেতা। তারাও তাদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীর মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগটি ছাড়তে নারাজ। আর এতে করে বন্দরে যারা একনিষ্ঠ আওয়ামীলীগ তাদেরকে কাবু করছে সাধারণ মানের আওয়ামীলীগ, জাতীয়পার্টি কিংবা বিএনপি নেতা।


 
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বন্দরে বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি পদে আছে বন্দরের বেশ কয়েকজন নেতা। তারাও বন্দর আওয়ামীলীগের কোন কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না। এমনকি জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি আরজু রহমান ভূঁইয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সুফিয়ান, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক নুর হোসেন, জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য এডভোকেট ইসহাক ও আব্দুল কাদের ডিলার, মহানগর আওয়ামীলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাবীব আল মুজাহিদ পলু, সদস্য আবেদ হোসেনসহ বন্দরের বেশ কয়েকজন নেতা জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের কোন কর্মকান্ডের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা দেখা যায় না। সেখানে তারা সবসময় অবহেলিত থাকেন।

 

বন্দরের অবহেলিত অথচ ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, যেহেতু ক্ষমতায় এখন আওয়ামীলীগ আর আওয়ামীলীগের সমর্থনে জাতীয়পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন শিল্পপতি সেলিম ওসমান। তাই তার অর্থ এবং আধিপত্যকে হাতছাড়া করতে রাজী নয় বন্দরের প্রভাবশালী নেতারা। তাইতো তাদের নিজেদের বৈশিষ্ট এবং স্বত্তা বিসর্জন দিয়ে জাতীয়পার্টির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে বন্দর আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ। আর দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হচ্ছে আওয়ামীলীগের যারা একনিষ্ঠ নেতা বা কর্মী, যারা পারিবারিকভাবেই আওয়ামীলীগকে হৃদয়ে ধারণ করেন তারা।

 

যার প্রমাণ বন্দরের বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের অনেক ত্যাগী নেতা প্রতিদ্বন্ধিতা করতে চাইলেও সেলিম ওসমান আগে থেকেই বিভিন্ন জায়গার জনসভায় হুঙ্কার দিয়ে রেখেছেন যে, যারা বর্তমান চেয়ারম্যান আছেন তাদেরকেই তিনি পুনরায় চেয়ারম্যান হিসেবে চান। আর এতে করে সাধারণ জনসাধারণসহ আওয়ামীলীগের কর্মীদের প্রত্যাশিত নেতাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করলেন। এখানে ক্ষমতালোভী ও সুবিধাবাদী নেতারা তার  স্নেহভাজন হওয়ার চেষ্টা করবেন এটাইতো স্বাভাবিক।

 

জেলা আওয়ামীলীগ এর সহসভাপতি আরজু রহমান ভূঁইয়া বলেন, জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আছে, এ বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব তাদের। তারা এই বিষয়টি দেখবে। এখানে তারা কীভাবে দেখভাল করতেছে এটা হলো বিষয়। এখানেতো আওয়ামীলীগের সমর্থিত জাতীয়পার্টির এমপি, ওসমান পরিবারের এমপি। আওয়ামী পরিবার ও জাতীয়পার্টি সবই তারা। এই পরিবারকে বাদ দিয়ে তো বন্দর থানার নেতৃবৃন্দতো কোন কাজ করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ বারবার এখানে জাতীয়পার্টির প্রার্থী দেয়ায় এখানকার আওয়ামীলীগের কী অবস্থা তা কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগই জানে। তিনি বলেন, থানা আওয়ামীলীগের কমিটি এখনো কেন্দ্রীয় কমিটি বা জেলা কমিটি অনুমোদন করেনি। সুতরাং এখানকার সভাপতি ও সম্পাদক করবেটা কি? যেখানে ওসমান পরিবারের এমপি সেখানে আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের কী করার আছে?


 
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ বলতে জননেত্রী শেখ হাসিনা। সমস্তকিছু নেত্রীর নখদর্পণে। জেলা কমিটি থেকে শুরু করে থানা পর্যায়ের সকল কমিটির বিষয়ে উনার জ্ঞান আছে। নেত্রীর কাছে কোন খবর অজানা নাই। তিনি বলেন, এখন জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগ কমিটির মেয়াদউত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যে সমস্ত থানা কমিটি গঠন করা হয়েছে সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণের পথে। কোভিডের কারণে এখন রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কাজকর্ম সচল না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা তলাবিহীন ঝুড়ি নিয়েছে সেই ঝুড়ি এখন উপচাইয়া পড়তেছে। এখন সরকারের সেদিকে মনযোগ বেশী।

 

মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য ও বন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন বলেন, ‘আমি যখন সাধারণ সম্পাদক ছিলাম তখন আওয়ামীলীগের লোক নিয়েই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন আমি উপজেলা এলাকায় নাই, এখন সিটি কর্পোরেশনের জায়গায় আছি। উপজেলা কমিটি শুধু সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছে পুর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো গঠন করা হয়নি। অনেক বছর হয়ে গেছে ইউনিয়ন কমিটিগুলো গঠন করা হয়নি। এগুলো নিয়ে জেলা কমিটির সভাপতি সেক্রেটারী চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন। এর বেশী কিছু বলতে রাজী হননি তিনি।’


 
জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সুফিয়ান বলেন, ‘বর্তমান কমিটি নিয়ে কী বলব, তাদের কর্মকান্ডেই সব প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ৫টি ইউনিয়ন পরিষদের কমিটি থেকে ৪টি ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই কেন্দ্রের কাছে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। বন্দরে আওয়ামীলীগ এবং জাতীয়পার্টিকে আলাদাভাবে খুঁজে বের করা কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দল হয়ে গেছে বর্তমানে এমপি কেন্দ্রিক, এমপি যেহেতু আওয়ামীলীগের না, তাই ক্ষমতার ভাগাভাগি, হালুয়া রুটির ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে রাজনীতি চলছে। প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে বাস্তবায়ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উন্নয়ন কার্মকান্ড জনগণের দোর গোড়ায় পৌছে না দিয়ে তারা ব্যক্তি বিশেষের তাবেদারী শুরু করেছে। তাই তারা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে।’


 
তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা ভ‚মিকা রাখতে পারতাছি না, কারণ জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কারণেই বর্তমানে এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ আওয়ামীলীগের কমিটি ছাড়া নারায়ণগঞ্জের কোন উপজেলার কমিটিই গঠনতন্ত্র মোতাবেক এবং জেলা কমিটিকে অবগত সাপেক্ষে করা হয়নি। একারণে এখানকার কার্যকলাপগুলো কোন জবাবদিহিতার মধ্যে নাই। এখানে ব্যক্তি বিশেষের কাছে তারা ধর্ণা দিতেছে এবং ব্যক্তি বিশেষের সাথে তার রাজনীতি করতেছে। এই সব কমিটিগুলো তৈরী সম্পর্কে জেলা কমিটি কিছু জানে না। অতএব তাদের কর্মকান্ড ভাল হচ্ছে; নাকি খারাপ হচ্ছে, তা দেখভাল করার মতো অবস্থা আমাদের নাই। কেন্দ্রও এ বিষয়ে অবগত আছে।’
 


 

এই বিভাগের আরো খবর