বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কোরবানিকে কেন্দ্র করে কদর বেড়েছে হোগলাপাটির

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০২১  

কোরবানিকে কেন্দ্র করে কদর বেড়েছে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা শিল্প হোগলার। কোরবানির গরু জবাই করার পর মাংস কাটার জন্য এখনো দেশের প্রায় সকল এলাকায়ই হোগলা পাতা দিয়ে বানানো পাটির ব্যাপক চাহিদা। এর বাইরে হোগলা পাটির ব্যবহার এখন আর তেমন একটা নাই বললে চলে। আর চাহিদা হীনতার কারণে এই শিল্পের সাথে এখন আর ঘনিষ্ঠভাবে জড়াতে চায় না কেহ।

 

সেই হারিয়ে যেতে বসা হোগলা পাটির ব্যপকহারে কদর বাড়ে শুধু কোরবানীর সময় এলে। যেই হোগলা পাটি এক সময় প্রতি বাড়িতে বাড়িতে দেখা যেত, মসজিদ-মন্দিরে দেখা যেত, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা যেত, প্রত্যেক বাড়ির বৈঠকখানায় হোগলা না থাকলে যেন আড্ডাই জমতো না। কালের আবর্তে সেই হোগলা পাটি তথা হোগলা শিল্প এখন প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। এক সময়ের ব্যাপক চাহিদা সমৃদ্ধ এবং খুবই প্রয়োজনীয় একটি শিল্প এখন পরিণত হয়েছে মৌসুমি শিল্পে। কোরবানির ঈদের চার থেকে পাঁচ মাস আগে থেকে এই পাটি বানানোর জন্য অর্ডার দেয় পাইকাররা।

 

হোগল পাতা নামক এই জলজ উদ্ভিদ আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে উপক‚লীয় অঞ্চলের এটেঁল মাটিতে জন্মে। আমাদের দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে নদী, খাল ও ঝিলের কিনারায় প্রাকৃতিক উপায়ে এই উদ্ভিদ জন্মায়। এগুলো লম্বায় প্রায় ৫ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত হয়। যখন ১ থেকে ২ ইঞ্চি সারি সারি পাতার সমন্বয়ে বেড়ে ওঠে তখন সৃষ্টি হয় মনোমুগ্ধকর সবুজ পরিবেশ। সেসব এলাকার কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ এই উদ্ভিদ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে জীবনযাপন করত। আবার কেউ কেউ এই হোগল পাতা কিনে গ্রামীণ কুঁড়ে ঘরের বেড়া, ফসলের ক্ষেতে বেড়া, ঘরের ছাউনি ও ফসল রাখার টুকরির কাজে ব্যবহার করত। বিশেষ করে গ্রামের নারীরা বাড়তি আয়ের উৎস হিসাবে কোমল ও নরম পাতা আলাদা করে তা দিয়ে শীতল পাটি, হাতপাখা, নামাজের মাদুর, কুশন, ঝুড়ি, টুপি ও টুকরিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে বাজারে বিক্রি করত। এসব পণ্য শহরের অনেক মানুষকেও ব্যবহার করতে দেখা যেত।

 

তবে হোগলা দিয়ে বানানো পাটি একসময় মক্তব, মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার হতো। গ্রামের সকল পেশার মানুষ খাওয়া, নামাজ ও ঘুমানোর কাজে এই পাটির ব্যবহার হতো সব থেকে বেশি। বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় তীব্র গরমে মানুষ হোগল পাতার হাতপাখা ছিল নিত্য দিনের সঙ্গী। তবে এখন এই পাটির ব্যবহার বিশেষ কয়েকটি কাজেই হয়। তারমধ্যে অন্যতম কোরবানি। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর, কোটালী পাড়া, কাশিয়ানী, টুঙ্গীপাড়া ও গোপালগঞ্জ সদর  উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ শিল্পের এই হোগলা পাতা দিয়ে চাটাইসহ অন্যান্য শৌখিন সামগ্রী তৈরি করে। কুমিল্লা জেলার বরুড়ার শাকেরপুর, খোঁশবাশ ইউনিয়ন পরিষদসহ অনেক গ্রামে হোগলা পাটি বানানো হয়। মুন্সিগঞ্জ জেলার ইছাপুরা ইউনিয়নে, সিরাজদিখান উপজেলার আশ-পাশে এই হোগলা পাতার পাটির বানানোর কাজে অনেক পরিবারই জড়িত।

 

এছাড়াও বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকায় হোগলা চাষ ও পাটি তৈরী হয়। বিশেষ করে পরিবারের নারীরা এ পেশায় বেশি জড়িত। তারা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই পাটি বানিয়ে থাকেন। একজন নারী ঘরে বসেই দক্ষ হাতে প্রতিদিন প্রায় ৩টার মত পাটি বানাতে পারেন। শহরের চারারগোপ এলাকার খাল পাড়ে দেখা যায় হোগলা পাটির বিরাট মজুদ। সেখানে নোঙ্গর করা আরো দুইটি ট্রলার থেকে মাথায় করে হোগলার পাটি নামাচ্ছেন শ্রমিকরা। এখানে মজুদ করা পাটিগুলো কালীরবাজার এলাকার ব্যবসায়ী মিলন স্টোরের। এখান থেকে ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা পাটি কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন।

 

এ বিষয়ে শহরের কালীর বাজার এলাকার হোগলা পাটির অন্যতম ব্যবসায়ী মিলন স্টোরের কর্ণধার আরিফুল হক নির্ঝর জানান, বরিশালের বিভিন্ন হাট থেকে আমরা লোক মারফত এগুলো সংগ্রহ করি। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক মাস ধরে সেখানকার হাটগুলো থেকে তারা এগুলো কিনে সংগ্রহ করে রাখেন। যখন আমাদের চাহিদা মতো সংগ্রহ হয়, তখন আমরা নদী পথে দুই তিনটি ট্রলারে করে নিয়ে এসে কালীর বাজার এলাকার চারারগোপ এর খালে নিয়ে আসি।

 

তিনি জানান, তাদের এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটিতে তারা প্রায় ৫০ বছর যাবত ব্যবসা করছেন। তারা এখান থেকে এই হোগলার পাটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ট্রাক যোগে সাপ্লাই দেন। কোরবানির ঈদের এই সময়টাতে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার দোকানদাররা তাদের কাছ থেকে এই পাটি কিনে নিয়ে ব্যবসা করেন। আগে মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বেশির ভাগ বাড়ি ঘরের মেঝে মাটির তৈরী ছিল, তাই তখন এই হোগলা পাটির চাহিদা ছিল ব্যাপক। কিন্তু এখন দেশের বেশির ভাগ মেঝেই পাকা হওয়ায় কোরবানির ঈদ ছাড়া এই হোগলা পাটির তেমন আর চাহিদা নাই।
 

এই বিভাগের আরো খবর