শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

খাল গেল কোথায়? 

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ৮ জুন ২০২১  

পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ বলছে ডিএনডি অধ্যুষিত এলাকায় খালের মোট আয়তন ৯৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ডিএনডি প্রজেক্টের আওতায় এখনো পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৮৯ কিলোমিটার।এখনো দখলের কবলে ৪ দশমিক ৯ কিলোমিটার খাল। এদিকে, ডিএনডি অধ্যুষিত খালের মধ্যে অভ্যান্তরিন কয়েকটি খাল ডিএনডি প্রজেক্টের আওতাভুক্ত হয়নি। বাদ পরা খালগুলোকে ছোট হিসেবে উল্লেখ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ‘ছোট খাল যেগুলো আছে, সেগুলো প্রজেক্ট করার সময় হয়তো কোন কারণে বাদ পড়ে গেছে।’ তবে যে কারণেই বাদ পড়ুক, খালগুলো ডিএনডি প্রজেক্টের আওতায় না আসায় বা দখলমুক্ত না হওয়ায় জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর।

 


সরেজমিনে দেখা যায়, ফতুল্লার ইসদাইর রেললাইন এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে বহু পুরনো একটি খাল। স্থানীয়দের অনেকেই খালটিকে বগডুবির খাল হিসেবে চেনেন। ইসদাইর এলাকার বাসিন্দা মো. মোশারফ হোসেন মাসুম দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানান, ইসদাইর রেললাইন এলাকায় বহু পূরনো একটি খাল আছে। আগে পানি প্রবাহ ছিলো। ছোট বেলায় সেখানে গোসল করতাম। বেশ চওড়া এই খাল ধরেই এলাকার বৃষ্টির পানি নেমে যেত। এখন আর খাল নেই, ড্রেনে পরিণত হয়েছে। অনেক স্থানে আবর্জনায় আটকে আছে। এই এলাকা ডিএনডি বাঁধের অধুষ্যিত হওয়ার পরও এই খালটি ডিএনডি প্রজেক্টের আওতায় পড়েনি। তাই খালটিও উদ্ধার হচ্ছে না, আমাদের জলাবদ্ধতার ভোগান্তিও শেষ হচ্ছে না।’

 


এদিকে, স্থানীয় পর্যায়ে স্বীকৃত ওই খালের বিষয়ে তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে। প্রসিদ্ধ এই খালের কাগজে কলমের বাস্তবতা খুঁজতে ফতুল্লা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসকের রাজস্ব সার্কেলের এসএ শাখাতেও মেলেনি কোন তথ্য! অতঃপর পানি উন্নয়ন বোর্ডে যোগাযোগ করা হলেও খালটির অস্তিত্ব সম্পর্কে কাগজে-কলমে কোন প্রমাণ মিলেনি।

 


পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিএনডি সেচ উপ-বিভাগের কার্যসহকারী মো. মশিউর রহমান এই বিষয়ে জানান, ‘ইসদাইরে খাল ছিলো। সেটা ড্রেন হয়ে হয়ে আছে। সমস্যা হচ্ছে খালের পেপার দরকার হয়। ম্যাপে থাকতে হয়। কিন্তু ওই খালটির ক্ষেত্রে সেটা নেই। পূর্বের আরএস ও সিএস জরিপের মধ্যে আমরা সেখানে খাল পাইনি। যেহেতু জলাবদ্ধতা রয়েছে, সেহেতু স্থানীয় বাসিন্দাদের বলা হয়েছে, তারা নিজেরা ঠিক করুক কিভাবে কী করবে, কারণ নকশা ছাড়াতো একটি জায়গায় লাল দাগ দেয়া যায়না।’

 


এক সময়ের প্রাণবন্ত ওই খালটি নকশাভুক্ত কেন হলো না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘খাস খাল হলে সেটি নকশার মধ্যে থাকে। ওই নকশার উপর ভিত্তি করে সেখানে লাল দাগ দিতে পারি। কিন্তু নকশায় যদি কোন চিহ্নই না থাকে, তাহলে কার জায়গায় দাগ দেব। এটা ব্যক্তি মালিকানা হতে পারে তবে, ব্যক্তিমালিকানা জায়গায় খাল কিভাবে ছিলো তা নিয়েও আমরা কনফিউজ্ড।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওই খালটির বিষয়ে স্থানীয়রা একটি হ্যান্ডস্কেচ ম্যাপ আমাদের অফিসে জমা দিয়েছিলো। কিন্তু আমার মনে হয়, তারা স্থানীয়ভাবে ওই বিষয়ে একমত হতে পারেনি।’  

 


এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নকশায় থেকেও তক্কারমাঠ-সেহাচরের খালটি ডিএনডি প্রজেক্টে অর্ন্তভুক্ত হয়নি। জানা গেছে, ফতুল্লার তক্কার মাঠ এলাকা থেকে দক্ষিণে সেহাচর হাজী বাড়ি এলাকার দিকে বয়ে গেছে শতবর্ষী একটি খাল। গেলো দেড় দশক আগেও খালটি ছিলো প্রাণবন্ত। সর্বদা প্রবাহমান ওই খালটি এখন মৃত। দখল দূষণের কবলে তা সরু ড্রেনে রূপ নিয়েছে। খালের একাধিক স্থান দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি। ফলে ওই এলাকায় বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়তে হয়। দাপা ইদ্রাকপুর ও সেহাচর বাসির জন্য গুরুত্বপূর্ন এই খালটি ডিএনডি প্রজেক্টের আওতায় সংযুক্ত না হওয়ায় দখলদাররা রয়েছে বহাল তবিয়তে।

 


এদিকে, এক সময়ের প্রাণবন্ত ওই খালটির বিষয়ে তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের কাছেও। জেলা প্রশাসকের রাজস্ব সার্কেলের এসএ শাখায় গিয়েও খালটির বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, পানি উন্নয়ন বোর্ডে যোগাযোগ করা হলে ডিএনডি সেচ উপ-বিভাগের কার্যসহকারী মো. মশিউর রহমান জানান, ‘খালের কুতুবপুরের নন্দলালপুর রোলিং মিল থেকে উত্তর দিকে পাগলা রেলস্টেশনের কাছাকাছি অংশটা আমাদের অধিগ্রহণের জায়গা আছে। কিন্তু তক্কার মাঠ এলাকার দক্ষিণে সেহাচরের দিকে প্রায় ১৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ওই খালটি ডিএনডি প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হয়নি। এটি দখল হয়ে পড়েছে বলে জানতে পেরেছি। আমাদের চিন্তা ভাবনা আছে, প্রয়োজন হলে এটা  প্রজেক্টের সাথে সংযুক্ত করবো। তবে এই বিষয়ে অফিসিয়াল ভাবে এখনো কোন নির্দেশনা আসেনি।’

 


এতো গেলো তক্কার মাঠ ও সেহাচর এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের চিত্র। তবে, ডিএনডি প্রজেক্টের অর্ন্তভুক্ত হলেও ফতুল্লার প্রসিদ্ধ নলখালি খালটি এখনো দখল-দুষণের কবলে আছে। জানা গেছে, ফতুল্লার ডিআইটি মাঠের উত্তর পাশে বয়ে যাওয়া নলখালি খালটির উৎস বুড়িগঙ্গা নদী। প্রসিদ্ধ এই খালের দৈর্ঘ্য ৪ কিলো ১শ মিটার। প্রস্থে সর্বোচ্চ ৫৬ ফিট এবং সর্বনিম্ন ১৯ ফিট। খালটির মুখে ডিএনডি প্রকল্পের আওতায় পাম্প স্টেশন তৈরীর কাজ করা হলেও খালের পরবর্তী অংশ দখলমুক্ত করা হয়নি। বিএনপি নেতা শাহ-আলমের মালিকানা লালপুরের জালাল আহমেদ স্পিনিং মিল ও শাহ-ফতেহ উল্লাহ গার্মেন্টস সহ অন্তত ২০টিরও বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান এখন নলখালী খালের বুকে বিদ্যমান। এর ফলে খালের দু’পাশ থেকেই একটু একটু করে দখলের কবলে পরে এর প্রশস্ততা কমে এসেছে।

 

তাছাড়া মিলফ্যাক্টরীর বর্র্জ্যে সয়লাব হয়ে পড়া খালটি এখন মৃতপ্রায়। এর পানি প্রবাহ আগের মত নেই। ফলে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা রয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, খালের হাজীগঞ্জ অঞ্চল দিয়ে ডিএনডি প্রজেক্টের আওতায় ব্যাপক কাজ করা হলেও লালপুরের ওই অংশে এখনো কাজ ধরা হয়নি।
এই বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার এনামুল করিম দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, নলখালি খালটি ডিএনডি প্রজেক্টর আওতায় আছে। আমরা ডিসি অফিসের সার্ভের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ করে তা সেনাবাহিনীর কাছে হ্যান্ডওভার করেছি। এটার দায়িত্ব এখন সেনাবাহিনীর হাতে। এগুলো নিয়ে ডিএনডি প্রজেক্ট কর্মকর্তারা কাজ করবেন।


এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনডি প্রজেক্টের একটি সূত্র জানায়, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের ডিএনডি অধ্যুষিত এলাকার নকশা দিয়েছে। সেই নকশা অনুযায়ী তারা কাজ করে যাচ্ছেন। কোন খাল বা এড়িয়া যদি নকশা থেকে বাদ পরে, তাহলে এর দায় ডিএনডি প্রজেক্টের নয়।’
 

এই বিভাগের আরো খবর