বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

খালের মধ্যে লাশের সাথে ভাসতে থাকি : মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন মোল্লা

এন. হুসেইন রনী

প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০২২  

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঙালি জাতির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমাদের দেশ ১৯৪৭ সালে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এ নির্বাচনের মধ্যদিয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে লড়াই-সংগ্রাম চলতে থাকে।

 

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এই ভাষণের মূলকথা ছিল - ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই মর্মবাণী বাঙালিকে উদ্বেলিত করেছিল। ঢাকা শহরে শুরু হলো মিটিং মিছিল। নারায়ণগঞ্জ শহর ঢাকার পাশে হওয়াতে প্রত্যেকটি আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের রাজপথ ছিল উত্তপ্ত ।

 

 

দফায় দফায় চলে হরতাল । গতকাল ২ ডিসেম্বর শুক্রবার যুগের চিন্তা’র আয়োজনে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা’ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মুহাম্মদ নূর হোসেন মোল্লা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নুরউদ্দিন আহমেদ।

 

 

পরিচিতি: মুহাম্মদ নূর হোসেন মোল্লা’র জন্ম ১৯৫৫ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার গোদনাইল এলাকায়। তার পিতা: মরহুম মোঃ নাজিম উদ্দিন মোল্লা (মেম্বার), এবং মাতা: রত্না বেগম। ২৮ মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

 

 

প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব মুহুর্তে আপনি কোথায় ছিলেন বা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন কী?
উত্তর: মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। তখন আমি গোদনাইল হাই স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র। গোদনাইল ভূইঁয়াপাড়ায় আমার বেড়ে উঠা, লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলস্ স্টাফ কোয়াটারে বসবাস করতাম। আমি তখন ছাত্রলীগের গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী সংসদের নাট্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি এবং ছাত্রলীগ সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম।

 

 

প্রশ্ন: আপনি কখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন?
উত্তর: ২৮ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য কয়েকজন বন্ধু মিলে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের সাথে মতবিনিময় করলাম। অত:পর সকল বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নেই ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে; স্বাধীনতার জন্য লড়বো। সে লক্ষ্যে আমার এক বন্ধুর সহযোগিতায় ভারত যাওয়ার প্রস্তুত গ্রহণ করি।

 

 

প্রশ্ন: যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়ে আপনার পরিবারের অবস্থান কী ছিলো ?
উত্তর: আমি বাবা-মায়ের বড় সন্তান, তাই তারা আমার যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়ে একেবারেই রাজী ছিলেন না। আমিও ভয়ে সরাসরি বাবাকে কিছু বলতে পারিনি। তাই মা-বাবাকে কিছু না বলে গোপনে পূরবী স্টুডিও থেকে তিন কপি ছবি তুলি। তার মধ্যে এক কপি ছবির পেছনে মা’কে ছোট একখানা চিঠি লিখে, মায়ের জায়নামাজের নীচে রেখে রওয়ানা হই।

 

 

প্রশ্ন: আপনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ সম্পর্কে কিছু বলুন?
উত্তর: জুন মাসের সম্ভবত ২৬ তারিখে রাত ৮ ঘটিকার সময় আমরা ১৫ জন শাহাজালাল কোম্পানির কমান্ডার হাবিবুর রহমান (কমল) এর ছোট ভাই মিজানুর রহমান স্বপন ও সুরুজ কমান্ডার সাথে বৈদ্দ্যরবাজার থেকে লঞ্চে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে রামচন্দ্রপুর ঘাটে গিয়ে পৌছি।

 

 

পরবর্তীতে বাঞ্চারামপুর চেয়ারম্যন শামসুদ্দিন সাহেবের সহযোগীতায় এক দালালের মাধ্যমে কুমিল্লার হাতিমারা বর্ডার দিয়ে পার হওয়ার সময়; আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই পাকিস্তান বাহিনী আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং শুরু হয় গুলিবর্ষণ। সেখানে আমাদের সাথের এক সহযোদ্ধা তারাবির শহীদ হন।

 

 

এবং আমি নিজেই বার্ডারের পাশের একটি খালে পড়ে যাই। আমি খালের মধ্যে লাশের সাথে ভাসতে থাকি। পরদিন, আমাকে সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে হাপানি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ৭ দিন অবস্থান করার পর সেখান থেকে আমাদেরকে হাতিমারা ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

 

 

সেখানে ৮/৫দিন অবস্থান করার পর হাতিমারা ক্যাম্প থেকে রিক্রুটিং করে আমাদেরকে চড়িলাম ইয়ুথ ট্রেনিং ক্যাম্পে আগরতলা, ত্রিপুরা ভারত নিয়ে যায়। সেখানে ১লা জুলাই হইতে ২১শে জুলাই পর্যন্ত মোট ২১দিন ভারতীয় আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন বিভুরঞ্জন চাটার্জী ও বাংলাদেশের আর্মি ইন্সট্রাক্টর জনাব আসাদ সাহেবের নিকট থ্রী-নট-থ্রী, গ্রেনেড ও রাশিয়ান স্টেনগান চালানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।

 

 

প্রশ্ন: আপনার দেশে ফিরে আসেন কখন?
উত্তর: ট্রেনিং শেষে ২৩শে জুলাই আমাদেরকে মেলাঘর হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর হায়দার সাহেবের আদের্শক্রমে ১৩জন করে ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি।

 

 

প্রশ্ন: যুদ্ধের সময়ে আপনার টিমের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন?
উত্তর: ১৮ আগস্ট ভারত থেকে দেশে ফিরে আসি; ১৯ আগস্ট লাঙ্গলবন্দ এলাকায় পৌছি। এখানে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপারেশন অংশগ্রহণ করি। দেশে ফিরে প্রথমেই সিদ্ধিরগঞ্জ এসে রাজাকার শানু ও ইয়াকুব আলীকে খুঁজে বের করে তাদেরকে হত্যা করি। এরপর সংবাদ পাই কুমিল্লার হোমনা থানার একটি মসজিদে প্রায় দেড়শ জন পাকিস্তানি সৈন্য আছে। তখন হোমনা থানার স্থানীয় কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলাম সাহেবের অনুরোধে তাঁদের সাথে আমাদের গ্রুপের সকল মুক্তিযোদ্ধারা একত্রে হয়ে সেই অপারেশনে যোগ দেয়।

 

 

যুদ্ধ করতে করতে একসময় মসজিদের খুব কাছে চলে আসি। হঠাৎ করেই মসজিদের পাশে পাকিস্তানীদের লুকানো বাংকারে আমি পড়ে যাই। কিন্তু পাকিস্তানীরা আমাকে মেরে ফেলার আগেই আমার সহযোদ্ধারা আমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সেদিন খুব কাছ থেকে আমি মৃত্যুকে দেখেছি। যদিও আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি বেঁচে ফিরেছিলাম। কিন্তু সেই অপারেশনে আমার ২জন সহযোদ্ধা সেখানে শহীদ হন।

 

 

প্রশ্ন: বিজয়ের দিনটি সর্ম্পকে যদি আপনার কাছে জানতে চাই?
উত্তর: ১৬ ডিসেম্বরে যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, তখন আমরা যেন এক নতুন জীবন ফিরে পেলাম। এরপর নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় শাহাজালাল কোম্পানির মোঃ হাবিবুর রহমান (কমল) এবং টু-আই-সি এ্যাডঃ নুরুল হুদা সাহেবের মাধ্যমে আমি আমার গ্রুপ কমান্ডার মোছলে উদ্দিন সাহেবের কাছে অস্ত্র জমা দেই।

 

 

প্রশ্ন: আজ এই বিজয়ের মাসে আপনার অনুভূতি?
উত্তর: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে আমি ও আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধরা কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি এবং সফলভাবে দেশ শক্রমুক্ত করি। আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের নাগরিক, তাই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি গর্বিত। এছাড়াও আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট চিরকৃতজ্ঞ, কারণ তিনি আমাদের জন্য সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এছাড়াও আমি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য জনাব এ কে এম সেলিম ওসমানের নিকট কৃতজ্ঞ। তিনি আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সর্বদা সহযোগীতা করে থাকেন। আমি তার সুস্থতা কামনা করছি। বি.দ্র: বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নুরউদ্দিন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার ও তার বীরত্বগাঁথা আগামী পর্বে ০৪ ডিসেম্বর সংখ্যায় ছাপানো হবে।

এস.এ/জেসি

 

এই বিভাগের আরো খবর