শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গোদনাইলে প্রথম পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করে সর্বস্তরের মানুষ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মোল্লা

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মোল্লার লেখা গোদনাইলে প্রথম অপারেশনে তিন পাকিস্তানী সৈন্য হত্যার কাহিনী।

 

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মোল্লা  : একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষনা এবং যুদ্ধ করে পাকিস্তানীদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করার আহবান জানানোর পর আমরা গোদনাইল থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে ভারতে গিয়ে  মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

 

 

কিন্তু যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যাওয়ার আগেই আমরা গোদনাইল এলাকায় তিনজন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যার অপারেশন করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলাম। সে ঘটনা এখনো আমাদের মনে হলে অত্যন্ত গৌরববোধ করি। কারণ সে অপারেশন ছিল আমাদের এলাকায় প্রথম অপারেশন এবং পুরো অপারেশনটি হয়েছিল এলাকার সব মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর পরও সে ঘটনা আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।

 

 

আমরা গোদনাইল এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাই মে মাসের প্রথম দিকে। আর তিন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা অপারেশন হয় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে। সেই অপারেশনের পর যারা সে অপারেশনের অংশ নিয়েছিলাম তাদের অনেকেই ভারতে চলে গিয়েছিলাম প্রশিক্ষণ নিতে।

 

 

ফিরে এসেও আমরা এক সঙ্গে এলাকায় সবচেয়ে বড় অপারেশনগুলোতে অংশ নিয়েছি। আমি তখন গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণীর ছাত্র। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও কিছুটা জড়িত। এলাকায় বেশ কিছু তরুণ-যুবককে আমি নানা সামাজিক কাজে নেতৃত্ব দিতাম।

 

 

২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর ২৮ মার্চ ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধ ভেঙ্গে পাকিস্তান বাহিনী নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করেই গণহত্যা শুরু করে। এরপর তারা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প করে নীরিহ মানুষ হত্যা, নির্যাতন ও লুটপাট করতে থাকে। আদমজীতে তখন বিপুল সংখ্যক বিহারী বসবাস করতো।

 

 

আদমজী মিলের ভিতরে পাকিস্তান বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান  নেয়। সেই ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আশপাশের এলাকায় মানুষ হত্যা এবং চরম অত্যাচার নির্যাতন ও বাড়িঘরে ঢুকে লুটপাট করতো। স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে বিভিন্ন পাড়ায় হামলা করে স্বর্ণ, ছাগল, মুরগীসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র লুটপাট করা তাদের নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়ায়।

 

 

তাদের অত্যাচারের ফলে এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। এলাকার সব বয়সের মানুষ এ নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। একই সঙ্গে সবাই পাকিস্তান বাহিনীর উপর চরম ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু একটা করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। তেমন সুযোগ এসে যায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে।

 

 

একদিন আদমজী ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে তিনজন পাকিস্তানী সৈন্য গোদনাইল ভূঁইয়াপাড়া এলাকায় গিয়ে লুটপাট করতে থাকে। বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট করার পর লোকজন চরম বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে তিন সৈন্যকে ধাওয়া করে। ধাওয়া খেয়ে সৈন্যরা ভয়ে রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে করতে ভূইয়াপাড়া থেকে  নারায়ণগঞ্জ-আদমজী সড়ক দিয়ে ধনকুন্ডার দিকে পালাতে শুরু করে।

 

 

তাদের উদ্দেশ্য ছিল গুলিবর্ষন করতে করতে দ্রুত হেটে আদমজীতে তাদের ক্যাম্পে চলে যাওয়া। তাদের পিছনে পিছনে অসংখ্য মানুষও আসতে থাকে। সৈন্যরা গুলি করলে সবাই সড়কের ঢালে শুয়ে পড়ে গুলী থেকে নিজেদের রক্ষা করে।

 

 

এভাবে গুলি করতে করতে তিন পাকিস্তানী সৈন্য যখন ২নম্বর ঢাকেশ্বরী বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে আসে তখন ছিলাম জালকুড়ি সড়কে আমাদের এলাকায়। লোকজনের হৈচৈ শুনে আমি দৌড়ে প্রধান সড়কে এসে ঘটনার মুখোমুখি হই। আমি ও এলাকার সমবয়স্ক আরো কয়েকজন যুবক সেই সৈন্যদের পিছু পিছু যেতে শুরু করি। কিন্তু সৈন্য মাঝে মাঝে গুলি করছে বলে একেবারে কাছে যেতে পারছিলাম না কেউ।

 

 

তিন পাকিস্তানী সৈন্য ধনকুন্ডা মসজিদের কাছাকাছি আসার পর এলাকার দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি আবদুল জব্বার ও আইয়ুব আলী মোল্লা সড়কে দাঁড়িয়ে উর্দু ভাষায় কথা বলে সৈন্যদের সেখানে দাঁড় করায়। ওদের থামিয়ে উর্দুতে ওদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তারা দুজন ভালো উর্দু বলতে পারতো।

 

 

তারা দুজন সৈন্যদের অভয় দিয়ে পুরো উর্দুতে বলতে থাকে- তুমিও মুসলমান, আমরাও মুসলমান, কোন ভয় নেই, তোমরা এখানে দাড়াও, আমরা আছি তোমাদের পক্ষে। উর্দুতে কথা শুনে সৈন্য তিনজন বেশ আশ্বস্ত হয়ে থেমে তাক করা রাইফেল নামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে জব্বার ভাই ও আইয়ুব আলীর  সাথে কথা বলতে শুরু করে।

 

 

সৈন্যরা বন্দুক কাধে ঝুলিয়ে কথা বলছিল। ঠিক এ সময়ে আমি, আলাউদ্দিন, মফিজউদ্দিন, আলী আহমদ, ফজলুল হক ফজল, নজরুল ইসলাম নজু, কেরামত আলী, মোহাম প্রমুখ সৈন্যদের চারপাশে ঘিয়ে দাঁড়াই।

 

 

জব্বর ভাই ও আইয়ুব আলী সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ইশারায় ওদের উপর হামলা করার ইঙ্গিত দেন। এরপরই আমি, আলাউদ্দিন, নজু, ফজল, ফরিদ, মফিজউদ্দিনসহ কয়েকজন তিন সৈন্যকে ঝাপটে ধরে তিনটি রাইফেল কেড়ে নিতে চেষ্টা করি। সৈন্যরা এমনভাবে রাইফেল আকড়ে ধরেছিল যে তা ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছিলনা।

 

 

এরই মধ্যে আলাউদ্দিন কৌশলে রাইফেলের মাথা থেকে একটি বেয়নেট খুলে নিজের হাতে নিয়ে নেয়। সৈন্যদের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তির মধ্যেই আলাউদ্দিন এক সৈন্যের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেয়। একই সঙ্গে আমরা এলোপাথারি  তিনজনকে পিটাতে শুরু করি।  

 

 

ইতিমধ্যে আরো অনেক লোক ছুটে সেখানে চলে আসে। সবাই মিলে আমরা দা, চাকু, বেয়নেট দিয়ে তিন সৈন্যকে আঘাত করতে শুরু করি। কয়েকজন সৈন্যদের রাইফেল টেনে ছিনিয়ে নিয়ে যাই। এক পর্যায়ে তিন জনই নিস্তেজ হয়ে মাটিয়ে পড়ে যায়। রক্তে পুরো সড়ক ভেসে যান।

 

 

কিন্তু অবাক ব্যাপার যে, সেই সময় সে সড়ক দিয়ে কোন গাড়িই আসেনি। অন্য সময় কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানী সৈন্যদের গাড়ি সে এলাকা দিয়ে টহল দিত। কিন্তু আমাদের সে অপারেশনের সময় আর্মির গাড়িতো দূরের কথা ,সাধারণ কোন গাড়িও সে সড়ক দিয়ে আসেনি।

 

 

কিন্তু কিছুক্ষণ পরই কে যেন চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে আর্মি আসছে, সবাই পালাও। এ কথা শুনে যে যে ভাবে পারে সড়ক থেকে সরে গিয়ে বাড়ি গাছের আড়ালে পালিয়ে থাকি। কিন্তু আর্মি আসার খবরটি সঠিক ছিলনা। আমরা আবার সেখানে এসে তিন সৈন্যের লাশ সরিয়ে ওয়াপদা খালের পাড়ে নিয়ে কাদা মাটি দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে দেই।

 

 

এলাকার বেশ কয়েকজন মহিলা, তাদের মধ্যে ছিলেন আলাউদ্দিনের মা, আহমদের মা, জয়নব বেগম প্রমুখ কলসি ভরে পানি এনে ঝাড়ু দিয়ে সড়কের রক্ত পরিস্কার করে ফেলে। অপারেশন শেষ করে আমরা জালকুড়িতে আমাদের গোপন আস্তানায় চলে যাই।

 

 

কিন্তু রাতে হঠাৎ মনে হলো যদি পাকিস্তানী আর্মি এদিকে এসে লাশ খুজে পায় তবেতো এলাকার সবাইকে মেরে ফেলবে। ভয়ে আমরা রাতে আবার ওয়াপদা খালে এসে সেই লাশ কাদামাটি চাপা দেয়া থেকে তুলে চট দিয়ে বেধে রিক্সায় তুলে দুই নম্বর গুদারা ঘাট দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেই।

 

 

পরদিন আদমজী ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা এলাকায় এসে যাকে সামনে পায় তাকেই ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তিন সৈন্য কোথায় গেল তা আর জানতে পারেনি। পরে এলাকার অনেক বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানী সৈন্যরা। সে ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা দল বেধে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য আগরতলা চলে যাই।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর