বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চাই বুনায় ৫১ বছরের ঐতিহ্য বক্তাবলীবাসীর

রাকিবুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩ জুলাই ২০২২  

 


জেলার শহর থেকে পঞ্চবটি হয়ে বক্তাবলী ঘাটে যেতে হয়।ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে ইমরান নামের এক যুবককে জিজ্ঞেস করতেই লক্ষীনগর এলাকায় যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। কিছু দুর এগিয়ে আসতে একজন বলে কোথায় যাবেন। পরে পিছনে পিছনে ওই ব্যক্তি এসে বক্তাবলীর লক্ষীনগর গ্রামটি দেখিয়ে দেয়। এখনও এলাকাটি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। গ্রামটির কথা সবার মুখে মুখে। কেননা নারায়ণগঞ্জের একমাত্র এই এলাকায় মাছ শিকারের চাই তৈরী হয়। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বক্তাবলীর ইউনিয়নের লক্ষীনগর গ্রাম। এই এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের জন্য তৈরী হচ্ছে চাই, বুচনা। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী এখানকার চাই দেশের প্রায় ২০ থেকে ২৫ টি জেলায় সরবরাহ করা হয়। যা প্রায় তাদের ৫০ বছরের ঐতিহ্য।


এখন বর্ষা মৌসুমে নদী নালা খাল বিলে নানা প্রজাতির দেশিও মাছের উপস্থিতি দেখা মিলে। এই মাছ শিকারের জন্য তৈরী হচ্ছে চাই, বুচনা। লক্ষীনগরের নারী পুরুষ থেকে শুরু করে শিশু বৃদ্ধরা পর্যন্ত এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। বছরের বর্ষার মৌসুমে ৫ মাস সবচেয়ে বেশি চাই তৈরীর কাজে ব্যস্ত সময় পার করে এ গ্রামের মানুষ। নানা আাকারে তৈরী মাছ ধরার ফাদ গুলোর রয়েছে বিভিন্ন নাম, কোনটিকে বলা হয় চাই, আবার কোনটা বুচনা এবং গোড়া বলা হয়। এগুলো বিভিন্ন মূল্যে নারায়ণগঞ্জের আশ পাশের এলাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। চাই, বুচনা তৈরী কারকদের দাবী বছর দুয়েক ধরে আগের মত বিক্রি হয় না। বিভিন্ন কারনে চাই এর চাহিদা কমে গেছে।


আলাপ চারিতার এক পর্যায় হুমায়ুন ফকির জানান, আমার বয়স ৬৮ হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে লক্ষীনগর গ্রামে চাই তৈরীর কাজ শুরু হয়। আমার দাদা ইউসুফ ফকির সর্ব প্রথম এ গ্রামে এ চাই তৈরীর কাজ শুরু করেন। তিনি তার নানাী বাড়ী মুন্সিগঞ্জের কাচারী থেকে এ কাজ শিখে এলাকায় তা তৈরী করা শুরু করেন। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে এখন অবদি পর্যন্ত আমাদের বংশে চাই বুনা তৈরীর কাজ চলমান আছে। সেই সাথে আমাদের পুরো গ্রামের প্রতিটি পরিবারে ডাইরেক ইনডাইরেক ভাবে নারী পুরুষ মিলে প্রায় ১ হাজার লোক এ কাজের সাথে জরিত। আমি নিজেও এখনো এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছি। কাজ করলে আমার শরীর ভালো থাকে। একই সাথে টাকাও আয় হয়। তাই এখনো এ কাজ ধরে রাখছি।


তার পাশে চাই তৈরীর কাজে কর্মরত আলাউদ্দিন বলেন, আমি প্রথমে আমাদের গ্রামের পাশের বাড়ীতে রোজ ৩০০ টাকা হিসেবে কাজ করতাম, বর্তমানে তা বেরে এখন ৫শ’ টাকা হয়েছে। এ কাজ পুরোপুরি শিখার পর নিজে বিনিয়োগ করে এখন আমি প্রায় দের হাজার চাই বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করি। আমার এখানে রোজ ৫শ টাকায় ৪ জন কারিগর কাজ করে। তিনি বলেন, বছর দুয়েক আগেও ৩ হাজার চাই বিক্রি করতাম। ২ বছর ধরে এক ধরনের চায়না ধার জাল বের হওয়ার পর থেকে আমাদের চাইয়ের চাহিদা কমে যায়। আর এজন্য আমাদের আগের মত বিক্রি নেই। সেই সাথে কমে গেছে আয়। ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার মাধ্যমে বছরে  আমার ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা আয় হয়।


লক্ষীনগরবাসি শাহপরান বলেন, একটি মুলি বাশ দিয়ে একটি চাই তৈরী করা যায়। এই চাই তৈরীর জন্য প্লাষ্টিক সুতো, মুলি বাশ ব্যবহার হয়। সেলিনা নামে এক নারী বলেন, আমরা দীর্ঘ দিন যাবত চাই তৈরীর কাজ করে আসছি। গ্রামের বেশির ভাগ নারীরা এই কাজের সাথে জরিত। একটা চাই বানাতে হলে প্রথমে মুলি বাশ কেটে শলা করি, পরে তা শুকিয়ে ঘষে ধার মজাই, এই শলাকে ঠোল বানিয়ে খালি চাক তৈরী করা হয়, এই খালি চাককে আরেক নারী তা শিলি দেয়, পরে এই চাকে পুরুষরা জিহবা বসায় এবং সর্বশেষ চাইয়ে চান্দা লাগিয়ে স্পূর্ণ একটি চাই তৈরী হয়। এই প্রসেসিং গুলো শেষ করতে ৫ থেকে ৬ জনের হাত বদলি হয়। পরে তা বাজারে বিক্রি করা হয়। আমাদের এ গ্রাম থেকে চাদঁপুর, বরিশাল, মেঘনা, মুন্সিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা, পঞ্চগর, চট্রগ্রাম, ঢাকার কেরানিগঞ্জ সহ দেশের প্রায় ২৫ টি জেলায় এই চাই বিক্রি হয়।


শাহিন জানান, করোনার কারনে আমাদের চাই বিক্রি আগের থেকে কমে গেছে। গতবছর থেকে লকডাউনের কারনে বিভিন্ন জেলা তা সরবরাহ করতে পারি নাই। এতে করে আমাদের অনেকটা ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে। হাতে বুনা এই কুঠির শিল্প শ্রমিকরা করোনার সময় সরকারি বেসরকারি কোন সহযোগিতা পায় নাই বলে জানান তারা। বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, আমরা তাদের বিষয়ে খোজ খবর নিয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি।এমই/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর