বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

চাল চোরাদের কব্জা এবং কিছু কথা

প্রকাশিত: ১৫ এপ্রিল ২০২০  

মীর আব্দুল আলীম : চোর দুর্নীতিবাজদের কোন নীতি নেই; প্রীতি নেই। দল আছে, শক্তি আছে; আছে ক্ষমতা। মৃত্যুর ভয় নেই; করোনাভাইরাস আতংক নেই। তাই ক্ষুধার্ত মানুষের চাল চেটে খাচ্ছে। এই মুহূর্তে চাল চোরাদের কব্জা চাই; নিদেন পক্ষে চোরাদের একটা আঙ্গুল চাইই চাই। আইন হাতে তুলে নিয়ে নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদে এমন আইন পাশ করার দাবি তুলছি আমরা।


ওরা কতটা নির্লজ্জ, বেহায়া। গরীবের ত্রাণের মাল লুটে নিতে ওদের কষ্ট নেই; লাজ-লজ্জা নেই। ওরা যে লুটেরা, চোরা, চাটার দল। দেশ স্বাধীনের পর থেকে ওরা চাটছে কেবল। দেশটার জন্মের পর থেকেই চোর ছেঁচড়ার দল গরীবের হক্ চেটেপুটে খাচ্ছে। আসলে চটাদের দল নেই। সময় বুঝে সব দলের হয় ওরা।

 

ওরা সব সময় সরকার দলের! কখনো আওয়ামীলীগ, কখনো বিএনপি, জাতীয় পার্টির হয়ে চাটাচাটি করে। দেশ স্বাধীনের পর জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু এই চাটার দলের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষেভে সমাবেশেই বলেছিলেন-‘আমি ভিক্ষা করে বিদেশ থেকে আনি আর চাটার দল চেটে খায়”। বঙ্গবন্ধু ৭৫ সালে বলেছিলেন-“দীর্ঘ তিনি বছর পর্যন্ত আমি এদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি।”

 

বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বারবার চোর দুর্নীতিবাজদের হুঁশিয়ার করে যাচ্ছেন। এবার হুঙ্কার দিয়েও ত্রাণ লুট বন্ধ করতে পারেননি। ঐ যে চোর নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী! স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরকারবারি, মুনাফাখোরী বাংলার দুঃখী মানুষরে জীবনকে অতষ্ঠি করে চলেছে। করোনাভাইরাস সংকটের সময় মৃত্যুও মুখোমুখী দাঁড়িয়েও তারা রূপ বদলাতে পারছে না। স্বরুপে ফিরছে বারবার।


করোনাভাইরাসে যখন মানুষ অসহায়, কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই; বৈশ্বিক এই মহামারী মোকাবিলায় নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে সরকার। দেশকে চাঙ্গা রাখতে প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। গরীব মানুষের যাতে খাদ্যেও কষ্ট না হয় এ জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।

 

আর কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী অসহায় মানুষের এসব ত্রাণ লুটপাটে বেপরোয়া হয়ে পড়েছে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র, যাদের সাথে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের জড়িত থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ত্রাণ চুরির ঘটনা। আর এই সকল ত্রাণ চুরির সাথে জড়িত প্রায় সবাই সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা।

 

যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের দুয়ারে খাবার পৌছানোর ব্যবস্থা করেছেন, তখন ঐ চাল চোরের দল ত্রানের মাল লুটেপুটে খাচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি চরম ক্ষুবদ্ধ হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে চাল চোরাদের জেল জরিমানারও নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী দেশের সংকটময় সময় পার করতে দেশের জন্য কাজ করবেন নাকি উল্টো চাল চোরাদের ঠেকাবেন। হায়! কতইনা আজব দেশ এই সোনার বাংলাদেশ।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ত্রাণ চোরাদের সাজারও নির্দেশ দিয়েছে। আসলে এমন সাজায় সোজা হবে না চাটা চোরের দল। ইসলামী কানট্রিতে চুরির সাজায় হাতের কব্জি কেঁটে নেয়া হয়। কখনোবা হাতের আঙ্গুল। অমানুষদের জন্য এমন সাজাই চাই। জাতীয় সংসদে সে  আইনটা পাস করলে রাষ্ট্র প্রধান বাহবা পাবেন  বৈকি! প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ক্ষেপেছেন এমন আইন পাস করেও ফেলতে পারেন তিনি। াার তাঁর কাছে এ মূহুর্তে আমরা এমন প্রত্যাশাই করছি আমরা।


জনপ্রতিনিধি সহজ কথা নয় কিন্তু! এরা চোর হলে দেশের কি হবে? সরকার কঠোর হওয়ায় এমন কর্মকান্ডে যুক্ত থাকায় গ্রেফতার হয়েছে বেশ কজন প্রভাবশালী নেতা। দায়িত্বশীল নেতাদের এমন আচরণে ম্লান হচ্ছে সরকারের সব অর্জন। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।

 

তাদেও অনেকে বলছেন, করোনায় অসহায় ও নিম্ন আয়ের মানুষের ত্রাণ লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রকৃতই ত্রাণ সহায়তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা কাজে আসছে না। গত কয়েক দিনে সারাদেশে উদ্ধারকৃত সরকারি চালের পরিমাণ তার প্রমাণ মেলে। সরকারের কথা, ‘সহযোগিতা যেন সবাই সমানভাবে পায়। এ জন্য তালিকা তৈরি করে ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। এই কাজে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।’ তবুও কি থামছে ওরা? সরকার প্রধানের এমন বক্তব্যের পরও থেমে নেই ত্রাণ লোপাটের ঘটনা।

 


এ অবস্থায় কি করবে সরকার? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। অভিযোগ ওঠা জনপ্রতিনিধিদের বিষয়ে তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবেদন চেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকদের কাছে প্রেরণ করেছে। ত্রাণ সহায়তা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত জনপ্রতিনিধি, কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও ফৌজদারি মামলা করা হবে বলে নির্দেশনায় বলা হয়েছে।

 

করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার তিন দফায় বাড়িয়েছে সাধারণ ছুটি। দীর্ঘদিন কাজকর্ম না থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছে দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবী এই সকল মানুষের পাশে দাড়িয়ে প্রশাসন প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছে। কতকের ক্ষেত্রে ত্রাণ বিতরণে কিছুটা ভিন্নচিত্রও রয়েছে। দেশের বেশকিছু স্থানে ইউপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা ত্রাণ বিতরণের নামে আত্মসাৎ করছেন। কিন্তু ওই সকল অঞ্চলের দিনমজুর মানুষের মাঝে বাড়ছেই ত্রাণের জন্য হাহাকার।

 


সৎ নেতাদেও হুঙ্কার থেমে নেই। সরকার দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দীন নাছিম সম্প্রতি বলেন, ‘কোনো দুর্নীতিবাজের স্থান আওয়ামী লীগে নেই। এ বিষয়ে আমরা জেলা উপজেলা নেতাকর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে এই ধরনের অভিযোগে আমরা ক্ষুব্ধ।’

 

অপরদিকে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, এই করোনা ভাইরাসের মহামারী চলাকালে অসহায় মানুষদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাত করে তারা মানুষ না। এদের মানুষ বলা যায় না, এরা মানুষরূপী জানোয়ার। এদের প্রতি আমি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ  করেন তিনি।

 


দেশে দুর্নীতি রন্দ্রের রন্দ্রে প্রবেশ করেছে। দুর্নীতি রোধ হওয়া দরকার। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে এটা ভালো কথা তবে তা যেন বর্জ আটুনি ফঁস্কা গিড়ু না হয়। সরকারকে দুর্নীতি বন্ধে কঠের হতেই হবে। তা না হলে পদ্মা সেতু, দেশজুড়ে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলে, এক্সপ্রেসওয়ে, পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ সকল উন্নয়ন প্রাপ্তি ভেস্তেই যাবে। দুর্নীতি রোধে সরকারকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। খুঁজে খুঁজে দুর্নীতিবাজদের বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

 

দেশের সাধারন ব্যক্তি থেকে শুরু করে মন্ত্রী এমপিরাও দুর্নীতি করলে যেন কেউ রেহাই না পায় তার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। করতে হবে কঠোর আইন প্রনয়ণ এবং এর প্রয়োগ। দেশে দুর্নীতি রোধে সবসময়ই ভালো ভালো উদ্দোগ নেয়া হয়। কাজের বেলায় দেখা যায় ঠন্ঠনাঠন্। দুর্নীতি রোধে অনেক আওয়াজ ওঠে কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ হয় না।

 

ধরাছোয়ার বাইরে থাকে দুর্নীতিবাজরা। এবার যেন তা না হয় এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তবে এবার একটু আশার আলো দেখছি আমরা। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। আগাছা পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে দুর্নীতিকে উচ্ছেদ করতে হবে। যদি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, কোথা থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে? এ ব্যাধি থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের বেশকিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করা এবং উন্নয়ন ঘটানো। এ জন্য আমাদের রাজনীতিক, মন্ত্রী, আমলা আর দেশের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনেরও কোনো বিকল্প নেই।


কেবল এদেশেই দুর্নীতি হয় তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর সবদেশেই কম বেশি দুর্নীতি আছে, এই কথাটির আপেক্ষিক সত্যতা মেনে নিয়েও, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতির ব্যাপকতাকে অস্বীকার করার কোনো অজুহাত নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, এই দুর্নীতি জনগণের মনে ব্যাপক হতাশাবোধের জন্ম দিয়েছে।

 

দুর্নীতির এই সবগ্রাসী থাবা থেকে কীভাবে মুক্ত হওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে যে কেন দুর্নীতি হয় বা দুর্নীতি বিস্তারের প্রক্রিয়া কীভাবে বৃদ্ধি পায়। সেখানে আগে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে। সার্বিকভাবে দেখলে দুর্নীতির ব্যাপকতার সাথে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি সম্পর্ক আছে। এই অবক্ষয় রোধ করতে হবে।

 

জনগণের কাছে এই ধারণা ক্রমেই দৃঢ় হয়েছে যে, সমাজে নীতিবান হয়ে থাকার মাঝে কোনো গৌরব নেই বরং আছে বহু ভোগান্তি। সমাজের সুশীল অংশেও ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে বেআইনি পথে থাকার সুবিধা রয়েছে অনেক। জনগণের মনে এই ধারণা যত ক্রমবিকাশমান হচ্ছে, হতাশা ততো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে আমজনতার বিরূপতা অনেক বাড়ে যাচ্ছে। এই হতাশার ফল ধরে আমরা হয়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ।


দুর্নীতি আর চোর চাটাদের এ পঁচা দুগন্ধ আমাদের দেশের গায়ে আর না লাগুক। দুর্নীতি দেশ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাক। এদেশ হউক দুর্নীতি মুক্ত সোনার বাংলাদেশ। দেশের ১৬ কোটি মানুষের এটাই চাওয়া।
-লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট।

এই বিভাগের আরো খবর