শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছোট ভাই-বড় ভাই ইস্যুতে আর কত ঝড়বে প্রাণ

রাকিবুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২২  

 

# কিশোর অপরাধ বেড়েই চলছে
# অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে
# ছেলে-মেয়েদের দিকে নজর রাখতে হবে : এসপি

 

 

বাবা মৃত রুবেল শেখকে  হারিয়ে মাকে নিয়ে ছেলে রাকিব এবং সাকিব নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা দাপা ইদ্রাকপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন আজাদ মিয়ার বাড়ীর গলির ওহাবের বাড়ীর ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছেন। কিশোর সাকিব (১৪) আরেক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আঘাতে খুন হয়েছে ফতুল্লায়। ঘটনাস্থল তার বাড়ির পাশে ফতুল্লা রেলস্টেনের সামনে। আশপাশের মুদিদোকানি, লন্ড্রি, চা-বিক্রেতা কেউ এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো কথা বলছে না সবাই ভীত আতঙ্কিত হয়ে আছে।

 

একপর্যায়ে অবশ্য গোপনীয়তা রক্ষার শর্তে মুখ খুলেছেন। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যক্তি জানান, একদল কিশোররা এসে সাকিবের উপর চড়াও হয়ে হামলা করেন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী তারা এর এগে ছোট ভাই বড় ভাই ইস্যু নিয়ে চাষাঢ়ায় নিহত সাকিবের বন্ধুদের সাথে তর্ক বিতর্ক হয়। 

 
ফতুল্লা রেলস্টেশনে ছুরিকাঘাতে সাকিব (১৪) নামে এক কিশোর হত্যা করা হয়। এই  ঘটনায় ২ তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ। শনিবার (২৫ জুন) সকালে অভিযান চালিয়ে যাত্রাবাড়ি থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ফতুল্লা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ রিজাউল হক দিপু এই তথ্য জানান। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ফতুল্লা স্টেশন এলাকার জনুর ভাড়াটিয়া মো. রফিকুল ইসলামের ছেলে আতিকুল (১৭) ও দাপা ইদ্রাকপুর এলাকার হবুর বাড়ীর সেকান্দার মোল্লার ছেলে ইসলাম মোল্লা (১৮)।


এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর তদন্ত) মো, সাইফুল ইসলাম জানান, ছুরিকাঘাতে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর খুন হওয়ার ঘটনায় ২জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিহত সাকিবের মা নাসিমা বেগম বাদী হয়ে ৫ জনের নামে ১৪৩/৩২৩/৩০২/ ৩৪ ধারায় পেনাল কোডে মামলা হয়। যার মামলা নম্বর ৬৭। ফয়সাল(১৮), পারভেজ (২২), আতিকুল(১৭), ইসলাম মোল্লা(১৮) ও সোলেয়মান(১৮) সহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে।

 

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি, গতকাল চাষাঢ়ায় নিহত সাকিবের বন্ধুদের সাথে তর্ক বিতর্ক হয়। পরে রাতে সাড়ে ১০টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে সাকিবসহ তার বন্ধুদের পথরোধ করে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহতি হয়। পরে সেখানেই সাকিব ছুরিকাঘাত হয়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা সাকিবকে মৃত ঘোষনা করেন।

 

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফতুল্লা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হুমায়ুন কবির (ফোর) জানান, নিহতের মা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছে। মামলার এজাহারনামীয় দুই আসামী কে শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার স্বীকার করেছে। জড়িত অপর আসামীদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যহাত রয়েছে বলে তিনি জানান।

 

এদিকে এর আগে গত (১৭ মে) রাতে ফতুল্লার ইসদাইরে রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ধ্রুব (১৫) নামে দশম শ্রেনীর এক ছাত্রকে কিশোরগ্যাং গ্রুপ ছুরি দিয়ে এলোপাথারিভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনার মূলে বড় ভাই ছোট ভাই নিয়ে দুই গ্রুপের মাঝে তর্কবিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে কিশোর ধ্রুবকে বাসা থেকে ঢেকে নিয়ে ইসদাইর রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। একই সাথে নগরীর রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে গত মাসের ২২ মে নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে শুব্রত নামে এক কিশোরকে বাসা থেকে একদল কিশোরগ্যাং তাকে আঘাত করে হত্যা করে। অভিযোগ রয়েছে হত্যাকারী কিশোরগ্যাং কাউন্সিলর মনিরের লোকজন। নিহত শুব্র নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর মনিরের পক্ষে কাজ না করায় তাকে হত্যা করা হয়। তবে এলাকাবাসী বলছে এই দুই বাহিনীর মাঝে তার আগেও মারামারি হয়েছে। তখন মামলা হলেও কেউ গ্রেপ্তার হয় নাই।

 

সচেতন মহল বলছেন এই অপরাধীদের পিছনে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের শেল্টার রয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন নগরবাসী। কিশোরগ্যাং অপরাধ যেন কোন ভাবেই কমছে না। দিনকে দিন বেরেই চলছে কিশোর অপরাধ। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে কিশোররা অপরাধে জরিয়ে পড়ছেন। প্রশাসন থেকে প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার জন্য আহবান জানালেও তা যেন তাদের কানে আর যাচ্ছে না। তাই এবার সচেতন মহল প্রশ্ন তোলেন আর কত প্রাণ ঝড়লে মানুষ সচেতন হবে। এই ভাবেই বা আর কত প্রাণ ঝড়বে। এখনি ব্যবস্থা না নেয়া হলে  কিশোর অপরাধ যেন থামানো যাচ্ছে না।

 

খোঁজ নিয়ে জানাযায়, কিশোর গ্যাংগুলোয় নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরেরা যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোরেরাও। তারা চলে দলেবলে। রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সুমন নামের এক শিক্ষার্থী জানান, যাদের যখন প্রাধান্য, তখন তারা বড় ভাই। তারা অন্যায় করলেও চুপ করে থাকতে হবে। নইলে বেয়াদবি করার দায়ে মার খেতে হবে, হয়রানির শিকার হতে হবে, রাস্তায় বেরোলে টিটকারী শুনতে হবে। তাছাড়া এলাকায় নিয়ে বড় ছোট প্রভাব নিয়ে কিশোরগ্যাং অপরাধ  বেড়েই যাচ্ছে।

 

আরেক ছাত্র জানায়, মেয়েদের নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। সহপাঠী, বন্ধু বা বন্ধুর বোনের মতো কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখলে ‘বড় ভাই’ ও তার দলের ছেলেদের হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আসলে নিজেকে বাঁচাতে অনেকেই একটা না একটা দলে ভিড়ে যায়। একেবারে সক্রিয় না হলেও অন্তত একটা যোগাযোগ রাখতে হয়।

 

গ্যাং কালচার নিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ অনেক বছর আগে যে গ্যাং কালচারের সূত্রপাত, তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নতুন এই সংস্কৃতির সাথে । এই কিশোরেরা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। এই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ সবকিছু আলাদা। এই সমাজের যারা সদস্য, তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। পেশী শক্তি দেখিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা, দলে-বলে চলা এদের বৈশিষ্ট্য।

 

অবাক হওয়ার মতো তথ্য হলো, স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিশু-কিশোরেরা যে এমন বিপন্ন একটা জীবন কাটাচ্ছে, অভিভাবকেরা সেই খবর রাখেন না। স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষও জানে না।

 

জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, ‘কিশোর অপরাধের মারামারি ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে। এই অপরাধ থেকে বাচঁতে হলে পাড়া মহল্লার মুরুব্বি থেকে শুরু করে পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। সেই সাথে ছেলে মেয়েদের দিকে নজর রাখতে হবে। সেই সাথে ছেলে সন্তানরা তারা কোথায় যাচ্ছে কি করছে তা নজর দারি করতে হবে। শুধু আই প্রয়োগ করে সবকিছু নিয়ন্ত্রন কার যায় না। যারা অপরাধের সাথে জরিত আমরা তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করি । বাকিটা আদালতের বিষয়। তবে অপরাধের সাথে জরিত থাকলে কেউ ছাড় পায়া না।’এমই/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর