শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জহির রায়হানের অন্তর্ধান হত্যাকাণ্ড রহস্য

করীম রেজা

প্রকাশিত: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩  



জহির রায়হান বাংলাদেশের একজন বীর সন্তান। নন্দিত, বন্দিত, কীর্তিত কথা সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৩৫ সালের ১ শে আগস্ট ফেনীর মাজুপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। কলকাতার বিখ্যাত মিত্র ইন্সটিটিউটে পঞ্চম শ্রেণিতে ছাত্র থাকা কালে বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের প্রভাবে প্রথম রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসেন জহির রায়হান।

 

 

যার প্রভাব তিনি জীবন ব্যাপী বহন করেছেন, লালন করেছেন, চিন্তা চেতনায় ধারণ করেছেন। সেই সময় তিনি কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়  'স্বাধীনতা পত্রিকা' ফেরি করে বিক্রি করতেন । তার বাবা ছিলেন মাওলানা হাবিবুল্লাহ, কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক।

 

 

ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে তিনি পড়ছেন। সেই সময় বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের সুবাদে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির রীতি অনুযায়ী তখন প্রত্যেক কর্মীর পার্টির দেওয়া একটি আলাদা নাম থাকতো। মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ'র পার্টি নাম রায়হান রেখেছিলেন মণি সিংহ। তারপর থেকে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ দিনে দিনে পরিচিত হয়ে উঠলেন জহির রায়হান নামেই।
 

 

১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের মিছিলে যে দশ জনের দলটি সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া জহির রায়হান।  লেখালেখির পাশাপাশি চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের আগমন ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাভেরা চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হয়ে।  

 

 

পুরোপুরি পরিচালক হিসেবে  অভিষেক ১৯৬১, 'কখনো আসেনি' চলচ্চিত্র নির্মাণের দ্বারা। জহির রায়হান মূল আলোচনায় আসেন ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৬৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারে ভূষিত হয় কাঁচের দেয়াল। জহির রায়হান পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মাননা।
 

 

জহির রায়হানের হাতেই তৎকালীন পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রথম রঙিন চলচ্চিত্রের জগতে প্রবেশ করে। ১৯৬৪ সালে তিনি নির্মাণ করেন উর্দু ছবি 'সঙ্গম', যা ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র।  একই বছরে প্রকাশিত হয়েছিল তার রচিত কালজয়ী উপন্যাস 'হাজার বছর ধরে'। এই উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন জহির রায়হান।

 

 

১৯৭০ সালে তিনি নির্মাণ শুরু করেছিলেন বহুল আলোচিত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’।   চিত্রনাট্য ছাড়া এই চলচ্চিত্রের প্রতি দৃশ্য থেকে সংলাপ সবই ছিলো জহির রায়হানের উপস্থিত মেধায় রচিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চলচ্চিত্রটির নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। চিত্রনাট্য না থাকার কারণে ছবিটি আজও পর্যন্ত অসমাপ্ত।

 

 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান ভারতের কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। শুরু করেন তার বিখ্যাত স্টপ জেনোসাইড তথ্যচিত্র তৈরির কাজ। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে তার নির্মিত 'স্টপ জেনোসাইড'কে।  ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্ব জনমত তৈরির ক্ষেত্রে 'স্টপ জেনোসাইড' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
 

 

 

স্বাধীনতার আগে তিনি এক অসাধারন গল্প দিয়ে তৈরি করেন জীবন থেকে নেয়া  নামে সিনেমা। বাঙালির স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্খা মূর্ত হয়েছিল সেই ছবিতে। একটি পরিবারের গল্পের আবরণে তিনি দেশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন, প্রতিবাদের শক্তি অর্জনের প্রেরণার কথা বলেছেন।

 

 

পরে কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া'র কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহাদের মতো নির্মাতারা। চলচ্চিত্রটি দেখার পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, 'এ এক অনন্য প্রতিভা, চলচ্চিত্রে এক নতুন যাত্রার সূচনা হলো। এক দুর্দান্ত প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের মাইলফলক (প্রআ)।'
 

 

 

দেশ স্বাধীনের পর ভারত থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন জহির রায়হান।  এসেই জানতে পারেন  অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের নিখোঁজ হওয়ার কথা। নানা উপায়ে তিনি ভাইয়ের সন্ধান করতে থাকেন। সামান্যতম কোনও সূত্রও তিনি অবহেলা করেননি।

 

 

ছুটে গিয়েছেন তাকে উদ্ধারের জন্য, ফিরে পাবার আকুল প্রত্যাশায়। প্রথম আলো,১৯শে আগস্ট ২০২১ সনের সংখ্যায় এক নিবন্ধে বলা হয়েছে “ ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনের ঘোষণার পাঁচ দিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে রফিক নামের এক অজ্ঞাত টেলিফোন কল আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়।

 

 

টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা (শহীদুল্লা কায়সার) মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। সেদিন সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, টেলিফোন পেয়ে জহির রায়হান দুটো গাড়ি নিয়ে মিরপুরে রওনা দিয়েছিলেন।

 

 

তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ভাই জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, শ্যালক বাবুলসহ আরও তিনজন। মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির রায়হানের টয়োটা গাড়িসহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। এরপর আর জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
 

 

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশ ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে হানাদার মুক্ত হয়, স্বাধীন হয়। কিন্তু মীরপুর এলাকায় বসবাসকারী বিহারী জনগোষ্ঠী তখনও পর্যন্ত আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ জারি রাখে। মিত্রবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ যৌথভাবে তাদের অবরুদ্ধ অবস্থায় রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

 

 

বিহারীরা জানুয়ারি ১৯৭২ সালের শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পন করে। এই ক্রান্তিকালীন সময়ে কে বা কারা জহির রায়হানকে সেখানে যেতে খবর পাঠাল, তা আজও অনুদ্ঘাটিত। তিন বাহিনীর কাছে থাকা  অবস্থায়  বা তাদেও কাছ থেকে সওে যাবার পর জহির রায়হান গুলিবিদ্ধ হন বলে কিছু কিছু সূত্র জানায়।

 

 

কিন্তু পরে তাঁর লাশ খুঁজে না পাওয়ায় রহস্য আরও ঘনীভূত হয়। স্বাধীন দেশে এক অকুতোভয় যোদ্ধা কোনও সূত্র না রেখেই নিখোঁজ হয়ে গেলেন। এই হত্যাকান্ড বা অন্তর্ধানের যথযথ তদন্ত বা রহস্যের কিনারা আজও হয়নি। মীরপুর বিহারী অধ্যুষিত জনপদ। ১৯৭১ সালে স্বধীনতা যুদ্ধে বিহারী জনগোষ্ঠী বাঙালি নিধনে ছিল খুবই সক্রিয়।

 

 

মীরপুরের এই বিহারী সম্প্রদায়ই নির্মম, নৃশংস নির্যাতন করে কবি মেহেরুন নেসাকে হত্যা করে। সেখান থেকে ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি জহির রায়হান যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন, না পাওয়া গেল তার মৃতদেহ,না পাওয়া গেল কোনও হদিস বা তাকে খুঁজে চিহ্নিত করার মত কোনও সূত্র। জানুয়ারি স্বাধীন দেশে এ এক অবাক করা নীরব বিস¥য়।
 

 

“মাত্র ৩৭ বছর জীবনের পরিধি ছিলো জহির রায়হানের। এই ক্ষুদ্র জীবনে দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে দোর্দণ্ড প্রভাববিস্তার করে গেছেন। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনেই এই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার।

 

 

কেবল সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নয়- স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি গণ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হান। তা ৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৬৬'র ছয় দফা, ৬৯'এর গণঅভ্যুত্থান হোক কিংবা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রভাগের সৈনিক। ছোট্ট এই ক্ষুদ্র জীবনে একজন মানুষ কতোটা দিতে পারেন, জহির রায়হান যেন ছিলেন তার সীমারেখা। যার জীবন ছিল অবিস্মরণীয় কীর্তিতে ভরা (প্রআ)।”
 

 

 

তাঁর রচিত বিখ্যাত গল্পসংগ্রহ ও উপন্যাসের মধ্যে হাজার বছর ধরে, শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, আর কত দিন প্রভৃতি, এছাড়াও অনেক গল্পসহ অন্যান্য লেখা এখনও অগ্রন্থিত এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ১৯৪৯ সালে, ফেনীর সোনাগাজির আমিরাবাদ স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে লিখলেন 'ওদের জানিয়ে দাও' নামের একটি কবিতা।

 

 

সেই কবিতা প্রকাশিত হলো চতুষ্কোণ পত্রিকায়। কবিতায় উঠে এলো নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মর্ম যাতনার কথা।

'ওদের জানিয়ে দাও,
 ওরা আমার ভাই-বোনকে
কুকুর বিড়ালের মত মেরেছে
ওদের স্টীম রোলারের নিচে
ওদের জানিয়ে দাও
ওরা দেখেও যদি না দেখে
বুঝেও যদি না বোঝে'


সহমর্মী, সংবেদনময় সমব্যথী একটি মনের অধিকারী ছিলেন অকুতোভয় দেশ প্রেমিক জহির রায়হান ছোট বেলা থেকেই। গল্প, উপন্যাস লিখেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সেই মর্মচেতনার প্রেক্ষিতেই এবং সেই সব লেখা, সেই সব সিনেমা হয়েছে কালজয়ী। জাতি আজও জহির রায়হানের অভাব অনুভব করে। আজও তাঁর অবদান স্বীকার করে, গর্ব করে। জাতি চিরকাল শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হানদের মত দেশ প্রেমিক বীরের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।  এন.এইচ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর