শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

জ্ঞান পিপাসুদের মিলনমেলা সুধীজন পাঠাগার

তানজিলা জামান তিন্নি

প্রকাশিত: ১২ জুন ২০২২  

 

# পাঠাগারটি বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে
# পাঠাগার স্থাপনের জন্য জমি ইজারা দেন চুনকা


মানুষের জীবনে অনেক ক্ষেত্রে বন্ধু, শুভাকাঙ্খী এমনকি অভিভাবকদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে বই। বই মানুষের আত্মার দ্বার খুলে দিয়ে চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করে।আর বই পড়ার অনন্য একটি জায়গা নারায়ণগঞ্জের ‘সুধীজন পাঠাগার’। নারায়ণগঞ্জের , ২৩১ বঙ্গবন্ধু সড়ক সুধীজন পাঠাগার নিজস্ব ভবনের ৩য় তলায় অবস্থিত।

 

১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের আমলাপাড়ায় হাজী রহমত উল্লাহ সাহেবের বাড়িতে ৩০ টাকায় মাসিক ভাড়ায় একটি ঘরে এই সুধীজন পাঠাগারের সূচনা হয়। পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক মো. নুরুল হক। একই সাথে এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম দিকে কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফজলে রাব্বি। তাছাড়া কিছু বই প্রিয় মানুষের সহযোগিতায় শুরু হয়েছিল সুধীজনের পথচলা। শুরুর লগ্মে ১০ টি বই, ১টি বই রাখার আলমারি ও রাতে দেখার জন্য ১টি হারিকেনের আলো সম্বল করে পাঠাগারের যাত্রা হয়। বছর ঘুরতেই ১০ টি বই নিয়ে শুরু করা সুধীজনের বই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৬টি, যার বর্তমান বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি। যেখানে জ্ঞান পিপাসুরা জ্ঞান অর্জনের জন্য ভীড় জমান।

 

জানা যায়, জ্ঞান পিপাসু কিছু বই প্রিয় মানুষ মিলে এই পাঠাগার শুরু করার উদ্যোগ নেন। কেননা তাদের মতে বই পড়া কিছু কিছু মানুষ নেশা হিসেবে বেছে নেন। যারা প্রতিনিয়ত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞানী গুনী হয়ে উঠেন।

 

পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিখ্যাত শিল্পপতি হোসেন জামাল, তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের নগর পিতা পৌরসভার চেয়ারম্যান আলি আহম্মদ চুনকা, সালাউদ্দিন আহাম্মেদ, আমজাদ হোসেন সহ আরো অনেকে বইকে ভালোবেসে পাঠাগারের সাথে সংযুক্ত হন। যার ফলে পাঠাগারের কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সহজ হয়। তারা তখন এই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ভাবে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে সূধীজন পাঠাগারকে এগিয়ে নিয়ে যান। তবে পথচলার প্রথম দিকের পথ একটু কঠিন থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় এই প্রতিষ্ঠানকেও প্রথম দিকে ঝরঝাপটা পারি দিয়ে আজকে এই জায়গায় আসতে হয়েছে।

 


সুধীজন পাঠাগারের সাথে তৎকালিন সময় জড়িত থাকা এক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, এই পাঠারগারটি শুরুর দিকে অনেক কষ্টে সময় পার করেন। কেননা তখন আর্থিক ভাবে তেমন একটা সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তখন কো-অপারেটিভ হাউজে পাঠাগারটি ভাড়া ঘরে পরিচালিত হয়েছে। তখনকার সময় দুইটি আলাদা কক্ষ থাকায় পাঠাগার পরিচালনায় অসুবিধা হয়। তাদের এই ভোগান্তি দেখে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান আলি আহম্মদ চুনকা পাঠাগারটিকে স্থানান্ততরীত করার জন্য এগিয়ে আসেন। তখন তিনি ৯৯ বছরের জন্য প্রায় ৬ কাঠা জমি পাঠাগারের নামে ইজারা প্রদান করা হয়।

 


খোঁজ নিয়ে জানাাযায়, সুধীজন পাঠাগারের সদস্যরা ছিলেন অগ্রসর চিন্তার মনের মানুষ। তারা পাঠাগারের স্বল্প বার্ষিক আয় থেকে নির্মাণের তহবিলে লাখ টাকা জমা করে ফেলেন। তারপর নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান আলি আহম্মদ চুনকা, মহকুমা প্রশাসক এএফএম ইমাম হোসেন, ঢাকা জেলা প্রশাসক এএফএম শওকত আলীর সহযোগিতায় ১৯৭৮ সালে পৌরসভা প্রদত্ত জমিতে নিজস্ব অর্থায়নে করা ১ তলা ভবনে পাঠাগারটি স্থানান্তরিত হয়। সকল সমস্যা মোকাবেলা করে সুধীজন পাঠাগার আজ নিজস্ব ভবনে। ৫৮ বছরের যাত্রায় নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম লাইব্রেরি হয়ে উঠেছে সুধীজন পাঠাগার। এই পাঠাগার হচ্ছে একগুচ্ছ বইয়ের বাড়ি। যেখানে সব ধরনের বই এক সাথে পাওয়া যায়।

 


এখানে বাংলা ইংরেজি সহ, সাহিত্য, কবিতা, ভ্রমণ, বিজ্ঞান, ধর্ম, খেলা, সিনেমা, সাধারণ জ্ঞান ও আরো বিভিন্ন বিষয়ের বই পাওয়া যায় সুধীজন পাঠাগারে। ছোট বড় পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো লেখক এর বই এখানে পাওয়া যায়। যা প্রায় অর্ধেকই পাঠাগারের নিজস্ব আর্থিক তহবিল এর। বর্তমানে পাঠাগারে পাঠকের সংখ্যা বেড়ে ৯ থেকে ১০ হাজারের মতো। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বই পড়তে আসেন। আবার অনেক জ্ঞান পিপাসুরা বাড়িতে বই নিয়ে যায়। তবে শর্ত সাপেক্ষে বই পড়া শেষে পাঠাগারের দেওয়া নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী বই পাঠককে তা পাঠাগারে হস্তান্তর করতে হয়। আবার কিছু মানুষ পাঠাগারের মনোরম পরিবেশেই বই পড়তে পছন্দ করেন।

 


সূধীজন পাঠাগারে হোসেন জামালের পরিবারের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া কিছু বই পাঠাগারের হোসেন জামাল স্মৃতি পাঠ কক্ষে রয়েছে। পাঠাগারে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কর্নার যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সহ বাংলাদেশেরে ইতিহাস সম্পর্কিত বই রয়েছে। পাঠাগারে রয়েছে পত্রিকা পরার সুব্যবস্থা। যার জন্য পাঠাগারকে কোনো অর্থ দিতে হয় না । পাঠাগারের সংগ্রহে যদি কোনো বই না থাকে তবে তারা সেই বই পাঠকদের জন্য সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করে। তবে পাঠাগারের সদস্য না হলে কেউ বই পড়তে পারেন না। এই পাঠাগারের সদস্য হওয়ার জন্য পাঠাগারে প্রথমে ২৮৫ টাকা ফি দিয়ে সদস্য হতে হয়। প্রত্যেক সদস্য হতে জামানত হিসেবে ২শ’ টাকা রাখা হয়। যা ফেরত যোগ্য। ৮৫ টাকা বছরের ফি যা ১বছর পর পর পাঠাগার কে দিতে হয়।

 


বর্তমানে নবীন প্রবীণ মিলিয়ে পাঠাগারের পরিচলনায় যুক্ত আছেন, সুধীজন পাঠাগারের পরিচালক হিসেবে আছেন কাসেম জামাল, কর্মাধ্যক্ষ:- ইমতিয়াজ ফারুক মঈন, কোষাধ্যক্ষ:- আল-আমিন। এ্ছাড়া আরও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ পাঠাগারের সাথে যুক্ত আছেন।

 

পাঠাগার কর্মপরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। প্রতিবছর বিভিন্ন দিবসে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য সাধারন জ্ঞান বিতর্ক সহ বইপড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন পাঠাগারের নিয়মিত কর্মসূিচর অন্তর্ভুক্ত। এর সাথে আছে বানান হস্তাক্ষর সুন্দর করা। বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বছরব্যপি বইপড়া, মাসিক বইপড়া বিশেষ দিবস উপলক্ষে বইপড়া প্রভৃতি কর্মসূচি পরিচালনা করে বই পড়াকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হয়। এজন্য প্রণোদন হিসেবে বই উপহার দেওয়া হচ্ছে। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে আছে ট্যালেন্ট শো, বৈশাখী আড্ডা, চলচিত্র প্রদর্শন, সংগীতানুষ্ঠান ও শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর প্রভৃতি। মানুষকে বই পড়া, সাহিত্য চর্চা ও জ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত করায় নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহন করা হয়।

 


পাঠাগারে বই নিতে আসা এক কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, পাঠাগারের পরিবেশটা খুবই সুন্দর। একানে প্রয়োজনীয় অনেক বই রয়েছে যা তাদের পড়ালেখায় অনেক সহোযোগিতা করেন । বই পড়তে আসা রাতুল জানায়, তার এখানে বসে বই পড়তে ভাল লাগে। সে মাঝে মাঝে বই বাড়িতেও নিয়ে যায় পড়ার জন্য।

 


সুধীজন পাঠাগারে কোষাধ্যক্ষ দায়িত্বে থাকা আল আমিন জানান, পাঠাগারটি বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। তবে পাঠাগারের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জ্ঞান চর্চায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয় সুধীজন পাঠাগারে। অনলাইনেও পাঠাগারের সেবা কার্যক্রম চালানো হয়। তাছাড়া নিজস¦ ভ্যান এর মাধ্যমে পাঠাগারের বই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌছে দেয়া হয়। করোনা মহামারীর সময় ঘর বন্ধী মানুষের অবসর সময় বই পড়ার ব্যবস্থা করা হয় মোবাইল লাইব্রেরি চালু করার মাধ্যমে। শহরের প্রান্তিক এলাকার স্কুল সমূহে গ্রন্থ সেবা পৌছে দেয়া হয় মোবাইল লাইব্রেরী মাধ্যমে। নগরের মধ্যে এত ভাল সুযোগ সুবিধা বেসরকারি কোন পাঠাগারে নেই বল্লেই চলে নারায়ণগঞ্জ শহরে এমন একটি পাঠাগার অন্য কোথাও নেই ।এমই/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর