শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি এখন বারদী পর্যটন কেন্দ্র

আশরাফুল আলম, সোনারগাঁ

প্রকাশিত: ২১ মার্চ ২০২৩  


জ্যোতিময় জ্যোতি বসু ইতিহাসের এক মহানায়কের নাম কমরেড জ্যোতি বসু। বাংলাদেশের প্রতি যার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দুর্বলতা ছিল সবসময়। ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতায় জন্ম নেওয়া এ কিংবদন্তির শৈশব কেটেছে বাংলাদেশে তার পৈতৃক ভিটা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীর চৌধুরীপাড়া গ্রামে।

 

 

নাড়ির টানে ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে ঢাকায় আসেন জ্যোতি বসু। ১৯৮৭ সালের ৩০ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি পৈতৃক বাড়িতে আসেন। ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন জ্যোতি বসুর বাড়িতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।

 

 

 

ঘোষণার পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২২ সালে। প্রকল্পের জন্য ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হলেও এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

 

 

চলতি বছরের গত ২৯ জানুয়ারি জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়িটিকে বারদী পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। বারদী পর্যটন কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন।

 

 


জানা যায়, তার পিতা ডাঃ নিসিকান্ত বসু নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদী চৌধুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। সেই সুবাদে জ্যোতি বসুর ছোট বেলার অনেকটা সময়ই কেটেছে বারদী তার পৈত্রিক বাড়িতে। ১৩২৯ বাংলা সনের ১৩ অগ্রহায়ণ পাচু ওস্তাগারের মাধ্যমে দুই একর ৪ শতাংশ জমিতে নির্মাণ করা হয় বাড়িটি। জ্যোতি বসুর এই বাড়ীটি মূলত তার নানার ছিল।

 

 

জ্যোতি বসুর নানা শরৎ চন্দ্র দাস ও নানী খিরদা সুন্দরীর সংসারে জ্যোতি বসুর মা হেমলতা বসুই ছিলেন তাদের একমাত্র সন্তান। সেই সূত্রে এই বাড়ীর মালিক হন হেমলতা বসু। ডাঃ নিশিকান্ত বসুর সঙ্গে হেমলতা বসুর বিয়ের পর স্ত্রীর সুবাদে এই বাড়ীটির মালিক হন জ্যোতি বসুর পিতা।

 

 

 

ডাঃ নিশিকান্ত বসু ও হেমলতা বসুর সংসারে তাদের তিন সন্তান সুরেন্দ্র কিরণ বসু, জ্যোতি বসু ও মেয়ে সুধা বসু। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালীন সময়ে জ্যোতি বসু ১৯৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি এবং ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর স্ত্রী বাসন্তি ঘোষ ওরফে কমলা বসু ও তার ছেলে চন্দন বসুকে সঙ্গে নিয়ে বারদীতে তার পৈত্রিক বাড়ীটি দেখতে আসেন।

 

 

 

জ্যোতি বসুর পিতা ডাঃ নিশিকান্ত বসু ছিলেন একজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তৎকালিন সময় পেশাগত কারনে তিনি জ্যোতি বসুর জন্মের পূর্বেই বারদী থেকে ভারতের কলকাতায় চলে যান। চিকিৎসা পেশা নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকার পরেও নিশিকান্ত বসু সময় সুযোগ পেলেই বিভিন্ন ছুটি ছাটা ও পুজো পার্বনে সপরিবারে বেড়াতে আসতেন বারদীর চৌধুরীপাড়ায়।

 

 

 

১৯৮৭ সালে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বারদীতে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বারদীতে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্টমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। সে সময় ভারত থেকে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আসেন পশ্চিমবঙ্গের উপ-মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুর বড় ভাই ডাঃ সুরেন্দ্র কিরণ বসু এবং বোন সুধা বসুও।

 

 

 

জন্মের পর জ্যোতি বসুর নাম নির্ধারণের পূর্বে প্রথমে জ্যোতিন্দ্র এবং পরে রথীন্দ্র রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তার পিতা ডাঃ নিশিকান্ত বসু তাকে লরেটা কিন্ডার গার্টেনে ভর্তির সময় জ্যোতি বসু নাম রাখেন। কিন্ডার গার্টেনের পড়া শেষ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩৫ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।

 

 

 

এরপর লন্ডন গিয়ে জ্যোতি বসু বার এট.ল পাশ করে ১৯৪০ সালে কলকাতা ফিরে আসেন এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি বাসন্তি ঘোষ ওরফে কমলা বসুর সঙ্গে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি রাজ্য পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

 

 

 

পাশাপাশি নয় জন পলিট ব্যুরো সদস্যসহ ১৯৪৬ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে জ্যোতি বসু ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কমিউনিস্ট দলের সদস্য হিসেবে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছর একটানা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

 

 

 

জ্যোতি বসু ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা লগ্ন ১৯৬৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পলিট ব্যুরোর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় জ্যোতি বসু তার এই পৈতৃক বাড়িটি গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ প্রথমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত আগ্রহে জ্যোতি বসুর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেন।

 

 

 

প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে ২০১১ সালের ৪ আগষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ এক কোটি ৪৭ লাখ ব্যয়ে গ্রন্থাগারের নির্মাণ কাজ শুরু করে। যার প্রথম তলায় রয়েছে পাঠাগার কক্ষ, মহাফেজখানা। দ্বিতীয় তলায় স্মৃতি যাদুঘর ও সেমিনার হল। নির্মাণ কাজ শেষ হলে ২০১৩ সালের ১৪ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোতি বসু স্মৃতি পাঠাগার ও যাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

 

 


সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজওয়ান উল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এখনো দাপ্তরিক ভাবে কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি। এখানে জনবল নিয়োগ দিতে হবে তার পরে পর্যটন কর্পোরেশন যে ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে সেই অনুযায়ী কাজ করা হবে।

 

 

জ্যোতি বসুর বাড়িটা কিভাবে দ্রুত সংস্কার করে আদিরূপ ফিরে আনা যায় সে জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাড়িটির আদিরূপ ফিরে এনে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হলে বাড়িটিকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। এন.হুসেইন/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর