বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

টানবাজার কলোনি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে চান সনু

নুরুন্নাহার নিরু

প্রকাশিত: ৫ আগস্ট ২০২২  

 

# ইচ্ছে, স্বপ্ন, উদম্য, সাহস, মনোবল, মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ তিনি
 

 

সংস্কৃত এবং হিন্দী ভাষায় দলিত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ভগ্ন’ বা ‘ছিন্নভিন্ন’। সাধারণত যে সম্প্রদায়ের মানুষ অনগ্রসর এবং যারা সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাদেরকেই দলিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই শ্রেণি পেশার মানুষ চরম অবহেলিত, বিছিন্ন ও উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে এই শব্দটির প্রচলন আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ভারত-এ দলিত সম্প্রদায় বুঝাতে এমন কিছু জাতিগত গোষ্ঠীকে বোঝানো হয়, যারা সচরাচর নিপীড়িত এবং অনগ্রসর জাতিরূপে চিহ্নিত। আমাদের দেশেও এমন কিছু সম্প্রদায় আছে যাদের দলিত সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তেমনি এক দলিত সম্প্রদায়ের বাস আমাদের নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এলাকায়। যেখানে শিক্ষা অর্জনে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে কোন মেয়ের মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়না। অথচ এই সুইপার কলোনির দলিত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট হিসেবে এক অভাবনীয় রেকর্ড করলেন সনু রাণী দাস।


 
টানবাজারের সুইপার কলোনির এক হরিজন পরিবারে সনু রাণী দাসের জন্ম। বেড়ে ওঠাও হয় সেই কলনিতে। সাধারণত যারা এই কলনীতে বসবাস করে তারা এমনিতেও সবার কাছে যেন অবহেলিত। এ সম্প্রদায়ের লোকেদের যেন মাথা নিচু করে বাঁচার জীবন এবং সবাই তাদের নিচু সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে দেখে। শিক্ষার মতো অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এ সম্প্রদায়। এছাড়া নানা দিক থেকেও পিছিয়ে রয়েছে তারা। সনু রানীর অদম্য ইচ্ছাশক্তি আজ তাকে নিয়ে গেছে জীবনের অনেক দূরে। কলোনিবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থায় অনগ্রসরের প্রধান কারণ তাদের ভাষা। এই সম্প্রদায়ের লোকজন সাধারণত হিন্দি ভাষাতে কথা বলেন। বাংলা ভাষা বলতে পারেন এমন লোক খুব কমই আছেন। পড়াশোনার বিষয়টি মেয়েদের ক্ষেত্রে তো আরো কঠিন হয়ে পড়ে। মেথরের মেয়ে, নিচু সম্প্রদায়ের মেয়ে হয়ে পড়াশোনা করবে এ রকম কথা তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা ভাবতেও পারে না। কিন্তু সনু তার ব্যতিক্রমটাই করে। সে প্রথমে তাদের কলোনীর এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

 

সেই স্কুলটিতে পাঠ চলে বাংলা ভাষায় যার কারনে হরিজন পল্লি অনেকেই বেশি দূর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে অনেকেই। কিন্তু সনু ও তার দুই বান্ধবী জীবন সংগ্রামে থেমে থাকেনি। স্কুল যাওয়ার পথে তাকে অনেকেই অনেক ধরনের বাজে মন্তব্য করেছে। শুধুমাত্র হরিজন সম্প্রদায়ের মেয়ে ছিল বলে তাকে অনেক কূটক্তি ও অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তাকে কোনো বাধাই আটকে রাখতে পারেনি। তিনি যখন মাধ্যমিকে পড়েন তখন তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত গিয়েছে এমন লোকের সংখ্যা নেই বললেই হয়। তখন কারো সাহস হয়ে ওঠেনি মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়ার। কিন্তু সনু ও তার দুই বান্ধবী তাদের প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষকের দ্বারা মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানকার সহপাঠীরা তাদের সাথে এমন আচরণ করতো যেন তাদের সাথে মিশলে জাত যাবে, তাই যেন দূরত্ব বজায় রাখতো। এছাড়া সে যে সুইপার কলোনীতে থাকতো এটা বললে যেন আর রক্ষে নেই। কারো কাছে তার আসল বাড়ির ঠিকানাও দিতেন না। কেউ যেন জানতে না পারে তার বাড়ি সুইপার কলোনীতে, সে জন্য তিনি কলোনীর পিছনের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে ঘুরপথে স্কুলে যেতেন।

 

কারন, কেউ যদি একবার দেখে ফেলে তাহলে মেথরের বাচ্চা বলে গালি একটাও মাটিতে পরবে না। সিনিয়ররা এরকম অপমানের শিকার হয়েছে বলে আমাদের মনেও সেই একই ভয় কাজ করতো। তাই এ রকম পথ বেছে নেয়া। আর ভাষার সমস্যা তো সব সময় ছিল। খুব কম লোকই চাইতেন যে সনু পড়াশোনা চালিয়ে যাক। কলোনির অনেকেই আমার বাবা-মা কে বলতেন, মেয়েকে এতো পড়াশোনা করিয়ে কি লাভ! এসব কিছু সহ্য করেও গণবিদ্যা নিকেতন হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে সনু। তার মনে ইচ্ছে জাগে সে আরো পড়াশোনা করবে। এতে তার মায়ের আপত্তি ছিল। তার মা মনে করেন মেয়েরা শুধু ঘড়ের কাজ করবে। এর মধ্যে আত্মীয় স্বজনদের মাঝে নেতিবাচক কথাও হয়ে গেছে। কিন্তু তার বাবা চেয়ে ছিলেন সে আরো পড়াশোনা করবে। তাই মেয়েকে ভর্তি করেন নারায়ণগঞ্জ কলেজে। নারায়ণগঞ্জ কলেজে ভর্তির পর পড়াশোনার পাশাপাশি সনু একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে বাচ্চাদের পড়াতেন। সে টাকা দিয়ে তিনি তার পড়ার খরচ চালাতেন। পরে নারায়ণগঞ্জ কলেজ থেকে সনু রাণী দাস এইচএসসি পাশ করেন। শুধু এ পর্যন্ত এসে থেমে থাকেনি সনু। ডিগ্রি পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজে। এখান থেকেই তার জীবনের ইতিহাস গড়লেন। নারায়ণগঞ্জ সুইপার কলোনির দলিত সম্প্রদায়ের প্রথম মানুষ হিসেবে তিনি এখান থেকে স্নাতক পাশ করেন। সুইপার কলোনির প্রথম গ্রাজুয়েট মহিলা হয়ে তিনি সকল বাধা, অপমান ও অবহেলাকে যেন তুচ্ছ করে দিলেন। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় এ কথাটার অর্থ যেন বুঝিয়ে দিলেন সনু রাণী দাস। সংস্কৃতির কথা চিন্তা করে যাদের ঘর থেকে বের হওয়ার কথা ছিলো না, সেই সনু ঘুরে এলেন বিদেশ থেকে। স্কটল্যান্ড, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন জায়গায় তিনি দলিত সম্প্রদায়ের সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন।

 

ইচ্ছে, স্বপ্ন, উদম্য, সাহস, মনোবল, মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ সনু রাণী দাস। অনেককে তিনি বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। এখন আর তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই, নেই কোনো হীনমন্যতা। বর্তমানে তিনি একটি দলিত সম্প্রদায়ের কমিটির সাথে যুক্ত আছেন। তার ভবিষ্যৎ ইচ্ছের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার ইচ্ছে আমাদের টানবাজার কলোনিতে যে সরকারি বিদ্যালয়টি রয়েছে সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার। এজন্য আমি সেখানকার প্রাধান শিক্ষককে বলে রেখেছি আমাকে সামান্য কিছু বেতন দিলেই চলবে। যেহেতু আমি এখনো শিক্ষকের চাকরিটা পায়নি তো এখন আমার ইচ্ছে আমি আমার কমিটির হয়ে কাজ করবো। এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাবো যাতে দিন শেষে কাউকে যেন এই সুইপারের চাকরিটা বেছে নিতে না হয়। এ সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।এমই/জেসি


 

এই বিভাগের আরো খবর