বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ডিসেম্বর-ছাই চাপা বুক চাপা-১

করীম রেজা

প্রকাশিত: ২ ডিসেম্বর ২০২২  

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে যেমন ব্যক্তি জীবনে টানাপোড়েন থাকে তেমনি থাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। মানুষের মন-আচরণ বিচিত্র এবং বহুমুখী। সবাই সবকিছু একই প্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করে না। বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়েও নানা মুনির নানা মত ছিল।

 

 

কিন্তু দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু আসল সত্য জানতেন, মানতেন, বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস হয়ত একটু বেশিই করতেন। যাহোক শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ সগর্বে টিকে আছে। এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বাংলাদেশ  ১৯৭১ সনের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে।

 

 

স্বাধিকারের দাবী আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের নামে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেয়া একটি অসম শক্তির যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। সমগ্র বিশ্ব চমকিত হয়।

 

 

সাধারণ জনযোদ্ধাদের কাছে বিশ্বমানের একটি আধুনিক সামরিক বাহিনীর পরাজয় বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে এক বিরলতম ঘটনা। দীর্ঘ নয়মাসে ছোটবড় অনেক ঘটনার যোগফল বাংলাদেশের অভ্যূদয়। স্বাধীনতা।

 

 


মোটাদাগে স্বাধীনতা নিয়ে অনেক বই পুস্তক লেখা হয়েছে। এখনও লেখা হচ্ছে, আরও হবে। গবেষণাগ্রন্থও রচিত হয়েছে। ইতিহাস বিজ্ঞানের নিরিখে যথাযথ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে গুনীজন তা মনে করেন না। তারপরও যা লিখিত হয়েছে বা হচ্ছে তার গুরুত্বও কোনও অংশেই কম নয়।

 

 

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অনেক ঘটনার বিবরণ এখনও অলিখিত রয়েছে। ইতিহাস সচেতনতার অভাবে তথ্য-প্রমাণ হারিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সরাসরি যুদ্ধে জড়িত যোদ্ধা, সহযোদ্ধা, যুদ্ধে সহায়তাকারী, গণহত্যার চাক্ষুষ সাক্ষী, ভারতে শরণার্থী কিংবা দেশের অভ্যন্তরে ভিন্ন এলাকায় আশ্রয়ী বা আশ্রয়দানকারী অনেকেই আজ বয়সের কারনে মৃত বা অসুস্থ। তারমানে ইতিহাসের চরিত্রগুলো ক্রমান্বয়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই কমে আসছে।

 

 


যেহেতু সারা দেশের মানুষই এই যুদ্ধে নানাভাবে সামিল ছিল। কিছু সংখ্যক চিহ্ণিত রাজাকার এবং পাক-বাহিনীর দোসর ছাড়া। সেই অকুতোভয় যোদ্ধারা ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশে। দেশের আনাচে কানাচে। তাদেরকে সংঘটিত করা বা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব।

 

 

তবে অসম্ভব হলেও কঠিন নয়। আর এই কঠিন কাজটিই বলা যায় নিজ নিজ দায়িত্বে সাধ্যমত করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং প্রিন্টিং মাধ্যম। কেউ কেউ ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বই পুস্তকও ছাপিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন।

 

 


যৌথভাবে কাজ করা বলা হয়ে থাকে অগ্রগতির প্রধান শর্ত। সবাই মিলে সেই কাজটিই করছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দালিলিকভাবে সংগৃহীত হচ্ছে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন, অসমন্বিত উপায়ে। সংরক্ষণও করছেন যার যার মত। এতে করে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মহান গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ সমগ্ররূপে দৃশ্যমান কঠিন হবে।

 

 

যেমন তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে, যা কোন টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম। এক-একজন বৃদ্ধা ভিক্ষুক সারাদিন আশপাশের গ্রাম বাজার ঘুরে কিছুই পাননি। কারণ সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সবাই বাড়ি ছাড়া, চারিদিক জনশূন্য। ফেরার পথে জঙ্গল থেকে কিছু জংলি কচুর মূল তুলে আনেন ক্ষুধা নিবৃত্তির আশায়। মাটির চুলায় হাঁড়ি চাপিয়ে সিদ্ধ করছেন।

 

 

এমন সময় তার কুড়ে ঘরের আড়ালে এক দলবিচ্ছিন্ন ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধার আগমন ঘটে। বুড়ি পরম মমতায় তাকে বসতে দেন চুলার পাশে। মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি সেদ্ধ কচু খেতে দেন। নিজের জন্য বা তাকে দেয়ার মত আর কোন খাবার তার কাছে ছিল না।

 

 


অন্য ঘটনাটি হল এক বাড়িতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেই বাড়ির কর্তা আসলে তলে তলে পাকিস্তানিদের দোসর তা জানা ছিল না। তার ছেলের বউ এসে মুক্তিদের জানালেন যে তাদেরকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাকিস্তানিদের খবর দেয়া হয়েছে। বউটি ছিল নববিবাহিত। মুক্তিরা পরে ফিরে এসে ঐ বাড়িতে ফিওে এসে দেখতে পায় সেই বধূটি তার শ্বশুরকে বটি দিয়ে দ্বিখন্ডিত করেছে।

 

 


আরেক মা এক আহত আশ্রিত মুক্তিসেনাকে বাঁচানোর জন্য তার যুবতী মেয়েকে ঐ মুক্তিসেনার সঙ্গে এক লেপের তলায় রেখে ঘরে শিকল দিয়ে রেখেছিলেন। পাক সেনারা বাড়ি তল্লাশী করে  বদ্ধ ঘরে জামাই মেয়েকে এক লেপের তলায় দেখে ফিরে যায়। এভাবে সেই মহিয়সী মা এক আহত মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছিলেন।

 

 


বিগত দু’এক বৎসরের মধ্যে টিভি চ্যানেলে দেখা এই ঘটনাগুলো। দিনক্ষণ জায়গার নাম কিছুই মনে রাখিনি। কোনদিন লিখতে হবে ভাবিনি। নয়তো নির্দিষ্টভাবে আজকে রেফারেন্স দিতে পারতাম। তবে খুব সম্ভব চ্যানেল আই , এ টি এন এবং সময় টিভির আর্কাইভ খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এসবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং বিস্তারিত নয়।

 

 

বিভিন্নভাবে নানান মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ইতিহাসের প্রয়োজনে সমন্বিতভাবে এসব ঘটনা এক জায়গায় সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিস্তারিত বর্ননাসহ লিখিত হতে হবে। সঠিক ইতিহাস রচনার জন্য, জাতির মহান গৌরবগাঁথার ধারাবাহিকতা অনুসরনের জন্য সব উপাদান একত্রিত করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। এখনই উপযুক্ত সময়।

 

 

ইতিহাস বিকৃতির নানা আয়োজনের সমুদ্রসমান বাঁধা অতিক্রম করে কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম গণজাগরন সৃষ্টি করতে পেরেছে। তারা নিজেরাই স্বউদ্যোগে আসল সত্য উদঘাটন করেছে। সত্য সন্ধানে আমদেরও দায় আছে তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর এবং সহযোগিতা করার। ০৭.১২.২০১৬ বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের অভ্যূদয় একটি অতি বিরল ঐতিহাসিক ঘটনা। তার দ্বিতীয় তুলনা নেই।

 

 

নয় মাসের যুদ্ধে একটি নিরীহ কৃষিনির্ভর জাতি একটি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা জাতি তথা পাকিস্তানি সামরিক শক্তিকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল। বাংলাদেশী জনগন যুদ্ধ করেছিল দেশের স্বার্থে। কোনও সংকীর্ণ স্বর্থবুদ্ধিতে কেউ যুদ্ধ করেনি। মহান এই যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে জাতীয় বীরত্বের কথা ভিন্ন পথে চালিত করার অপচেষ্টা হয়েছিল।

 

 

তাও পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষ প্রতিহত করেছে। আজ জাতি সঠিকভাবে নয় মাসের যুদ্ধের কথা জানতে পারছে। জানতে পারছে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে। বিজ্ঞানের সুবিধার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ মুখে সেই বিজয়ের বর্ননা শুনতে ও দেখতে পারছে। মুক্তি যোদ্ধার নিজ বয়ানে রোমহর্ষক সেই সব দিনগুলি নতুন প্রজন্মের কাছে ছবির মত স্পষ্ট হচ্ছে।

 

 


সারা ডিসেম্বর মাস জুড়েই ছোট বড় সব পত্রিকায় আমরা দেখতে পাই সেই গণহত্যার বিবরণ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল প্রতিদিনের আয়োজনে নয় মাসের বিভীষিকার ছবি ফুটিয়ে তুলছে। এ সবই জাতীয় জীবনে আশার কথা। হারিয়ে যাবার আগে ইতিহাস সংগ্রহের এইসব উদ্যোগ অবশ্যই প্রসংশনীয়।  

 

 

প্রত্যক্ষদর্শীদের আজ অনেকেই কালের বির্তনে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। একেবারে ফুরিয়ে যাবার আগেই মহান কাজটি বিশ্ব ইতিহাসেরও বিশেষ উপাদান হিসেবে গুরুত্ব বহন করে।

 

 


বাংলার জলবায়ু, আবহাওয়া সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এদেশের পলিমাাটির মতই নরম কোমল। বাংলাদেশীদের মানস গঠনও একই রকম। কোন স্মৃতিই স্থায়ীভাবে দীর্ঘকাল থাকে না। বাংলার মাটি যেমন রৌদ্রতাপে কঠিন আকার পায়, তেমনি সামান্য জলস্পর্শে তা আবার নরম হয়ে ওঠে।

 

 

বাংলাদেশীদের মনেও কোন হিংসা, অহংকার বা শত্রুভাবাপন্নতা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। যদিও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি এমন সরল দৃষ্টিতে বিচারযোগ্য নয়। তবুও আমরা প্রকৃতির স্বভাবিকতাকে অস্বীকার করতে পারি না। প্রাকৃতিক নিয়মেই অনেক স্মৃতি, অনেক ঘটনা মানুষের জীবনে ঝাপসা হয়ে ওঠে কালের বিবর্তনের সাথে সাথে। তাই এসব বিচ্ছিন্ন স্মৃতি এবং ঘটনার বিষয়গুলো যত্নের সাথে সংরক্ষিত রাখা দরকার। এই কাজটি যত দ্রুত শুরু হয় ততই মঙ্গল।  ..... চলবে

এই বিভাগের আরো খবর