শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

তাদের ঈদ কেটেছে কান্নায়

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২৬ জুলাই ২০২১  

শিশু ছেলে হাসনাইন মারা গেছে এই কথা বিশ্বাসই করতে চান না নাজমা বেগম। রাত-বিরাতে নাজমা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। এই বুঝি তার ‘যক্ষের ধন’ ফিরে এলো। তাকে ডাকলো মা বলে। ছেলের বয়সী কাউকে দেখলেই ছুটে যান। নিরাশ হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাস্তার উপরই। সন্তান হারানোর বেদনায় পাগলের মতো প্রলাপ বকেন সারাক্ষণ।

 

ঈদের সারাদিন বসে বসে কেঁদেছেন। সান্তনার কোনো কথাই কাজে আসেনি। ভোলা জেলার চরফ্যাশনের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল শিশু হাসনাইন (১২)। করোনা পরিস্থিতির কারণে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি হয়ে যায়। সব ঠিক থাকলে এখন চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতো সে। অসুস্থ দিনমজুর বাবার কষ্ট সহ্য হয়নি তার। শিশু বয়সে সংসারের হাল ধরতে নারায়ণগঞ্জে এসেছিল হাসনাইন। কাজ নিয়েছিল রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায়।

 

গত ৮ জুলাই ওই কারখানায় অগ্নিকান্ডে নিখোঁজদের তালিকায় রয়েছে হাসনাইনেরও নাম। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই ঘটনায় ৪৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন। হাসনাইন অনেক মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিল দাবি তার পিতা ফজলুর রহমানের। তার খবর শুনে স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীরাও কান্না করেছেন। মুঠোফোনে ফজলুর সংবাদকে বলেন, অনেক কষ্টে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর মেয়েরা অন্য সংসারে চলে যায়। একমাত্র ছেলেকে নিয়েই ছিল তার যত স্বপ্ন। সাধ্যমতো ছেলের সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতেন দিনমজুর পিতা। ‘কী করুম স্যার? গরীবের ঘরে জন্ম নিছি। কপালডা আমার খাডো। বাপের ভিটা ছাড়া আর কিছু নাই। মাঠে কাম কইরা যা কামাইতাম তার আট আনাই খরচ করতাম ছেলের জন্য। ছেলেটাই ছিল বাঁচার একমাত্র ভরসা। ছেলের মায় দিনরাত কান্দে। তারে সান্তনা দেই। কিন্তু আমারে সান্তনা কে দিবো? আমারে সান্তনা দেওয়ার লোকটাই খুঁইজা পাই না।’ মুঠোফোনের ওপাশ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন সন্তানহারা পিতা ফজলুর। আগুনের খবর পাবার দু’দিন পর ঢাকায় আসেন ফজলুর।

 

ওইদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। লকডাউনের কারণে পরে আবার ফিরতে পারবেন কিনা সেই আশঙ্কায় গ্রামে যাননি। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় শ্যালিকার বাড়িতে উঠেছেন। গত রমজানের ঈদে ছেলেকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়েছিলেন। ছেলেকে ছাড়া একাই কোরবানির ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়েছে তাকে। মোনাজাতে অঝোরে কেঁদেছেন তিনি। ফজলুর বলেন, ‘রমজানের ঈদেও একসাথে নামাজ পড়ছি। ওইসব কষ্ট মনে উঠলে আর সহ্য হয় না। চোখের আড়াল হইলেই খুঁজতাম তারে। আমার ছেলে একশোর মধ্যে একটা ছিল। এইরকম একটা ছেলে আল্লাহ লইয়া গেল! খালি হাত তুইলা দোয়া করি বাবায় যেন জান্নাতবাসী হয়।’ ফজলুরের নিজের শারীরিক অবস্থাও নাজুক। টিউমার হয়েছে তার। ক্ষণে ক্ষণে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে। অস্ত্রোপচারের তারিখ ছিল গত ১৭ জুলাই।

 

তবে ছেলের কোনো খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হাড়ের খোঁজটা যেন পান, আশা তাছলিমার পরিবারের পারভীন ও তার তিন ছেলে-মেয়েও কাজ করতো হাসেম ফুডস লিমিটেডের ওই কারখানায়। ঘটনার দিন ওই কারখানায় কর্মরত ছিলেন পারভীন ও তার মেয়ে তাছলিমা (২০)। আহত অবস্থায় পারভীন প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও নিখোঁজ রয়েছেন তাছলিমা। ওইদিন ডিউটি না থাকায় বাড়িতেই ছিলেন পারভীনের অন্য দুই ছেলে-মেয়ে নাছিমা (১৭) ও এরশাদ (১৮)। নিখোঁজ তাছলিমার শোকে কাতর তার পরিবারের প্রতিটি সদস্য। মেয়ের কথা মনে পড়লেই পাগলের মতো হয়ে ওঠেন পারভীন। মুঠোফোনে তাছলিমার বোন নাছিমার সাথে কথা হয়। নিখোঁজ বোনের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষীণ আশা থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান, ‘আমার বোনের কোনো খোঁজ পাইছেন?’ আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে নাছিমা বলেন, ‘মায় কানতে কানতে অস্থির হইয়া গেছে। বাবারেও থামান যায় না। খাওন-দাওনের কোনো ঠিক নাই। তাদের বুঝ দেই। কিন্তু কিছু মানে না। ঈদের দিন ভইরা কানছে।’

 

রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানার অদূরেই ভাড়াবাসায় থাকতেন তাছলিমা ও তার পরিবার। তাছলিমার পিতা বাচ্চু মিয়া সামান্য রিকশাচালক। আগুনের ঘটনায় তাছলিমা নিখোঁজ হওয়ার পরও কয়েকদিন ওই ভাড়া বাসাতেই ছিলেন তারা। ঈদের একদিন আগে পরিবারের সবাই চলে যান কিশোরগঞ্জের গৌরিপুরে। নিজেদের গ্রামের বাড়িতে। নাছিমা বলেন, ‘বোনের কথা বারবার মনে পরে দেইখা গ্রামে চইলা আসছি। কিন্তু কাম হয় নাই। এইখানেও বাবা-মায় কান্না করে। ঘরের বাইর হইয়া কথা বলতেছি, তারা যাতে শুনতে না পায়। বোনরে তো আর পাবো না। পুইড়া গেছে জানি। তারপরও হাড্ডিগুলো যেন পাই। মাটিটা যেন দিতে পারি।’

 

ফজলুর, নাজমা, পারভীন কিংবা বাচ্চু মিয়া নন; রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকান্ডে নিখোঁজ ৪৮ জনের পরিবারে এখনও শোকের মাতম। ঈদের উৎসব ছুতে পারেনি তাদের। দিন কেটেছে নিরানন্দে। স্বজন হারানোর বেদনা লাঘবে তাদের সান্তনা দেওয়ার যেন কেউ নেই। নিখোঁজ স্বজনের পোড়া লাশ শনাক্ত করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ ও রক্তের নমুনা দিয়েছেন সকলেই। এখন কেবল পোড়া হাড় কিংবা একদলা মাংসপিন্ড পাবার অপেক্ষা তাদের।

এই বিভাগের আরো খবর