বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দু’বার তালিকা হলেও অদৃশ্য ইশারায় দখলমুক্ত হচ্ছেনা খাল

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ১৫ জুন ২০২১  

দুই দফা তালিকা তৈরীর পরও দখলমুক্ত হয়নি ফতুল্লার ঐতিহ্যবাহী কালিয়ানী খাল। খালের বিভিন্ন অংশে ৩৪ জন দখলদার চালিয়েছেন খাল দখলের রামরাজত্ব। এনায়েতনগর ভূমি অফিসের মাধ্যমে গত বছর খালের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নিরূপণ ও দখলদারের তালিকা তৈরী করেছিলো নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন।

 

সাবেক জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন এর সময়ে পরপর দুই দফা ওই তালিকা যায় এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। এরপরও খালটির উদ্ধার কার্যক্রম আলোর মুখ দেখেনি।ভূমি অফিসের করা ওই তালিকায় উঠে আসা ৩৪ দখলদারের মধ্যে ১৭ জন রয়েছেন গার্মেন্টস, নিটিং ও ডাইং ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে তিনজন অতি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা।

 

তারা হলেন, বিসিকে অবস্থিত ফকির নীট ওয়্যারের মালিক ফকির মনিরুজ্জামান, ক্রোনী গ্রæপের মালিক আসলাম সানী ও নেভী গার্মেন্টস এর মালিক আব্দুস সালাম। এদের মধ্যে, আসলাম সানী বিকেএমইএ’র সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। অন্যান্যরাও বিকেএমইএ’র বিভিন্ন পদে আছেন। তারা প্রত্যেকেই আবার নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ সেলিম ওসমানের কাছের লোক হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। ফলে কালিয়াণী খাল দখলমুক্ত করণে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতারা। এমন অভিমত ব্যক্ত করছেন সচেতন মহল।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রভাবশালী ওই তিন ব্যবসায়ীর মধ্যে ফকির মনিরুজ্জামান খালের পৃথক ৫টি স্থানে মোট ১৩ ফুট প্রশস্ত এবং ৫৪০ ফুট দৈর্ঘ্য পরিমাণ জায়গা দখল করে আছেন। তাছাড়া, খালের বিভিন্ন অংশে কালভার্ট তৈরী করে খাল সংকীর্ণ করাসহ পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিতে বিঘœ ঘটিয়েছেন। একইভাবে ক্রোনী গ্রুপের মালিক আসলাম সানী খালের ৩৫ ফুট প্রস্থ ও ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্য পর্যন্ত ভরাটের মাধ্যমে দখল করে ক্রোনী গ্রæপের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ব্যবসায়ী নেতা আব্দুস সালামও মাসদাইর ও হরিহরপাড়া মৌজা এলাকায় ৭ ফুট প্রস্থ ও ৪৫০ ফুট দৈর্ঘ্য জায়গা দখল করে নির্মিত করেছেন নেভী গার্মেন্টস নামক তার শিল্প প্রতিষ্ঠান। বিকেএমইএ’র অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আরো অনেকেই কালিয়ানী খাল ভরাট করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।  

 

তাই তালিকা হওয়ার পরও কার্যকরী ব্যবস্থা না নেয়ায় সচেতন মহল আক্ষেপ করে বলছেন, ‘মূলত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতারা খাল দখল করে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং নিজ প্রয়োজনে কালভার্ট তৈরী করায় খাল দখলে থাকলেও রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে পারছে না।’   তবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘প্রভাবশালীদের কারণে খাল উচ্ছেদ হচ্ছে না- বিষয়টি এমন নয়। রাষ্ট্রের কাছে সকল নাগরিকই সমান। ওই খালে কার কার ইন্ড্রাস্ট্রি আছে সেটা আমি জানিও না। মূলত, সরকারের কাজ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমানো, সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করবো।’

 

এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘কালিয়ানী একটি ঐতিহ্যবাহী খাল। এই খাল দিয়ে একসময় ট্রলার ও বড় বড় পালতোলা নৌকা চলাচল করতো। তখন বৃষ্টি যতই হতো, খালের মাধ্যমে পানি চলে যেত নদীতে। তাই জলাবদ্ধতা হতো না। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরাও একটু একটু করে খালটি দখল করে এর পানি প্রবাহ নষ্ট করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যরে কারণে খালটি ভরাট হয়ে আছে। ব্যবসায়ীরা তাদের সুবিধা মত বিভিন্ন স্থানে কালভার্ট তৈরী করে খালটি সংকীর্ণ এবং পানি প্রবাহ আটকে দিয়েছে।

 

ফলে বিসিক ও মাসদাইর সহ আশপাশের এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। মানুষগুলো খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তাই খাল উদ্ধারে স্থায়ী উদ্যোগ নিতে হবে। জেলা প্রশাসক ও সদর উপজেলার কর্মকর্তা মহোদায়কে জানানো হয়েছে। ইউএনও ম্যাডাম বলেছেন, ভেকু দিয়ে খালের ময়লা পরিস্কার করতে। এতেও বিপত্তিতে পড়তে হবে, কারণ বিভিন্ন স্থানে কালভার্ট এবং মিল ফ্যাক্টরী রয়েছে। সেখানে কাজ করতে গেলে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হবে।’   
স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, বেকু দিয়ে খাল খনন বা ময়লা নিষ্কাশন করলেই সমাধান মিলবে না। এর জন্য প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান। খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা গেলেই স্থায়ী সমাধান মিলবে।

 

জানতে চাইলে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরা দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে সরেজমিনে গিয়েছিলাম। জলাবদ্ধতা দুর করার জন্য খালটি পরিস্কার করার বিষয়ে আমাদের চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। খালটি পরিস্কারের পর জলাবদ্ধতা দুর হলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। দখলদারদের তালিকা এখনো আমার হাতে আসেনি। তালিকা দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, বিকেএমইএ, বিজেএমইএ, বিসিক ও উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে দিয়েছি।

 

তারা সরেজমিনে গিয়ে দেখবেন যে, কিভাবে এটা সমাধান করা যায়। আর বেকু দিয়ে খাল পরিস্কার করলে স্থায়ী সমাধান হবে কিনা- তা বলতে পারবে এক্সপার্টরা।’ অনুসন্ধানে দেখা যায়, নেভী গার্মেন্টস, এম.এস ফ্যাক্টরী, বিসিক ৩নং গেইট ও বাউন্ডারী দেয়াল, ফকির নীট ওয়্যার, ট্রাইকট ফ্যাশন, পেন টেক্স লি., ফ্রিডম এ্যাপারেলস্, জীবন এ্যাপারেল্স, এস.এম ফ্যাক্টরী লি, এ্যাপোলো বেকারী, মার্টিন গার্মেন্টস এভারগ্রীন, ক্রোনী গ্রুপ, এমএস ডাইং এন্ড প্রিন্টিং কারখানা গড়ে উঠেছে খালিয়ানী খালের বিভিন্ন স্থান দখল করে।

 

এছাড়া, মনোয়ার হোসেন, মনির হোসেন, ডাক্তারের বাড়ি, রাকিবুল, জাফর হালদার, সুরুজ্জামানের মেয়ের জামাই, সেলিম সরদার, আজগর সরদার, ইউসুফ রহমান, আব্দুল আলী, আমান উল্লাহ, রাজ্জাক ওরফে গগন মিয়া, রহমান, মুকুল ও সুরুজ মিয়া নামে স্থানীয় বাসিন্দারাও খালের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু অংশ দখল ও ভরাট করে বসত বাড়ি গড়ে তুলেছেন। সরকারী খালে দখলদারিত্বের এমন মহোৎসবের কারণে নানাভাবেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এনায়েতনগর, কাশিপুর ও গোগনগর ইউনিয়ন এলাকার লাখো মানুষ।

এই বিভাগের আরো খবর