শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

দেশে এতো ধর্ষণ বাড়লো কেন?

মীর আব্দুল আলীম

প্রকাশিত: ৬ অক্টোবর ২০২০  

দেশে ধর্ষক বেড়েছে; ফেসবুকের কল্যাণে দর্শকও বেড়েছে। সিলেট, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরিশাল, চট্রগ্রাম সবখানেই ধর্ষকরা বেজায় ক্ষেপেছে। যেন কুকুর বিড়ালের কার্তিক মাস চলছে দেশে।মানুষরূপী নরপশুরা সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে কি হায়েনার নখ মেলেছে? শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে।  ফেসবুক আর পত্রিকার পাতা যেন ধর্ষণ কাহিনীতে ভরা।

 

দেশে এতো ধর্ষণ বাড়লো কেন? ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুন্ডের ঘোষণার পর, এমনকি করোনা ভাইরাস আতংকের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষকদের দুঃসাহসেরই প্রমাণ মিলে। ঘৃণিত এই কাজ অপরাধ বিজ্ঞানের কোন সংজ্ঞায় ফেলাব আমরা। প্রশ্ন হলো এ জাতীয় যৌন-ব্যভিচার কি বন্ধ হবে না? 


এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ৯ মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই তথ্য খুবই উদ্বেগজনক। আমরা বখাটেদের হাত থেকে নারীদের রক্ষা করতে পারছি না।সিলেট এমসি কলেজে নববধূকে গণধর্ষণের পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত নির্যাতনের রেশ না কাটতেই এবার ১৩ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে খোদ রাজধানীতে।

 

পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বালুরমাঠ কুর্মিটোলা বস্তিতে তৃতীয় শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীকে পাশবিক নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি ধর্ষকরা। বর্বরোচিত কান্ডের পুরো দৃশ্য তারা ধারণ করে মোবাইল ক্যামেরায়। ওই দৃশ্য ইন্টারনেটে ভাইরালের হুমকি দিয়ে হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েটিকে ফের ধর্ষণ করতে চায় স্থানীয় বখাটেরা। এদিকে সিলেট নগরীতে এক স্কুলছাত্রী (১৪) ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

 

নগরীর দাড়িয়াপাড়া এলাকার একটি বাসায় নিয়ে নিজু আহমেদ (১৮) নামে এক কলেজছাত্র তাকে ধর্ষণ করেছে। সম্প্রতি সিলেট এমসি কলেজে তরুণী ধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে এক চাকমা মহিলা গণধর্ষণ, বেনাপোলে দুই কিশোরী মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ক’দিনের সবক’টা ঘটনা লিখতে গেলে পুরা পাতা ভরে যাবে। যা ঘটছে তা অত্যন্ত ঘৃণিত ও বর্জনীয় কাজ। এসব ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনেরঘটনার পর দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষণিকের হইচই, হম্বিতম্বি হয়। ফেসবুকে ঝড় ওঠে, জেলায় জেলায় বিক্ষোভ হয় এবং তারপর এটির গতি হারায়। কোনটারই বিচার হয় না। 


প্রশ্ন হলো, দেশে এত ধর্ষণ হচ্ছে কেন? তা রোধের উপায় কি? যৌন নির্যাতন বন্ধে আগে মানষিকতা বদলাতে হবে। ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মাঝে মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণ রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। অবাধ মেশামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা, উচ্চাভিলাষ, পর্নো-সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন সুড়সুড়িমূলক বই-ম্যাগাজিন, অশ্লীল নাটক-সিনেমা ইত্যাদি কামোত্তেজনা মানুষকে প্রবলভাবে ব্যভিচারে প্ররোচিত করে তা বর্জন করতে হবে।পর্ণ সাইড গুলো বন্ধ করতে হবে যেন মোবাইল কিংবা কম্পিউটাওে তা কেউ দেখতে না পারে।

 

নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। সময় মত বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা ও যৌনশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালিন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোষাক বর্জন করতে হবে। প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য করে ফেলে। ব্যাপকভাবে কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণগুলোর কাছাকাছি চলে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আর কোনো উপায়ই থাকে না। 


ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগেও কোনো কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। আর এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগ বা ফতোয়া দিলেই চলবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যারযার অবস্থানে থেকে স্কুল-কলেজ মাদরাাসা-মক্তব-মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সমাজের অন্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। তাই ধর্ষণের ব্যাপারের আইনের কঠোর প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।


অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ধর্ষণ রোধের অন্তরায় মনে করা হয়।অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে তা হালআমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়। শুধু ধর্ষণই নয়, দেশে ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়বে, এটি চির অবধারিত। এ ধর্ষণ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া তার অন্যতম প্রধান কারণ।

 

এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নির্ন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশী। যাঁরা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাঁদের ছুঁতে পারে কম। যাঁরা নিম্নবর্গের বাসিন্দা, তাঁরা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করেন। ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে।

 

অন্যায় করে অপরাধিরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষন বেড়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ঈমানশক্তি হারিয়েছি। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ, যৌন কামনা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রেরণা আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে। তাই সমাজ থেকে সুখ, শান্তি বা আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠন মূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতিশ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত যৌনকামনার প্রভাবে আমাদের মধ্যে ধর্ষণ, জেনা, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদির প্রবণতা বাড়ছে।


ধর্ষণ বৃদ্ধি হওয়ার জন্য সরকার ও তার প্রশাসনের ব্যর্থতাই দায়ী বেশি। কারণ অন্যায়কারী এমন জঘণ্য অন্যায় করার পরও প্রশাসন নিবর থাকে। এজন্য অবশ্য রাজনৈতিক চাপও দায়ী। আইনের কাছে পাত্তা পায়না গরীব মানুষ।ধর্ষণের যারা শিকার হন তাদেও অধিকাংশই  দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে তাই আইন আদালত অর্থের কাছে পরাস্ত হয়। এদের পাত্তা দেয় না।

 

উচ্চবর্গীয়দের সন্তান বোন আর স্ত্রীরা ধর্ষিত হওয়ার সুযোগ কম। আর এমন ঘটনা ঘটলে তাঁরা বিচারও পান। তবে মেয়েদের প্রতিপদেই বিপদের মোকাবিলা করতে হয় আজকের সমাজে, শ্রেণীবিভাগ ব্যতিরেকেই। উচ্চবর্গীয়রা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করেন বলে ঘরের মধ্যে তাদের বিপদ কিছু কম হতে পারে তবে পার্টিতে অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিতের হাতে , আর ঘরে নিকট আত্বীয় বা পরিচিতজনদের হাতে লাঞ্ছনা জোটার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

 

আসল সমস্যাটা হলো কুরুচিপূর্ণ পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো শ্রেণীভাগ মানে বলে মনে হয় না। এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও এই মানসিকতা বদলাতে পারে না।তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত স্থানে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী কিংবা ডাক্তারনী ধর্ষিত হয় কি করে?


যৌন-ব্যভিচার সর্বযুগে, সর্বধর্মমতে নিন্দনীয় নিকৃষ্ট পাপাচার। ধর্ষণের চূড়ান্ত শাস্তির বিধান মৃত্যুদন্ড। কিন্তু এ যাবৎ যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, তার যথাযথ বিচার সম্পন্ন হযয়েছে এরূপ নজির কমই আছে। হয় চুড়ান্ত রিপোর্টে ঘপলা নয়তো স্বাক্ষ্যপ্রমাণে প্রভাবিত করে অপরাধি পার পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই।

 

উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা নির্বিচারে পাল্টা হত্যার হুমকি কখনো কখনো হত্যার শিকার ও হয়রানির শিকার হন। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়।

 

ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অর্থদন্ড ও দিতে হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে।

 

অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ড ও দন্ডনীয় হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুর জন্য দায়ী। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডণীয় হবে। এদেশে ধর্ষণের পাকাপোক্ত আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ  নেই বললেই চলে।

 

আইনের যারা প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে হাঁটেন না। কখনো অর্থের লোভ কখনোবা হুমকি ধমকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। মামলার চার্জসিট গঠনের সময় ফাঁক ফোকর থেকে যায়। তাই শেষে রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার লোকজন সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

 

এসব মামলাগুলোর ক্ষেত্রে চার্জসিট গঠনের সময় কোন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের কোন পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারিতে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চুড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিক্টিমের স্বাক্ষাত গ্রহন করা যেতে পারে। তাতে করে গোপনে চার্জসিট দাখিলের ফলে যে জটিলতা তৈরি হয় তা কমে আসবে।


নারীদের জন্য ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটা স্পষ্ট যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধ প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটিই বেশি জরুরী হয়ে পরেছে। সে লক্ষ্যে সততা, আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তা সুনিশ্চিত করবে- এমনটাই সকলের প্রত্যাশা। 


 

এই বিভাগের আরো খবর