বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিএনপি’র কাউন্সিলররা 

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ১০ জুন ২০২১  

দীর্ঘসময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় নারায়ণগঞ্জে আদতে সাংগঠনিকভাবে নেহাৎ দুর্বল বিএনপি। ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আগে পর্যন্ত বিএনপি’র যে ধরণের সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সে তুলনায় বেহাল অবস্থা। ফলে সিটি করপোরেশন এলাকায় গতবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত বিএনপি কাউন্সিলররা রয়েছে বিপাকে। কেউ কেউ নিজ দলের রাজনৈতিক মোড়কের রং ঝাপসা করে টিকে থাকবার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি তিন দলের মাঝামাঝি নিজেকে পোষ্টারিং করে এবারের আসন্ন নির্বাচন উতড়ে যাবার চেষ্টা করছেন।

 

তবে অনিশ্চয়তা ভর করেছে বিএনপি সমর্থক কাউন্সিলদের। কেননা, এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি না তা এখনো সোজাসাপটা করে পরিষ্কার করেনি। তবে আভাস মিলেছে বিএনপি এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নাও আসতে পারে। যদিও গত নির্বাচনে কাউন্সিলররা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেননি তবুও পেছন থেকে তাদের দলীয় পরিচয়ই জয়ী হতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সম্প্রতি পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচন এবং অন্যান্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আমলে নিলে দেখা যায়, সেখানে সরকার দলীয় প্রার্থী ও সমর্থকরাই বিপুল জয় পেয়েছে। 

 

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত নির্বাচনে জয়ী হওয়া বিএনপি সমর্থক কাউন্সিলরাও এবার দেশের সার্বিক নির্বাচনের ফলাফল মাথায় নিয়ে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, গত নির্বাচনে নাসিক ২নং ওয়ার্ডে লাটিম প্রতীকে ৭ খুন মামলায় অব্যাহতিপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেন লাঠিম প্রতীক নিয়ে ২ হজার ৬৮৮ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে এই কাউন্সিলর নাশকতার মামলায় কারাগারে রয়েছেন। গতবার তার ওয়ার্ডে প্রার্থীর সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। এবারও সরকার দলীয় প্রার্থীর সংখ্যা কম নয়। মামলা-হামলার মাথায় নিয়েও ইকবাল বিএনপি ও সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিনের রাজনীতিতেই বলবৎ আছেন।

 

গত নির্বাচনে  নাসিক ৫নম্বর ওয়ার্ডে ব্যাডমিন্টন প্রতীকে বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনের ছেলে গোলাম মুহাম্মদ সাদরিল ২ হাজার ৬৯১ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মত নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিনের ছেলে হলেও জিএম সাদরিল রাজনীতিতে একেবারেই সক্রিয় নন। নাসিক  ৯নম্বর ওয়ার্ডে মিষ্টি কুমড়া প্রতীকের বিএনপি নেতা ইসরাফিল প্রধান ৩ হাজার ৩৩৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের কাউন্সিলর হন। তবে গত নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি’র রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন ইসরাফিল। অনেকটা আওয়ামী ঘরনাকে ম্যানেজ করে তিনি নিশ্চুপভাবে সময় অতিবাহিত করছেন। আসন্ন নির্বাচনে তার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রার্থী হবেন।  

 

নাসিক ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ঘুড়ি প্রতীকে  বিএনপি নেতা জমশের আলী ঝন্টু ৫ হাজার ৫৫৫ ভোট দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন। বিএনপি নেতা বলা হলেও আদতে বিএনপি’র রাজনীতি এড়িয়ে চলেন ঝন্টু। নাসিকের কাউন্সিলদের মধ্যে অন্যতম আলোচিত কাউন্সিলর শওকত হাসেম শকু। বিশেষ করে কোভিড-১৯’র সময় ও পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে জনসংশ্লিষ্ কাজ করনে শকু। গত নির্বাচনে  ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ঘুড়ি প্রতীকে  বর্তমান মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শওকত হাশেম শকু ৭ হাজার ৮০৭ ভোট  পেয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিলর হন। স্থানীয় এমপি ও সিটি করপোরেশনের মেয়র দুজনের সাথেই অত্যন্ত সুসম্পর্ক এই বিএনপি নেতার। বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে ও নিজ কার্যক্রম দিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে একমাত্র কাউন্সিলর শকুই প্রভাব বজায় রেখে সক্রিয় আছেন। বিএনপিতেও রয়েছে তার  শক্তিশালী ভূমিকা। আসন্ন নির্বাচনে কাউন্সিলর শকু তার ওয়ার্ডে আবারও শক্তিশালী প্রার্থী। শুরুটা রাজসিক ছিল ১৩নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মহানগর যুবদলের আহবায়ক মাকছুদুল আলম খন্দকার  খোরশেদের। কোভিডে অসামান্য মানবিক কাজ করে করোনা বীর হিসেবে খেতাব পান এই কাউন্সিলর।

 

গত নির্বাচনে ঠেলাগাড়ি প্রতীকে বর্তমান ১০ হাজার ২২০ ভোট পেয়ে টানা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। করোনার সবচাইতে কঠোর মুহুর্ত্বে জনবান্ধব এই কাউন্সিলর বিতর্কিত হন ব্যক্তিগত স্ক্যান্ডালে। শেষ পর্যন্ত এই ঘটনায় আইসিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর থেকেই পলাতক আছেন এই কাউন্সিলর। যদিও এই ওয়ার্ডে আগে থেকে বেশ কয়েকজন আওয়ামী নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী। তবে খোরশেদের কার্যক্রমের তুলনায় তারা নেহাৎ পেছনে ছিল। ব্যক্তিগত স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে এবার এই কাউন্সিলর কতখানি সফল হতে পারেন তার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে।  ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ঘুড়ি প্রতীকে বাসদ নেতা কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস ৪ হাজার ২১৯ ভোট নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাম ঘরনার রাজনীতির সাথে জড়িত এমন একমাত্র কাউন্সিলর তিনি। সজ্জন এই কাউন্সিলরও এবার কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারেন।

 

নাসিক ২০ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান লাটিম প্রতীকে বিএনপি নেতা  গোলাম নবী মুরাদ ২ হাজার ৭০২ ভোট পেয়ে প্রথমবারে মত কাউন্সিলর হয়েছিলেন। এবার তার ওয়ার্ডেও মুখিয়ে আছেন বেশ কয়েকজন আওয়ামী নেতা। ফলে গতবারের মতো সহজ হবেনা এবার তার নির্বাচন। নাসিক কাউন্সিলরদের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলান এমন কাউন্সিলর দুজন।  একজন ২১ নম্বর ওয়ার্ডে রেডিও  প্রতীক নিয়ে  ৪ হাজার ৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত কাউন্সিলর বিএনপি নেতা হান্নান সরকার। আরেকজন ২২নম্বর ওয়ার্ডে লাটিম প্রতীকে কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা সুলতান আহম্মেদ ভূইয়া। গতবার তিনি পেয়েছেন ৭ হাজার ৬৩৩ ভোট।

 

এই দুজনই বন্দরে জাতীয় পার্টির সাথে সবচাইতে সখ্যতা রাখেন। সাথে মহানগর বিএনপির কার্যক্রমগুলোতে সরব থাকেন। আবার ২২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুলতান আহম্মেদের তো এখনও জাতীয় পার্টির পদ অব্যাহত রয়েছে। সবকূল সামলে তারা দুজন যুগপৎভবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এবারের নির্বাচনে তাদের এসব কৌশল টিকবে কিনা সেটিও বলা কঠিন। কেননা, এই দুই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা তাদের দলের লোকজনকেই কাউন্সিল হিসেবে চান। নাসিক ২৫নম্বর ওয়ার্ডে ঠেলাগাড়ি প্রতীকে বিএনপি নেতা এনায়েত হোসেন ৩ হাজার ২২১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।

 

নাসিক ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ঘুড়ি প্রতীকে বিএনপি নেতা মো. সামছুজ্জোহা ২ হাজার ৫১৫ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মত কাউন্সিলর হন। নাসিকের সবগুলো ওয়ার্ডের মধ্যে বন্দর এলাকায় বিএনপি কাউন্সিলরদের আধিপত্য মাথায় রেখেই এবারের নির্বাচনে বন্দরকে নিয়ে আলাদা ছক কষছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। ফলে বিএনপি’র বর্তমান কাউন্সিররা কতখানি ভাল করতে পারবেন সেটিও স্পষ্ট নয়। ২৭নম্বর ওয়ার্ডে ঠেলাগাড়ি প্রতীক নিয়ে বিএনপি নেতা কামরুজ্জামান বাবুল ২ হাজার ৮৪৪ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মত কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।  চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। 

 

এদিকে সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের মধ্যে  নাসিক সংরক্ষিত আসনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে (৭,৮ ও ৯) চশমা প্রতীকের মহিলা দলের আয়েশা আক্তার দিনা ১৪ হাজার ৪৪ ভোট পেয়ে প্রথমাবারের মত কাউন্সিলর হয়েছেন। রাজনীতি ও কাউন্সিলর হিসেবে তিনি শক্তিশালী প্রার্থী। এবার নির্বাচনে তিনি সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন না করে কাউন্সিলর হিসেবেও প্রার্থী হতে পারেন। নাসিকের অন্যতম প্রভাবশালী কাউন্সিলর আফসানা আফরোজ বিভা। যিনি বর্তমানে প্যানেল মেয়র-১ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। গত নির্বাচনে নাসিকের সংরক্ষিত ৬ নম্বর ওয়ার্ডে (১৬, ১৭, ১৮) বই প্রতীকে নগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানের স্ত্রী আফসানা আফরোজ ২১ হাজার ৬৮৭ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মত কাউন্সিলর হয়েছেন। বর্তমানে তিনি সবচাইতে প্রভাবশালী সংরক্ষিত কাউন্সিলর। এবারের নির্বাচনেও তিনি নিজ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে পারেন। 

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গতবারের নাসিক নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী ও সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য কয়েকগুন বেশি চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিএনপি যদি নাসিক নির্বাচনে না আসে সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা না আদায় করতে পারলে বর্তমানে কাউন্সিলর হিসেবে থাকা অনেকেই সামনের নির্বাচনে কাউন্সিলর হিসেবে থাকছেননা। সূত্র আরো জানায়, এমন আভাস বেশ আগে থেকেই পেয়ে বিএনপি সমর্থিত অনেক কাউন্সিলর আশাহত, আবার অনেকে ভোল পাল্টে স্বতন্ত্র হওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। রাজনৈতিক হাওয়া পরিবর্তন হতে পারে যে কোন সময়, আর সেটির অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকেই। আবার বর্তমান কয়েক কাউন্সিলর সরকার দলের নেতাদের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে উতরে যেতে চাচ্ছেন এই নীতিই বা কতখানি কাজে আসবে সেটি সময়ই বলবে। 
 

এই বিভাগের আরো খবর