শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

না’গঞ্জ রাজনীতির মসনদে বসছেন কে

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২২  

# না’গঞ্জকে নেতৃত্ব প্রদান করে অনুকরণীয় হিসেবে আছেন বেশ কিছু নেতা
# পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিতে না আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেন শামীম ওসমান

 

স্বাধীনতার সংগ্রামসহ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারায়ণগঞ্জের অবদান সব সময়ই গুরুত্ব বহন করে। স্বাধীনতার আগে ও পরের রাজনীতিতে বিভিন্ন কারণে সারা বাংলাদেশেই নারায়ণগঞ্জ এর নাম উঠে আসে। নারায়ণগঞ্জের অতি পরিচিত পরিবারগুলোর মধ্যে ওসমান পরিবারের তিন পুরুষ, চুনকা পরিবারের দুই পুরুষ ও জালাল হাজীর তিন পুরুষকে এখানকার রাজনৈতিক হিসেবে জনপ্রতিনিধির ভূমিকায় দেখা যায়।

 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এমন নেতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মসনদে বসে যারা নারায়ণগঞ্জকে নেতৃত্ব প্রদান করে জনগণের অনুকরনীয় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন তাদের সংখ্যাও কম নয়। এর মধ্যে অনেকেই মসনদের সম্রাট হতে পেরেছেন, অনেকে নিজে সম্রাট হতে না পারলেও সম্রাট নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন আবার অনেকে নিজে সম্রাট হয়েছেন আবার সম্রাট নির্মাণে ভূমিকাও রাখতে পেরেছেন।

 

নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বাধীনতার পর থেকে এ ধরণের অর্জনকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন একেএম শামসুজ্জোহা, আলী আহাম্মদ চুনকা, হাজী জালাল উদ্দিন, একেএম নাসিম ওসমান, কমান্ডার মোহাম্মদ আলী, একেএম শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। তবে এরপর এই মসনদে অধিষ্ঠিত কে হবেন তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

 

স্বাভাবিকভাবেই সবাই ধরে নিয়েছিলেন ওসমান পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম শেষে এই হাল ধরবেন চতুর্থ প্রজন্ম অর্থাৎ সাংসদ শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান কিংবা প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান। তবে আজমেরী ওসমানের রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে অনেকটা দুরে থাকার কারণে অয়ন ওসমানকেই নারায়ণগঞ্জ এর রাজনৈতিক মসনদের সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনায় রেখেছিলেন। বিশেষ করে ওসমান পরিবারের ভক্তদের সেই হিসেবেই প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়।

 

কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনের সেই বিশ্লেষণের ইতি টানেন স্বয়ং সাংসদ শামীম ওসমান। কিছুদিন আগে তিনি তার পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিতে না আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এই ঘোষণার কারণে এখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, আমলা, সুশীল সমাজের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে ‘কে হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের পরবর্তী সম্রাট?’

 

প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বাস এই নারায়ণগঞ্জের শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য ধারাবহিকভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সম্রাটের আভির্ভাব ঘটেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খান সাহেব ওসমান আলীর ছেলে একেএম শামছুজ্জোহার রাজনৈতিক প্রভাব। ১৯৭৩ সালে শামসুজ্জোহা সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন।

 

১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি নারায়ণগঞ্জের রাজনৈীতিক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুনাম অর্জন করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদান রাখায় তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকও প্রদান করা হয়। একেএম শামছুজ্জোহাকে তার কর্মের জন্য এখনও মনে রেখেছেন নারায়ণগঞ্জবাসী। এরপর তার তিন ছেলে নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমানও নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ভিন্ন দল থেকে সাংসদ নির্বাচিত

 

হন। একই সময় নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির আরেক সম্রাট আলী আহাম্মদ চুনকা। যিনি মৃত্যুর এত বছর পর তিনি আজও নারায়ণগঞ্জবাসীর মাঝে জীবিত আছেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন আলী আহম্মদ চুনকা। তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। পর পর দু’বার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। আলী আহাম্মদ চুনকা ১৯৮০ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে একেএম শামসুজ্জোহাকে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন।

 

তার বড় মেয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী টানা ১৮ বছর যাবত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা (পরবর্তীতে সিটি কর্পোরেশন)’র চেয়ারম্যান ও মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে আরেকটি নাম উঠে আসে। তাহলো নারায়ণগঞ্জ শহর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সাংসদ হাজী জালালউদ্দিন আহমেদ। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে যিনি জালাল হাজী নামেই পরিচিত। প্রথম জীবনে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এর সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।

 

১৯৭৮ সালে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘ দিন যাবত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কমিশনার ও ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও বন্দরের হাজী সিরাজউদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তাই আজও নারায়ণগঞ্জবাসী তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।

 

তার ছেলে অ্যাডভোকেট আবুল কালাম বিএনপি থেকে ৩ বার সাংসদ নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি মহানগর বিএনপির সভাপতি। আবুল কালামের ছেলে আবুল কাউসার আশাও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। নারায়ণগঞ্জ কলেজের ভিপি ছিলেন। বর্তমানে মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি। এরপর এই মসনদের সম্রাট হিসেবে আসেন ওসমান পরিবারের অন্যতম সদস্য একেএম শামীম ওসমান। মাধ্যমিকে লেখাপড়া করার সময় থেকেই তিনি রাজনীতি শুরু করেন এবং পরে নারায়ণগঞ্জ সরকারী তোলারাম কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন।

 

সেখান থেকেই তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯৬ ও ২০১৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। সর্বশেষ তিনি ২০১৮ সালে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। শামীম ওসমান শুধু রাজনৈতিক মসনদের সম্রাটই নন, তিনি সম্রাট তৈরির কারিগরও বটে। তার আশির্বাদে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে অনেকেই টপ লিস্টে চলে এসেছেন।

 

শামীম ওসমানের বড় ভাই একেএম নাসিম ওসমান ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। তার মেজু ভাই একেএম সেলিম ওসমানও জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত বর্তমান সাংসদ। এরপর যার নামটি না বললেই নয়, তিনি হলেন আলী আহাম্মদ চুনকার মেয়ে এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র (হ্যাট্রিক মেয়র) ডা. সেলিনা হায়াত আইভী।

 

যিনি ২০০৩ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার দায়িত্ব গ্রহণ করে এখন পর্যন্ত তার দায়িত্বে বীরের বেশে অবস্থান করছেন। যিনি নারায়ণগঞ্জ রাজনীতির নেতৃত্বে থেকে তার কর্মের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

 

এর বাইরেও নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির মসনদে বসতে না পারলেও এখানকার রাজনীতির অঙ্গনে বেশ পরিচিত মুখ হিসেবে অনেক রাজনীতিবিদের নাম চলে আসে। তারা হলেন কমান্ডার মোহাম্মদ আলী, এডভোকেট আবুল কালাম, অধ্যাপিকা নাজমা রহমান, এসএম আকরাম, সিরাজ কমান্ডার ও গিয়াসউদ্দিন। এদের মধ্যে কমান্ডার মোহাম্মদ আলী পরিচিতি পান বিএনপির রাজনীতিতে এসে। নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের কাছে তিনি ‘কিং মেকার’ হিসেবেই পরিচিত।

 

১৯৯১ সালে দেয়াল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন তিনি। পরে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে তিনি বিএনপির টিকেটে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি নিজে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। সে সময় শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সাংসদ হিসেবে গিয়াসউদ্দিনকে নির্বাচিত করার পিছনে তার ভূমিকা আছে বলে অনেকেরই ধারণা।

 

জনপ্রতিনিধি বানানো থেকে শুরু করে এমপি বানানো পর্যন্ত অনেক কাজেই তিনি বেশ পারদর্শী বলে একটি জনশ্রুতি আছে। এছাড়া ব্যবসায়ী মহলেও তার রয়েছে ভিন্ন এক আমেজ। আলী আহাম্মদ চুনকার মৃত্যুর পর অনেকটা বাধ্য হয়েই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ভূমিকায় আভিভার্ব ঘটে অধ্যাপিকা নাজমা রহমানের। ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করেন। সে সময় তিনি বেশ কিছু অবাঞ্চিত ঘটনার শিকার হয়ে আলোচনায় উঠে আসেন।

 

এরপর ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন এসএম আকরাম। সরকারী আমলা থেকে রাজনীতিতে আসা এসএম আকরামের ক্লীন ইমেজের কারণে বেশ সমাদৃত হন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন।

 

অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বিএনপি থেকে ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সাংসদ কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও ২০০১-এ নির্বাচিত সাংসদ গিয়াসউদ্দিনও বেশ দাপটের সাথে রাজত্ব করেন। তবে বর্তমান প্রজন্মের পর অর্থাৎ একেএম শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পর এই মসনদে কে আসছেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে নারায়ণগঞ্জবাসীকে।

এই বিভাগের আরো খবর