শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

না’গঞ্জে ৪৮ ঘন্টায় গড়ে ২ ধর্ষণ

মো. মোমিনুল ইসলাম 

প্রকাশিত: ১৫ জুন ২০২১  

আইন পরিবর্তন কিংবা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান, কোন কিছুতেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা ধর্ষণের মতো পৈশাচিক নির্যাতন। নারায়ণগঞ্জের সর্বত্রে ক্রমশই বাড়ছে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অপরাধ। অনিয়ন্ত্রিত এই যৌন লালসা’র শিকার হচ্ছে জেলার শিশু-আবাল-বৃদ্ধা-বনিতাসহ সববয়সীরা।

 

সূত্র জানিয়েছে, বিগত সাড়ে তিন বছরে নারায়ণগঞ্জ জেলা জুড়ে ৫৭৫টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে ৪২০টি, গণধর্ষণ ৫১টি, যৌন নির্যাতন কিংবা ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১০৪টি। সেই হিসাবে নারায়ণগঞ্জে প্রতি ৪৮ ঘন্টায় একজন নারী  অথবা শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
 


সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, এই সাড়ে ৩ বছরে শুধু নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানাতেই ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২১টি, ধর্ষণচেষ্টা ১০টি, অন্যান্য নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫১টি। ফতুল্লা এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৪টি, গণধর্ষণের ঘটনা ৬টি, ধর্ষণ চেষ্টা ১৯টি, অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা ১৪১টি। সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ধষর্ণ মামলা হয়েছে ৭২টি, গণধর্ষণের মামলা ৬টি, ধর্ষণ চেষ্টা ১৩টি এবং অন্যান্য নির্যাতনের ৭৮টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। সূত্র জানায়, এর বাইরে বন্দর থানায় ৬৯টি ধর্ষণ, ৭টি গণধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি এবং অন্যান্য নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৪৬। সোনারগাঁ থানায় ৪৯টি ধর্ষণ, গণধর্ষণ ৯টি, অন্যান্য যৌন নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫২টি। আড়াইহাজার থানায় ৩৭টি ধর্ষণ, ৪টি গণধর্ষণ, ১০টি ধর্ষণ চেষ্টা এবং অন্যান্য ৩২টি নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। রূপগঞ্জ থানায় ৬৮টি ধর্ষণ, গণধর্ষণ ১৯টি, ধর্ষণ চেষ্টা ৩৩টি, অন্যান্য ১২২টি নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে।
 

নারায়ণগঞ্জে ধর্ষণ দৃশ্যত অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার পেছনে কঠোর আইনের চেয়ে আইন প্রয়োগ না হওয়াকে দায়ী করছেন অনেকেই। আইন কিংবা সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করে ধর্ষণের এই মহামারী রোধ করা সম্ভব নয়। তারা বলছেন, সরকারের ইচ্ছা থাকলে বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করেও ধর্ষণ রোধ করা সম্ভব হতো। বেশ কিছু আলোচিত ঘটনার পর ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এর একদিন পর আইনটির অধ্যাদেশে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। সেই সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদন্ড করায় এই অপরাধ কমে আসবে বলে তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। মামলাটি সংশোধন হওয়ার পর গত ১৯ মাসে শুধু মাত্র নারায়ণগঞ্জেই যৌন নির্যাতনের ৩১৩ টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যার মধ্যে ধর্ষণ ২০৬, গণধর্ষণ ২৪ ও ধর্ষণের চেষ্টার ঘনটনা ৮৩টি রয়েছে। অপর দিকে মামলাটি সংশোধন হওয়ার ১৯ মাসে আগে জেলা জুড়ে মোট ২৮৭টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ধর্ষণ ১৮৯, গণধর্ষণ ২৯ ও ধর্ষণের চেষ্টার ৬৯টি। যা আইনটি সংশোধণ হওয়ার পর ২৬টি নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে।


 
বিশিষ্টজনরা বলছেন, আইনের ন্যায় প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। পূর্বের আইনে যাবজ্জীবনের বিধান ছিল। ধর্ষণ মামলার যে প্রচলিত তদন্ত এবং বিচার পদ্ধতি, তাতে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। আবার এখন মৃত্যুদন্ডের বিধান হলে বিচারকরা তো আরো সতর্ক হবেন। কারণ, এটা জীবনের প্রশ্ন হয়ে উঠবে। তাই সঠিক তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি চালু করতে হবে। অপরাধ প্রমাণ না করতে পারলে কঠোর আইন তো প্রয়োগ করা যাবে না।


 
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি লক্ষী চক্রবর্তী যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘এ ব্যাধিটিকে মোকাবেলা করতে হলে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারণা চালাতে হবে। এখানে ডিসি, এসপিসহ জনপ্রতিনিধিরা তাদের নির্বাচনী এলাকাগুলোতে বিশেষভাবে কাজ করতে পারেন। ধর্ষণ মামলায় যাতে সহজে অভিযুক্তরা জামিন না পান এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’


 
এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আইনে শুধু কঠোর করেই ধর্ষণ রোধ করা সম্ভবনা। আগে যে আইন ছিল সেই আইনটির মাধ্যমেই এটি রোধ করা সম্ভব হতো। তবে এখানে সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ধর্ষণের অনেক ঘটনায় ক্ষমতাসীনদের লোকজন জড়িত ছিল, কিন্তু তারা প্রভাব খাটিয়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় জামিন পেয়ে গেছে। এতে ধর্ষকরা উৎসাহিত হয়। এসব বন্ধ করতে হবে।’  

এই বিভাগের আরো খবর