বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

নারায়ণগঞ্জেই প্রথম পাকিস্তান বাহিনীর উপর আক্রমন করা হয়েছিল

মো. মোহর আলী

প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ে মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোহর আলীর লেখা পাকিস্তান বাহিনীর উপর নারায়ণগঞ্জে প্রথম হামলার কাহিনী।

 

 

একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তান বাহিনীকে বিতারণ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। এরপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

 

 

নারায়ণগঞ্জের বর্তমান প্রজন্মের তরুণ যুবকরা অনেকেই জানেনা যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর নারায়ণগঞ্জেই প্রথম পাকিস্তান বাহিনীর উপর হামলা করেছিল নারায়ণগঞ্জে আপামর ছাত্র-জনতা। আমরা যারা পাকিস্তানীদের উপর সেই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলাম তারা এখনো সেই যুদ্ধের জন্য গৌরববোধ করি।

 

 

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর অস্ত্রধারী সরকারী বাহিনী হিসেবে পিলখানায় ইপিআর এবং রাজারবাগে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রথম পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিলেন।

 

 

আর সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বিভিন্ন উৎস থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান বাহিনীর উপর হামলা নারায়নগঞ্জেই প্রথম হয়েছিল। সে হামলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার ৪০ ঘন্টার মধ্যে।

 

 

আমার জানা মতে, পিলখানায় ইপিআর এবং রাজারবাগে পুলিশ ব্যারাকে পাকিস্তান বাহিনী হামলা করলে ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তান বাহিনীতে প্রতিরোধ করেছিলেন, নিজেরা উদ্যোগী হয়ে পাকিস্তান বাহিনীর উপর হামলার সুযোগ পাননি।

 

 

তারও আগে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যসহ স্থানীয় লোকজন পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই। নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তান বাহিনীর উপর প্রথম হামলা এবং যুদ্ধে ছাত্ররাজনীতির একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে অংশগ্রহণ করার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম।

 

 

পরবর্তীতে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর উপর প্রথম হামলায় অংশ নেয়া ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। সেই দিনের কথা মনে হলে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।

 

 

আমি তখন নারায়নগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তোলারাম কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। একই সঙ্গে নারায়নগঞ্জ শহর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক। একই সঙ্গে সিদ্দিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি। আমার বাড়ি নারায়নগঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জ থানার ঐহিত্যবাহী শিল্পাঞ্চল গোদনাইল গ্রামে।

 

 

শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে একাধিক কলকারখানা পরিবেষ্টিত গোদনাইল গ্রাম। গোদনাইলের উত্তর দিকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী জুট মিল। ব্রিটিশ আমল থেকেই গোদনাইলে সুতাকল শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে।

 

 

ফলে পুরো এলাকা ছিল রাজনীতি সচেতন। স্কুলে পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে আমাদের সিনিয়র হাজেরা আপা (শিক্ষক, এখন প্রয়াত) আমাদের হাত ধরে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নিয়ে যেতেন। তোলারাম কলেজে ভর্তির পর ছাত্র রাজনীতিতে পুরোপুরি মিশে যাই।

 

 

পাকিস্তান বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় প্রথম গণহত্যা শুরু করার কিছু সময়ের মধ্যেই ঢাকার খুব কাছের শহর নারায়ণগঞ্জে বসে আমরা সে গণহত্যার ভয়াবহতা টের পাই। পাকিস্তান বাহিনীর কামানের গোলা ছোড়া এবং মেসিনগানের গুলীর শব্দ আমরা মাত্র ৮/১০ কিলোমিটার (সোজা পথে) দূরে (নারায়ণগঞ্জে) বসে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।

 

 

এর আগে একাত্তরের মার্চের প্রথম দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর কমিটিতে আমি সক্রিয় হয়ে উঠি। যারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে ছিলেন (যতদূর মনে পড়ে)  সিরাজুল ইসলাম, আব্দুস ছাত্তার, ফয়েজুর রহমান, মো. শাহজাহান, মোবারক হোসেন, সাহাবুদ্দিন আহমেদ, খোরশেদ আলম দুদু, খবির আহমেদ, আব্দুর রাশেদ রাশু, কুতুবউদ্দিন মাহমুদ, আব্দুল মোতালিব, মোহর আলী চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিলন, নাজিমউদ্দিন মাহমুদ, তোফাজ্জল হোসেন খাঁন প্রমুখ।

 

 

তারা সবাই তখন ছিলেন জাদরেল ছাত্রনেতা। আর একেএম শামসুজ্জোহা, আলী আহম্মদ চুনকা,  আফজাল হোসেন, আঃ সাত্তার ভূঞা প্রমুখ ছিলেন জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা। তারাই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

 

 

নারায়ণগঞ্জ ২নং রেলগেট এলাকায় রহমতউল্লাহ ইনষ্টিটিউট মিলনায়তনে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিদিন সকাল-বিকেলে হাজার হাজার মানুষ সেখানে সমবেত হতেন নেতাদের বক্তব্য এবং নির্দেশ শোনার জন্য। তখন নারায়ণগঞ্জের সব ধরণের রাজনৈতিক আন্দোলনে আদমজীসহ সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন সুতাকলের শ্রমিকদের প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশী।

 

 

একাত্তরের ৭ মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জের সিনিয়র নেতা রমিজ উদ্দিন ভূইয়া, ডা. নূরুল হক, ডা. আবদুল মালেক প্রমুখ নেতার নেতৃত্বে আদমজী জুট মিলসহ শীতলক্ষ্যা পাড়ের বিভিন্ন কলকারখানার হাজার হাজার শ্রমিক দীর্ঘ পথ হেটে রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে যায়।

 

 

আমিসহ অনেক ছাত্রকর্মীও সেই মিছিলে শ্লোগান দিতে দিতে রেসকোর্স ময়দানে যাই। লাখো জনতার সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

 

 

বঙ্গবন্ধু সরাসরি দেশের মানুষকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়ে বললেন‘ ’তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।

 

 

তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু - আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।’ বঙ্গবন্ধুর এমন বক্তৃতার পর নেতারা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করারই ইঙ্গিত দিলেন।

 

 

এ অবস্থায় দেশের অন্যান্য স্থানের মতো নারায়ণগঞ্জের ছাত্র-যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দেওভোগসহ কয়েকটি এলাকায় নানাভাবে অস্ত্র প্রশিক্ষন দেয়া শুরু হয়। সাবেক সেনা, পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা এ প্রশিক্ষন দিতে এগিয়ে আসেন।

 

 

আমি ছাত্রাবস্থায় সিভিল ডিফেন্স এবং আনসার বাহিনীর ট্রেনিং নিয়েছিলাম। ফলে আমি রাইফেল ও দোনলা বন্দুক চালাতে জানতাম। তাতে আমার মনোবল ছিল অন্যদের চেয়ে চাঙ্গা। একই সঙ্গে গোপনে বোমা তৈরি চেষ্টাও করা হয়।

 

 

কয়েকটি বোমা তৈরি করে গোদনাইল এলাকায় পাঠানো হয় পরীক্ষা করার জন্য। সেগুলো আমরা আদমজী-নারায়ণগঞ্জ সড়কে ছুড়ে বিষ্ফোরণ ঘটাই। তাতে বোমা ফাটানোর ছোটখাট ট্রেনিংও হয়ে যায়।

 

 

২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন রহমতউল্লাহ ইনষ্টিটিউটের সামনের সড়কে সমাবেশ হয়। নেতারা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে নারায়ণগঞ্জে প্রতিরোধ করার ঘোষণা দেন। আমরা ছাত্রনেতারাও যে যেখানে ছিলাম চলে আসি সমাবেশে। তখন শোনা যাচ্ছিল যে, ঢাকা থেকে পাকিস্তান বাহিনী হামলা করতে নারায়ণগঞ্জের দিকে আসছে।

 

 

ইতিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে যাত্রাবাড়ি থেকে পোস্তগোল, স্যামপুর, আলীগঞ্জ, পাগলা, ফতুল্লা, পঞ্চবটি, জামতলা হয়ে শহরে ঢোকার প্রবেশ পথ চাষাড়া পর্যন্ত পুরো এলাকায় সড়ক কোথাও মাটি কেটে গর্ত করে, কোথাও সড়কের পাশের গাছ কেটে, কোথাও ভাঙ্গা গাড়ি দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়, যাতে পাকিস্তান বাহিনীর গাড়ি নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে।

 

 

২৭ মার্চ সকালে আমরা গোদনাইলের চিত্তরঞ্জন কটন মিলের মাঠে বিশাল জনসভা করি। জনসভা শেষ করে ১১টার দিকে আমরা ছাত্রজনতার মিছিল নিয়ে রহমতউল্লাহ ইনষ্টিটিউটের সামনের সমাবেশে যোগদান করি।

 

 

তখন আমার সঙ্গে এলাকার ছাত্রনেতা শাহজাহান এবং পকিস্তান নৌবাহিনীর সদস্য আবদুল রহিম ছিলেন। রহিম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। সে আর পাকিস্তানে ফিরে না গিয়ে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে।

 

 

সমাবেশ শেষ করে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নেন আদালত ভবনসহ বিভিন্ন কলকারখানায় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে থাকা বন্দুক লুট করে নিয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের হাতে দিয়ে দেয়ার। সে অস্ত্র দিয়েই পাকিস্তান বাহিনীর উপর হামলা করা হবে।

 

 

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমে আমরা ছাত্রনেতারা বেশ কিছু কর্মীসহ প্রথমে আদালত ভবনে যাই। সিরাজুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার প্রমুখ অস্ত্রলুটের অভিযানে নেতৃত্ব দেন। আদালত ভবনে অস্ত্রখানার তালা ভেঙ্গে প্রায় (যতটুকু মনে পড়ছে) ৩শ’ বন্দুক পাই। তবে সে অস্ত্রখানার পাহাড়ায় থাকা পুলিশ আমাদের অস্ত্র লুটে সহযোগিতা করে।

 

 

সেখান থেকে আমরা ৫নং লঞ্চঘাটে গিয়ে একটি ছোট লঞ্চ নিয়ে শীতলক্ষ্যা পাড়ের বিভিন্ন সুতা ও পাট কলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিনিয়র ছাত্রনেতারাও লঞ্চে চড়ে অস্ত্র লুটের জন্য বিভিন্ন কারখানায় যান।

 

 

একে একে শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড, বেঙ্গল জুট বেলিং, জেএমসি, আদর্শ, লক্ষ্মীনারায়ণ, চিত্তরঞ্জন, ঢাকেশ্বরী ১ ও ২নং কটন মিলে গিয়ে সব অস্ত্র লুট করে নিয়ে কর্মীদের হাতে হাতে দিয়ে দেয়া হয়। আমার বাড়ির কাছে ঢাকেশ্বরী কটন মিল। অস্ত্র লুট করতে করতে দুপুর হয়ে যাওয়ায় আমি লঞ্চ থেকে একটি দোনলা বন্দুক নিয়ে নেমে দুপুরে খেতে বাড়িতে যাই।

 

 

আমার সঙ্গে শাহজাহান ও আবদুর রহিমও দুপুরের খাওয়ার জন্য বাড়িতে যায়। নেতারা বলে দেন, খেয়ে তাড়াতাড়ি যেন বন্দুক নিয়ে চাষাড়ার দিকে চলে যাই। আমি তাদের বলি পাকিস্তান বাহিনীর গুলীর শব্দ পেলেই আমরা অস্ত্র নিয়ে দৌড়ে চলে যাব। একই কথা বললো শাহজাহান ও রহিম।

 

 

বিকেল হওয়ার আগেই চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, পাকিস্তান বাহিনী পাগলা পর্যন্ত চলে এসেছে। তারা বুলডোজার দিয়ে সড়কের সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। আসতে আসতে সামনে যাকে পাচ্ছে মেসিন গানের গুলীতে হত্যা করছে। সড়কের পাশে সব বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে দিতে আসছে।

 

 

আমরা পাকিস্তান বাহিনী আসছে এমন খবর পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা দৌড়ে চাষাড়ার দিকে যেতে থাকি। কিন্তু আমরা চাষাড়া থেকে আধা মাইল দূরে থাকতেই পাকিস্তান বাহিনী মেশিন গানের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে জামতলা কবরস্থান পর্যন্ত।

 

 

ইতিমধ্যে সেখানে আগে থেকেই অস্ত্রসহ অবস্থান নেয়া নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান বাহিনীর গুলীর শব্দ পেয়েই তাদের প্রতিরোধ করতে পাল্টা হামলা শুরু করে। এরই মধ্যে আমরা চাষাড়ায় পৌছে যাই। তখন কয়েক দিক থেকে গুলী করায় পাকিস্তান বাহিনী অনেকটা বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

 

 

এমন গুলীর মুখে পড়বে তা তাদের ধারনায় ছিলনা। এছাড়াও সড়কে অসংখ্য ব্যারিকেড ছিল, যা খুব সহজে সরিয়ে দেয়া পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিলনা। একদিকে ব্যারিকেড অন্য দিকে চারদিক থেকে হামলা এমন অবস্থায় পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে আর সামনে এগুনো সম্ভব ছিলনা। তারা সাহসও পায়নি।

 

 

তারা থেমে পঞ্চবটির কাছে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষক করতে থাকে এবং ঢাকায় সেনানিবাসে আরো সৈন্য পাঠানোর জন্য খবর পাঠায়। এরই মধ্যে রাত নেমে আসে। কিন্তু ছাত্র জনতা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। এভাবে ২৭ মার্চ রাত কেটে যায়। সেদিন পাকিস্তান বাহিনীর উপর হামলা করে প্রায় ২৪ ঘন্টা তাদের শহরে ঢুকতে দেয়া হয়নি।  

 

 

এ ভাবে সারা রাত হামলা চলে পাকিস্তান বাহিনীর উপর। এ হামলার পর পাকিস্তান বাহিনী টের পায় নারায়ণগঞ্জে ছাত্র-জনতার শক্ত অবস্থানের বিষয়টি। ২৮ মার্চ দুপুরের দিকে তারা আরো সৈন্য এবং ভারী অস্ত্র দিয়ে গুলী করতে করতে এগিয়ে আসে। বুলডোজার দিয়ে সড়কের ব্যারিকেড পরিস্কার করে।

 

 

তাদের মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারের সামনে সাধারন বন্দুক দিয়ে গুলী করে আমাদের টিকে থাকা কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা। পাকিস্তানী বাহিনী পঞ্চবটিতে প্রথম শক্ত ব্যারিকেড সরিয়ে এগিয়ে এসেই দুই পাশের বাড়িঘরে ঢুকে সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে।

 

 

তবে আগের দিন পাকিস্তান বাহিনীকে পঞ্চবটিতে আটকে রাখার সুযোগে অনেক মানুষই আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে শহর ছেড়ে নদী পেরিয়ে নবীগঞ্জ, বন্দর, সোনাকান্দার দিকে সরে যায়। সেদিন পাকিস্তান বাহিনীর গুলীতে পঞ্চবটি থেকে জামতলা পর্যন্ত প্রায় ২০ জনের মতো শহীদ হন।

 

 

২৮ মার্চ দুপুরের পরপরই আমাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে আমরা আর পেরে উঠছিনা বুঝতে পেরে অনেকেই পিছু হটে সরে যেতে থাকে। এভাবেই পাকিস্তান বাহিনীর উপর প্রথম হামলার ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।

 

 

পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সেই হামলায় অংশ নেয়া অনেক ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতা পরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন নিতে ভারতের আগরতলায় চলে যাই। আগরতলা থেকে ফিরে আমরা পাকিস্তানী সৈণ্যদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করে তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হই।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর