বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নিম্নমুখী হচ্ছে ভূগর্ভের পানি

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০২১  

# এক বছরে ১৩ ফুট গভীরে নেমেছে সুপেয় পানির স্তর
# ৯৯ শতাংশ পানি উত্তলণ করছে ডাইং কারখানা : এবি সিদ্দিক
# ভূগর্ভে পানির নাগাল না পাওয়ায় বিকল হচ্ছে পানির মটর
# দুই যুগ পর ৫০০ ফুট গভীরেও সুপেয় পানি না পাওয়ার শঙ্কা
# উপরি ভাগের পানি ব্যবহারে জোর দিতে হবে : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল
# উপরি ভাগের পানি ব্যবহারের প্রকল্প নেই : ডিসি

 
ক্রমশই নিচে নেমে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ভূগর্ভের পানির স্তর। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে আশঙ্কা জনক হারে ভূগর্ভের পানির স্তর নিম্নমুখি হচ্ছে। এতে ভূমিকম্পসহ পরিবেশে নানামুখি বিরুপ প্রভাব পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন পরিবেশবীদরা। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে প্রতিবছর ভূগর্ভের সূপেয় পানির স্তর পরিমাপ বা নির্নয় করে থাকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। দপ্তরটির সদর উপজেলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের ব্যবধানে চলতি বছর সদর উপজেলার ফতুল্লা, এনায়েতনগর ও কাশিপুর ইউনিয়নে গড়ে ১০ ফুট করে নেমেছে পানির স্তর। এছাড়া কুতুবপুর, গোগনগর, আলীরটেক ও বক্তাবলী ইউনিয়নে পানির স্তর নেমেছে ১ থেকে ২ ফুট নিচে।

 
একই উপজেলার পৃথক ইউনিয়নগুলোতে পানির স্তর নিম্নমুখি হওয়ার এই তারতম্যের বিষয়ে সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানান, ‘সদর উপজেলার মধ্যে ফতুল্লা, এনায়েতনগর ও কাশিপুর ইউনিয়ন শিল্প কারখানা অধ্যুষিত এলাকা। এসব এলাকায় গড়ে উঠা ডাইং কারখানাগুলোর পানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। এতে ভূগর্ভের পানির উপর চাপ বৃদ্ধিপাচ্ছে। তাই অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় এসব ইউনিয়নে আশঙ্কাজনক হারে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।’  


জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, গত বছর এনায়েতনগর ইউনিয়নে সুপেয় পানি মিলতো ১৭৫ ফুট গভীরে। এই বছর আরো ১৩ ফুট গভীরে গিয়ে ১৮৮ ফুটে মিলছে এনায়েতনগরে ভূগর্ভের সুপেয় পানি।


এদিকে, গত বছরের তুলনায় এবছর ফতুল্লা ইউনিয়নে ৮ ফুট গভীরে নেমছে ভূ-গর্ভের পানি। যেখানে ১৯০ ফুট গভীরে পাওয়া যেত সুপেয় পানি, সেখানে এখন পানির স্তর মিলছে ১৯৮ ফুট গভীরে। এক বছরের ব্যবধানে কাশিপুরে পানির স্তর নেমেছে ৬ ফুট গভীরে। বর্তমানে এই ইউনিয়নে পানির স্তর ১৭১ ফুট গভীরে রয়েছে। গত বছরের তুলনায় ২ ফুট নিচে নেমে ১৪২ ফুট গভীরে মিলছে গোগনগর ইউনিয়নের সুপেয় পানির স্তর। আর ১ ফুট করে নিচে নেমে ১০৬ ফুট গভীরে রয়েছে আলীরটেক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের পানির স্তর।


এদিকে, সুপেয় পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নিচে রয়েছে উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে। ২৩০ ফুট গভীরে গিয়ে ওই অঞ্চলে মিলছে সুপেয় পানির স্তর।
এদিকে, বছর বছর সুপেয় পানির স্তর নিচে নামায় নানা বিপত্তি দেখা দিচ্ছে এসব অঞ্চলে। ফতুল্লার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পাম্প টেকনিশিয়ান শাহীন জানান, গত কয়েক বছর ধরে ভূগর্ভের পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। তাই ভূগর্ভে স্থাপনকৃত সাবমার্সিবল পাম্পগুলো পানির নাগাল না পাওয়ায় প্রায় সময়ই জ্বলে যাচ্ছে। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মটর বিকল হয়ে গেছে। যা আমরা সংস্কার করেছি।”


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে শহরতলীতে সূপেয় পানির জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ ফুট গভীরে নলকুপ স্থাপন করা হয়। ৫০০ ফুট গভীর খননের পরও পানি মিলছে ২৫০ ফুট গভীরে। অর্থাৎ, ৫০০ ফুট গভীরে যারা নলকুপ খনন করেছেন, তাদের অবশিষ্ট পানির স্তর রয়েছে ২৫০ ফুট নিচে।  


এক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের শঙ্কা- প্রতিবছর গড়ে ১০ ফুট করে পানির স্তর নিচে নামা অব্যাহত থাকলে অবশিষ্ট ২৫০ ফুট পানির স্তর ফুড়িয়ে যেতে সময় লাগবে প্রায় ২ যুগ। অর্থাৎ আগামী দুই যুগ পর ৫০০ ফুট গভীর খননের নলকুপগুলো পরিত্যক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। এমনটা হলে প্রতিটি বসত বাড়িতে আবারও নতুন করে স্থাপন করতে হবে ৫০০ ফুটেরও গভীর নলকুপ। অন্যথায় সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পরার সম্ভাবনা রয়েছে নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে।  


বাংলাদেশ পরিবেশবাদী আন্দোলনের সভাপতি এবি সিদ্দিক দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেছিলেন- ‘গত ৮-১০ বছর ধরে এই বিষয়ে কাজ করছি। কিন্তু উপরি ভাগের পানি দূষিত হওয়ায় মানুষ সুপেয় পানির জন্য উপায় না পেয়ে এ ৫০০ ফুট গভীরে মটর স্থাপন করছে। ভূগর্ভের পানি সবচেয়ে বেশি উত্তোলন করছে ডাইং কারখানাগুলো। একটি ডাইং কারখানা একদিনে যেই পরিমানে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন করে, তা দিয়ে শহরের অর্ধেক মানুষের প্রয়োজন মিটে যাবে। ৯৯ শতাংশ পানি উত্তলণ করছে ডাইং কারখানা গুলো। সরকার সেদিকে নজর দিচ্ছে না।’ 


সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী শাহ-আলম এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ভূগর্ভের পানি বাঁচাতে হলে উপরি ভাগের পানি ব্যবহারে জোর দিতে হবে। যেমন, পুকুর, খাল বিল ও নদীর পানি ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এসব পানিও ব্যবহার যোগ্য নয়, দূষিত হয়ে পড়েছে। তাই ভূগর্ভের পানি ব্যবহারে ঝুঁকেছে মানুষ।

 

তবে, এভাবে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করাটা পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরুপ। তাই সরকার ইতিমধ্যে নদীর উপরি ভাগের পানি ব্যবহারের জন্য প্রকল্প নিয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব জায়গাতেই এই উদ্যোগ নেয়া হতে পারে।’   
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে নদী বা উপরি ভাগের পানি ব্যবহারের জন্য আগামীতে কোন প্রকল্প নেয়া হবে কিনা- এমন কোন তথ্য আমার কাছে নেই। তথ্য পেলে জানিয়ে দেয়া হবে।’
 

এই বিভাগের আরো খবর