শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নির্বাচনে কাউন্সিলরের বিপক্ষে যাওয়ায় ডেকে নিয়ে খুন

রাকিবুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২২  

# হত্যা মামলার প্রধান আসামি কাউন্সিলর মনির
# পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী শুভ্রত
# ধামাচাপা দিতে পরিবারকে টাকার প্রস্তাব

 

নারায়ণগঞ্জে একের পর এক কিশোরগ্যাং গ্রুপের নির্যাতন ছুরিকাঘাতে একাধিক কিশোর নিহত হয়েছে। প্রতিটি খুনের ঘটনায় তেমন কোন বড় কারণ নেই। ছোট খাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সকল হত্যার ঘটনা ঘটছে। কিছু ঘটনারে ক্ষেত্রে র‌্যাব ১১’র তৎপরতায় অনেক আসামি গ্রেপ্তার হলেও তাদের বিচারিক কার্যক্রম দীর্ঘ মেয়াদি হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবার বিচারের আশা পর্যন্ত ছেড়ে দিচ্ছে।

 

গত সপ্তাহে ইসাদাইর রাবেয়া স্কুলে সামনে ধ্রুব নামে স্কুল ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে কিশোরগ্যাং গ্রুপ। এই রেশ কাটতে না কাটতেই সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান কাউন্সিলর মনির হোসেনের পক্ষে কাজ না করায় নগরীর পশ্চিম দেওভোগ ইউসুফ আলীর বাড়ির সামনে শুভ্রত মণ্ডল জয় (২২) নামের এক যুবককে ডেকে নিয়ে সারা রাত নির্যাতন করা হয়।

 

ইতিমধ্যে এই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। একই সাথে  মৃত্যুর আগে শুভ্রত একটি ভিডিওতে তাকে যারা রাতভর নির্যাতন করেছে সেই সকল ব্যক্তিদের নাম ও তাকে নির্যাতনের বলে গেছেন। রোববার সকালে মারা যায় সুভ্রত। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় নিহতের বড় বোন শম্পা মন্ডল বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলায় কাউন্সিলর মনিরসহ ১১ জনের নাম উল্লেখসহ ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

 

সচেতন মহল বলছেন নারায়ণগঞ্জে যে হারে কিশোরগ্যাং গ্রুপ ধারা নিয়াতিত হয়ে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে তা যদি এখনি লাগাম টেনে না ধরা হয় তাহলে শান্ত নারায়ণগঞ্জ অস্থিরতা তৈরি হবে। অল্প বয়সি ছেলেরা হিংস্র রুপে যাওয়া মানুষের মাঝে এক আতঙ্ক বিরাজ করছে। এবিষয়ে প্রশাসন থেকে প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের সতর্ক থাকার আহবান জানানো হলেও তাদের যেন কোন কর্ণপাত হচ্ছে না।

 

সুব্রত হত্যা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে আছে। পরিবার অভিযোগ করছে নিহতের নির্যাতনের ৭ দিন পেরিয়ে গেলেও এ্ই ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে নাই। তাই সচেতন মহল প্রশ্ন তোলেন এই ঘটনায় কাউন্সির মনিরসহ তার সাঙ্গপাঙ্গরা জড়িত থাকায় বলে প্রশাসন প্রথমে কিছুটা নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুভ্রতকে রাতে বাড়ি থেকে ঢেকে নিয়ে নির্মম ভাবে নিার্যতন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরের লোকজন নির্যাতন করেছে বলে জানান নিহত শুভ্রত। ১৩ হামলাকারীর নাম বলে গেছে নিহত শুভ্রত। যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

 

গত ১৬ মে রাত সাড়ে ১২টার দিকে তার ছোটভাইকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় দুই ঘন্টা পর রাত আড়াইটায় গুরুতরভাবে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় তাকে বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায় আসামিরা। পরে সুভ্রত নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।সেখানে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) শয্যা না পেয়ে প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতাল নামে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। রোববার সকালে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সুভ্রত মণ্ডল জয়।


মৃত্যূর আগে শুভ্র এক ভিডিওতে বলেন, নাসিক নির্বাচনে কাউন্সিলের মনিরের পক্ষে কাজ করার জন্য তার কাছের লোক সায়েম আমাকে কাজ করতে বলেন। কিন্তু ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সফিউদ্দিন করোনার সময় আমাদের পরিবারকে সহযোগিতা করে। তাই আমি নির্বাচনে সফিউদ্দিন কাকার পক্ষে কাজ করি। মনিরের পক্ষে কাজ না করায় সেই জের ধরে তারা আমাকে ধরে নিয়ে রাতভর নির্যাতন করে তারা আমাকে বাসার সামনে ফেলে রেখে যায়। তখন আমি সেন্সলেস ছিলাম।  


এর আগে নিহত শুভ্রত নির্যাতনকারীদের নাম উল্লেখ করেন, নাসিক ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনির,  পশ্চিম দেওভোগের সাদেরুল আলম ভূইয়ার দুই ছেলে সায়েম ওরফে ইয়াবা সায়েম (৩০), সাজিদ ভূইয়া, (৩৬), পশ্চিম দেওভোগের বাসিন্দা নাছির উদ্দিনের ছেলে নাঈম উদ্দিন বাবু (৩০), বাইজিদের ছেলে দোলন (২৫), মুন্সিবাড়ী দিঘির পশ্চিমপাড় নিজামের ছেলে  নোমান (২২),

 

নারায়ণ চন্দ্রের ছেলে প্রণয় (২২), রিংকু (৩০), তন্ময় (২২), দোলন (২৫), আল-আমিন (২৫), নোমান (২২), রাকেশ (২০), সুদেব (৩২), অনিক রাজিব (২৬) ও মানিককে (২৫) আসামী করা হয়েছে। তারা নিজেরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালান এবং এলাকায় তারা সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে পরিচিত।


নিহত শুভ্রর বোন সম্পা মন্ডল কান্নারত অবস্থায় বলেন, আমার ভাই মরার আগে জবানবন্দী দিয়ে তার হত্যাকারীদের নাম বলে গেছে পুলিশের কাছে সেই ভিডিও আছে। আমার ভাইয়ের সাথে তাদের কোন বিরোধ ছিলনা, নির্বাচনে কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনিরের পক্ষে কাজ না করায় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার ভাই শুভ্র। নির্বাচনে তার পক্ষে কাজ না করার কারণে যদি আমাদের মত অসহায় পরিবারের ভাইদের হারাতে হয় তাহলে আমরা কই যাবো।

 

তারা আমার নিরাপরাধ ভাইকে এইভাবে মেরে ফেললো। তাদের কাছে আমার ভাই কি অপরাধ করেছিল। কেন আমার ভাইকে এভাবে জিবন দিতে হলো ।এভাবে মানুষ মানুষকে মারে না। তারা এখন বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দিয়ে ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমার ভাই এখনোতো দুনিয়াটা  দেখলো না। আমার মা তার সন্তানের কামাই রোজগার খেতে পারলো না। আমার মা অকালে বিছনায় পড়ে আছে ।


তার পাশে আরেক বোন লিপি মন্ডল বলেন, আমরা আমাদের ভাইয়ের হত্যাকারীদের সকল আসামীদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সঠিক বিচার চাই। সেই সাথে হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই। তাদের কারণে আর কোন মাকে যেন সন্তান হারা হতে না হয়। আমাদের পরিবারে একমাত্র উপার্জন কারি ব্যক্তি ছিলেন আমার আদরের ছোট ভাই শুভ্রত। তার রোজগারে  আমাদের আমাদের সংসার চলত।

 

আমাদের ভাই চলে যাওয়া আমার মা এখন কিভাবে চলবে, আমাদের সব শেষ । পুলিশ প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ করে বলেন, এই পর্যন্ত কোন আসামী গ্রেফতার করা হয়নি, পুলিশ তো আমাদের পিছনে ঘুরছে শুধু তারা কোন এ্যাকশন নিচ্ছে না ,তারা চায় মামলাটা ধামাচাপা দিতে, আমরা যেন মামলা তুলে নেই এই জন্যে একটু পর পর টাকা সাধে ,আমরা কোন টাকা নিব না । আমরা খুনিদের গ্রেফতার চাই। ভাই হত্যারবিচার চাই ।


এই ঘটনায় নাসিক ১৪ নম্বর ওয়ার্ড  সাবেক কাউন্সিলর সফিউদ্দিন বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার আছে। এই ছেলেটি মনিরের পক্ষে কাজ না করায় তাকে ঢেকে নিয়ে রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করা হলো যার নিন্দা প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। আমরা এই হত্যা সাথে যারা জরিত আছে তাদের গ্রেপ্তারে মাধ্যমে কঠোর শাস্তির দাবী জানাই।

 

আমি ইতিমধ্যে আমি পুলিশ প্রশাসনকে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবী জানাই।  প্রশাসন আমাদের আশ^স্ত করেছে এই হত্যার সাথে যত বড় লোকই থাকুক না তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। অভিযোগে দেখলাম ভূক্তভোগি পরিবার উল্লেখ্য করেছে কাউন্সিলর মনির মোবাইলে সায়েমকে বলে শুভ্রকে হত্যা করার জন্য বলে।


নারায়ণগঞ্জ সদর থানার তদন্ত ওসি মো. সাইদুজ্জামান জানান, আগেই মামলা হয়েছে। যেহেতু যুবকটি মারা গেছে তাই, সেই মামলার মধ্যে হত্যার ধারাটি যুক্ত করা হবে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অনেককেই চিহিৃত করতে পেরেছি, শীঘ্রই তাদের  গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।


এ বিষয়ে সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিচুর রহমান মোল্লা বলেন, তিনি শনিবার থানায় যোগদান করেছেন। বিষয়টি জানতে পেরে রাতেই অভিযোগ গ্রহণ করেছেন। তখন হত্যা চেষ্টার ধারা উল্লেখ করা হয়েছে।

 

সকালে ভুক্তভোগী মারা যাওয়ায় এই মামলায় হত্যার ধারা সংযোজনের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। ওসি আরও বলেন, এই ঘটনায় আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান শুরু হয়েছে। মানিক নামে এজাহারনামীয় এক আসামিকে সন্ধ্যায় গ্রেফতারও করা হয়েছে। অনেকে অনেকের সম্পৃক্ততার কথা বলতে পারে কিন্তু তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদেরই আমার গ্রেফতার করবো।

এই বিভাগের আরো খবর