শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

নৌকা যখন একমাত্র ভরসা

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ৮ আগস্ট ২০২০  

বিপদসীমা ছাড়িয়েছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি। ফলে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী বেষ্টিত সদর উপজেলার কাশিপুর, এনায়েতনগর, বক্তাবলী এবং আলীরটেক ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চল বানের পানিতে তলিয়ে গেছে।

পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব অঞ্চলের সহস্রাধিক পরিবার। এর মধ্যে বক্তাবলীর পূর্ব গোপালনগর ও প্রতাবনগর এলাকার বেশ কয়েকটি বসত ঘর নদীর স্রোতে ভেসে গেছে। নদীর পানি বাড়তে থাকায় নারায়ণগঞ্জ জুড়ে বন্যার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

এদিকে, বানের পানিতে বন্দি মানুষগুলোর স্বাভাবিক জীবন যাপন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। রাস্তা-ঘাটতো বটেই বসত ঘরেও ঢুকে পড়েছে পানি। এই দুঃসময়ে একমাত্র বাহন হয়ে উঠেছে নৌকা। ক’দিন আগেও যেসব সড়কে দাপিয়ে বেড়িয়েছে বিভিন্ন যান-বাহন, সেসব সড়কপথে এখন চোখে পড়ছে ডিঙ্গি নৌকার চলাচল! 

সূত্র জানায়, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ধলেশ্বরীর পানি বেড়ে তলিয়ে যায় বক্তাবলী ও আলীরটেক ইউনিয়নের কৃষি জমিগুলো। তবে, এবছর আষাঢ়ের শুরুতেই নদীর পানি বেড়ে অন্তত ২০দিন পূর্বে কৃষি জমিগুলো তলিয়ে গিয়েছিল।

আষাঢ় পেড়িয়ে শ্রাবণ আসতেই আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে দেশের নদ-নদী। এর ব্যতিক্রম হয়নি শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর ক্ষেত্রেও।

ভয়ংকর ভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠা বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে ঘনবসতি এলাকায়। ফলে এসব এলাকায় বানভাসি মানুষগুলো এখন নৌকায় চলাচল শুরু করেছে। তাদের চলাচলের শেষ ভরসা হয়ে উঠেছে নৌকা!

গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, ফতুল্লার পোষ্ট অফিস এলাকায় অবস্থিত কাঠের দোকানগুলোয় নৌকা তৈরীতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন মিস্ত্রীরা। প্রতিটি কাঠের দোকানীরাই নৌকা তৈরীর অর্ডার পেয়েছেন। ক্রেতারা অর্ডারি ডিঙ্গি নৌকা তৈরী করাচ্ছেন মিস্ত্রী দিয়ে। আবার কেউ কেউ তরিঘড়ি করে কিনে নিচ্ছেন রেডিমেট (তৈরী) নৌকা। 

সূত্র বলছে, বর্ষার শুরু থেকেই অতিবৃষ্টিতে ডিএনডি এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় এখান থেকে নৌকা ক্রয় করে চলাচল করছিলেন। সে হিসেবে গত প্রায় দু’মাস ধরে নৌকা তৈরীর ধুম চলছে এখানে। বেচা বিক্রিও হচ্ছে বেশ।

এবার বন্যা পরিস্থিতির কারণে নৌকা বিক্রির পালে যেন হাওয়া লেগেছে নতুন করে। বক্তাবলী, এনায়েতনগর ও আলীরটেকতো বটেই বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও এলাকা থেকেও অনেকেই ফতুল্লায় আসছেন নৌকা ক্রয়ের জন্য। 
 
দোকানী ও নৌকা তৈরীকারকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,  প্রতিটি তৈরীকৃত ডিঙ্গি নৌকা আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়।

আবার অনেক ক্রেতারা চাহিদা ও সাধ্যমত খরচ করেও বিভিন্ন দামে নৌকা তৈরী করিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়াও নৌকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ফার্নিচার তৈরীর মিস্ত্রীরাও এখন চুক্তিতে নৌকা তৈরীর কাজে নেমেছেন।

এবিষয়ে সরেজমিনে কথা হয় নৌকা তৈরীকারক দুলাল মন্ডলের সাথে। দৈনিক যুগের চিন্তা’কে তিনি বলেন, “আমি ফার্নিচার (কাঠের তৈরী আসবাবপত্র) মিস্ত্রী। এহন ফার্নিচারের কাম-কাইজ তেমন নাই।

কিন্তু কয়েকদিন ধইরা সব তলাইয়া যাওনে নৌকার চাহিদা বারছে। মানুষজন নৌকায় চলাচল শুরু করছে। তাই দুই মাস ধইরা কাঠের দোকানে আইসা নৌকার কাম করতাছি। সারাদিনের চুক্তিতে কাম করলে একদিনে ৬-৭ টা নৌকা বানাইতে পারুম।

গত দুই তিনদিনের মইধ্যে আমগো দোকান থিকা অন্তত ২০টার মত নৌকা বেচা হইছে। যারা নৌকা নিছে, তারা সবাই বক্তাবলী আর নদীর ওপারের মানুষ। সুনছি ওই এলাকা নাকি বন্যায় তলাইয়া গেছে।” 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, “গত দুই-এক মাস আগে বৃষ্টির কারণে ডিএনডি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় তখন ডিএনডির মানুষের মইধ্যে নৌকা কিনার ধুম পড়ছিলো। ফতুল্লার দেলপাড়া, ভূইগড়, পাগলা, আলীগঞ্জ, কুতুবপুর আর সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার মানুষ আমগো কাছ থিক্কা নৌকা নিছে। এহন বক্তাবলী আর নদীর ওই পাড়ের মানুষেরা নৌকা নিতাছে। আগামী এক মাস পর্যন্ত আমাগো নৌকা বিক্রি হইতে পারে।”

কথা হয় ফতুল্লার পোষ্ট অফিস এলাকার কাঠের দোকানী মোঃ শহিদ মিয়ার সাথে। দৈনিক যুগের চিন্তা’কে তিনি বলেন, ‘ফতুল্লা বাজার থেকে পোষ্ট অফিস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১২টি কাঠের টিম্বার বা দোকান রয়েছে।

আমার জানা মতে, বেশির ভাগ দোকানীরাই নৌকা তৈরীর অর্ডার পেয়েছে। রেডিমেট (তৈরীকৃত) নৌকাও বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। কাঠের দাম একটু বেশি, তাই নৌকার দামও কিছুটা বেড়েছে।

প্রতি নৌকা ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করে বিক্রি করতে হচ্ছে। আগে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে ডিঙ্গি নৌকা বিক্রি করা যেত। প্রতি নৌকায় মিস্ত্রীদের মজুরীই ৭শ’ টাকা দিতে হয়।’

তিনি বলেন, “অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার নৌকা বিক্রি শুরুতে কম থাকলেও গত কিছুদিন ধরে অর্ডার বেড়েছে। আমার দোকানে গত দুই দিনে ৭টি নৌকা বিক্রি হয়েছে। মানুষজন নৌকা নিতে আসছে।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে আগামীতে নৌকা  বিক্রি আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছর বিভিন্ন দোকানে অন্তত ৩০টির মতো নৌকা বিক্রি হয়। সে হিসেবে ফতুল্লার মোট ১২টি দোকানে নৌকা বিক্রি হতো প্রায় ৩৫০টির মত।” 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রতিবছর ডিএনডিবাসী এই মৌসুমে পানিবন্ধি থাকায় চলাচলের জন্য আমাদের কাছ থেকে নৌকা নিয়ে যায়। কিন্তু এবছর ডিএনডিবাসীতো বটেই পাশাপাশি বন্যার শিকার বিভিন্ন এলাকার মানুষেরাও নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন।”

শুক্রবার বিকেলে ফতুল্লায় রেডিমেট কিনতে আসেন মো. জসিম নামে এক যুবক। তিনি বক্তাবলীর পূর্ব গোপালনগর এলাকার বাসিন্দা। জানতে চাইলে দৈনিক যুগের চিন্তা’কে তিনি বলেন, নদীর পানি বেড়ে আমাদের এলাকা তলিয়ে গেছে।

রাস্তা-ঘাটসহ বসতঘর তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও কোমড় পর্যন্ত পানি উঠেছে। প্রত্যেকেই ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। পানি বাড়ছে। নৌকা ছাড়া চলাচল করার উপায় নেই। তাই চলাচলের জন্য নৌকা কিনতে আসলাম। 

এনায়েতনগর ইউনিয়নের ধর্মগঞ্জ গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা আলমাছ দৈনিক যুগের চিন্তা’কে জানান, “আমাদের এলাকায় কোমড় পর্যন্ত পানি। মাছের খামারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে সব মাছ বেড়িয়ে গেছে। অনেক লোকসানের মধ্যে পড়েছি।

পানি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কোমড় পর্যন্ত পানি পেরিয়ে চলতে হয়। এভাবেতো চলা যায় না। তাই উপায় না পেয়ে নৌকা নিতে আসেছি। আমাদের এলাকায় হাজারো পরিবার বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকেই এখন নৌকায় চলাচল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া উপায় নেই।”  

এদিকে বন্যার শিকার আর্থিক স্বচ্ছল ব্যক্তিরা চাইলেই চলাচলের জন্য নৌকা কিনে নিচ্ছেন। কিন্তু অস্বচ্ছল বা নিম্নবিত্তের মানুষগুলোর জন্য নৌকায় চলাচলও স্বপ্নের ! তাইতো বানভাসি হাজারো পরিবার বন্যার পানিকে সাথী করেই চলাচল করছেন জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়েই। 
 
জানতে চাইলে বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম শওকত আলী দৈনিক যুগের চিন্তা’কে বলেন- “আমার ইউনিয়নের প্রতাপনগর ও পূর্ব গোপালনগর এলাকা বন্যায় তলিয়ে গেছে। গত পরশু রাতে হঠাৎ করে পূর্ন শ্রোতে নদী থেকে পানি চলে আসে। ফলে বেশ কয়েকটি ঘর পানিতে ভেসে যায়। আর দুই থেকে আড়াইশ’র মত পরিবার বন্যার কবলে পরেছে।

ইউএনও ম্যাডামসহ আমরা বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। ক্ষতির মাত্রা অনেক। এই পানি সরতে অনেকদিন সময় লেগে যাবে। তাই বন্যা কবলিতদের জন্য সরকারী ভাবে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করেছি এবং তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু বন্যা কবলিতরা আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে অনিহা প্রকাশ করছেন। তারা আশপাশে তাদের আত্মিয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন।” 

তিনি আরো বলেন- বন্যা কবলিতরা দাবী করেছেন যে, “তাদের যেন ঘর-বাড়ি তৈরীর জন্য সরকারী ভাবে সহায়তা করা হয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয় অবগত আছেন। আশাকরি তাদের জন্য সরকারী ভাবে বরাদ্ধ দেয়া হবে।”

এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান দৈনিক যুগের চিন্তা’কে বলেন- “আমার ইউনিয়নের ৩, ৪ ও ৫নং ওয়ার্ডের আংশিক এলাকা বন্যায় তলিয়ে গেছে। আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ইউএনও ম্যাডাম সহ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (জেনারেল) স্যার এবং আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। তারা কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে রাজি হয়নি। তবে আমাদের ব্যবস্থা নেয়া আছে এবং বন্যা কবলিতদের জন্য দেড় মেট্রিকটন চাউল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। এগুলো ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিতরণ করা হবে।”

এছাড়াও এই দূর্যোগে অসহায়দের জন্য বৃত্তবানদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ারও আহবান জানান তিনি। 

এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েব সাইট বলছে, আগামী কয়েকদিনে নারায়ণগঞ্জে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।

এমন সম্ভাবনায় সচরাচর বৃষ্টির দেখা না মিললেও এগুলোর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকবে ৩৩ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। ফলে এই তীব্র তাপদাহে জলিয় বাষ্প সৃষ্টির মাধ্যমে আগামীতে নারায়ণগঞ্জে আবারও অতিবৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আর এমনটা হয়ে থাকলে নারায়ণগঞ্জ জুড়ে বন্যার আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আরো জোড়ালো হয়ে উঠবে। এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
 

এই বিভাগের আরো খবর