বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নৌকার গ্রাম গাবতলী

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২১ জুন ২০২১  

রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের গাবতলী গ্রাম। গ্রামটিতে পরিবারের সংখ্যা ৫৬টি। এর মধ্যে ১৬জন জেলে, ৪জন কামার, ৫জন শীল ও ১৮ জন নৌকার কারিগর বসবাস করছে। পাশাপশি মুসলিম পরিবারও বসবাস করছে। প্রতিটি নৌকার কারিগর তাদের বাপদাদার কাছ থেকে কাজের কৌশল রপ্ত করেছে। এত বিচিত্র পেশার মানুষের বসবাস হলেও নৌকা তৈরীর জন্য গ্রামটি নৌকার গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে। 

 


ভূলতা গাউছিয়া থেকে আড়াই কিলোমিটার দক্ষিন পূর্বদিকে ছোট্র এ গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ব্রম্মপুত্র নদী। গ্রামটির অধিকাংশই রূপগঞ্জ থানার অধীনে আর কতক অংশ পড়েছে সোঁনারগা থানায়। আর দশটা গ্রামের মতো এখানেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। এক সময় শিক্ষিত পরিবার তেমন ছিলনা এখন প্রতিটা পরিবার তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলে মেয়েরা বড়দের এ কাজে সাহায্য করছে। তবে নিচু এলাকা বলে বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত থাকে অনেক এলাকা। এজন্য এখানে বর্ষায় নৌকার চাহিদা বেশ। কিছু নিন্ম এলাকা আছে বর্ষার শুরুতেই নৌকার প্রয়োজন হয়। আর অধিকাংশ নৌকাই সরবরাহ করা হয় গাবতলী এলাকা থেকে। 

 


এলাকাবাসী জানান, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁ ও আশপাশে বড় কোন নদনদী না থাকলেও প্রচুর পুকুর বা জলাশয় রয়েছে। এসব পুকুরে মাছের খাবার দিতে, মাছ পরিবহনে, মাছ ধরতে ও বিভিন্ন খাল বিল জলাশয়ে চলাচলে নৌকার বিকল্প নেই। তাছাড়া নিন্মাঞ্চল হওয়াতে বর্ষার শুরুতেই এলাকা প্লাবিত হয়। আবাদী জমিতে পানি থৈথৈ করে। এসব এলাকায় রাস্তাঘাটের বিকল্প হিসেবে নৌকা ব্যবহার করে অনেকেই।

 


গাবতলীর লোকজন জানান, প্রতিবছর বর্ষা শুরু হলে এ গ্রামে শুরু হয় নৌকা তৈরীর উৎসব। এবারও তাই হয়েছে। বর্ষা শুরুর পর থেকেই প্রতিটি ভোরে হাতুরী পেটানোর ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভাঙ্গে এ গ্রামের মানুষের।  সূর্য উঠার আগেই কারিগরদের বাড়ির উঠোনে বা ঘরের বারান্দায় শুরু হয় নৌকা তৈরীর কাজ। ছোট বড় সবাই নৌকা তৈরীর কাজে ব্যস্ত সময় কাটায়। ৪ মাস নৌকার কারিগররা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে পরিবারের খোরাক জোগায়।

 

গ্রামের এক বৃদ্ধ বলেন, প্রায় ১’শ বছর আগে এ গ্রামে পঁচু চন্দ্র ও হরচন্দ্র নামের দুই ব্যক্তি বসবাস করত। মুলত তাদের হাত ধরেই এ গ্রামে নৌকা তৈরী শুরু হয়। ধীরে ধীরে গ্রামের অন্য পরিবার গুলো তার কাছ থেকে নৌকা তৈরীর কাজ রপ্ত করেন। এখন কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও নৌকা তৈরীর কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। বংশ পরম্পরায় প্রাচীন হিন্দু পরিবারগুলোর হাতেই এই শিল্প টিকে আছে। তিনি বলেন, নৌকা তৈরীর কাজে জড়িত ১২ টি পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে খুব সচ্ছল না হলেও গাবতলী গ্রামে তাদের আলাদা মর্যাদা আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ গ্রামের পুরুষরা নৌকা তৈরীর কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে নারী ও শিশুরা। শত বছর ধরে তারা নৌকা তৈরীর কাজ করছে বলে আমাদের এ গ্রামটি নৌকার গ্রাম হিসেবেই আশপাশের এলাকায় পরিচিত। 

 


নৌকার কারিগর হরিহর বিশ্বাস বলেন, আমরা আদি পুরুষের কাছ থেকে নৌকা তৈরীর কাজ শিখেছি। ইনকাম যাই হোক আমরা আনন্দের সহিত এ কাজ করি। বাপদাদার ঐতিয্য ধরে রাখতে গ্রামে এখন নতুন নতুন কারিগর তৈরী হচ্ছে। এখন বর্ষা মৌসুম। আমাদের বিশ্রাম নাই। নৌকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়।গাবতলী এলাকার রতন চন্দ্র বিশ্বাস (৫২) ঘরের বাড়ান্দায় নৌকা তৈরী করছেন। পাশেই তার পিতা প্রফুল্ল চন্দ্র বিশ্বাস (৭০) জল চৌকি তৈরী করছেন। রতন চন্দ্র বিশ্বাস জানান, আমার পিতা ৫৪ বছর যাবৎ নৌকার কাজ করছে। আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি। বাবা এখনও কাঠ দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র নিমিষেই তৈরী করতে পারে। তিনি বলেন,বর্ষার ৩/৪ মাস আমরা নৌকা তৈরীর কাজে ব্যস্ত থাকি।

 

বছরের বাকি মাস ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র, জল চৌকি, কাহাইল, সাহাইড, চৌকি, পড়ার টেবিল, কাঠের চেয়ার তৈরী করে সংসার চালাই। এ কাজ করে তেমন কোন আয় নেই তাই তার ছেলেদের অন্য পেশায় দিয়েছেন বলে জানান তিনি। মদন কুমার বলেন, আগে যে বর্ষা হতো তাতে চারিদিকে পানি থৈথৈ করত। প্রতিটি গ্রাম যেন পানিতে ভাসতো। ১০/১২ ফুট উচ্চতায় বর্ষার পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যেত। চলাচলের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা তাই সবাই নৌকা ব্যবহার করত। এখন বেরী বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে ফেলছে। এজন্য অনেক এলাকায় বর্ষা হয়না। আবার রাস্তা ঘাটের উন্নতি হওয়ায় নৌকার ব্যবহার কমে গেছে। সেই সাথে নৌকার কারিগরও কমছে। এখন খামারিরা নৌকা নেওয়াতে এ শিল্প টিকে আছে বলে জানান তিনি।

 


এখান থেকে রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ উপজেলার বিভিন্ন হাটে নৌকা বিক্রি হয়। তবে অনেক ক্রেতা এ গ্রামেই আসে নৌকা ক্রয় করতে। এখানে ছোট বড় সব ধরনের নৌকা তৈরী হয়। ছোট আকারের প্রতিটি নৌকা তৈরী করতে খরচ হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। বড় আকারের নৌকা ৪৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। লাভের টাকায় কারিগররা ৪ থেকে ৫ মাস চলতে পারে। বাকি সময় তারা কাঠের আসবাবপত্র তৈরী করে হাট বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার অনেকে অন্যের বাসাবাড়ীর আসবাব তৈরী করে সংসার চালান। এভাবেই তারা বছরের বাকি মাস চালিয়ে নেন। 
 

এই বিভাগের আরো খবর