বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

প্রতিরোধ যুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ

বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. মো. নুরুল হুদা

প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২১  

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ট লাভ হবার পরও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে। বাঙ্গালীদের চাপে পড়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেও ১৯৭১ ইং সনের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষন রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে  ৩রা মার্চ ডাকা জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষনার সাথে সাথেই বাঙ্গলীরা তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে মিটিং, মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। সহক্ষুদ্ধ শিল্পী সাহিত্যিক বাঙ্গালী জনগনকে কবিতা আবৃতি গান সংঙ্গীত নাট্যভিনায়ের মধ্যে উৎজ্জিবিত করার জন্য শিল্পি সাহিত্যিকরাও পিছিয়ে ছিলেন না।

 

নারায়ণগঞ্জেও তৎকালিন এম.এন.এ, এ,কে,এম শামসুজ্জোহা, এম.এল.এ আফজাল হোসেন, এম.এল.এ আব্দুস সাত্তার, বাদশা মিয়া, এম.এল.এ গোলাম মোর্শেদ ফারুকী, আলী আহাম্মদ চুনকা, আনছার আলী, এ.কে.এম বজলুর রহমান, সুলতান মাহমুদ মল্লিক লিলু মিয়া, খাঁজা মহিউদ্দিন, খোকা মহিউদ্দিন, এম.এল.এ সাজেদ আলী, মোক্তার প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা এবং ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, সেক্রেটারী আব্দুস সাত্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, দপ্তর সম্পাদক খোরশেদ আলম দুদু, ছাত্রনেতা মনিরুল ইসলাম, নাজিম উদ্দিন মাহমুদ, তোফাজ্জল হোসেন, মোবারক হোসেন, এম.এ আউয়াল (সাবেক ভিপি, তোলারাম কলেজ) হাবিব খান (সাবেক জি.এস. তোলারাম কলেজ) ফয়েজুর রহমান (ভিপি, তোলারাম কলেজ) মো. শাহজাহান (জি.এস তোলারাম কলেজ) শহর ছাত্রলীগের সভাপতি, আব্দুল মোতালিব সাধারন সম্পাদক, মোহর আলী চৌধুরী, তমিজ উদ্দিন রিজভী, মো. ওবায়েদ উল্লাহ, শাহ আল চৌধুরী, আব্দুর রহমান, খবির আহমেদ, শরীফুল আশরাফ, মো. আসাদুজ্জামান আসাদ প্রমুখের নেতৃত্বে প্রায় প্রতিদিন মিটিং মিছিল, মশাল মিছিল হতে থাকে। রহমত উল্লা মুসলিম ইনষ্টিটিউট পৌর পাঠাগার (পাবলিক লাইব্রেরী) তে প্রায় প্রতিদিন বিদ্রোহীমূলক কবিতা, দেশাত্মবোধক গান, গান সঙ্গীত, উজ্জিবিতমূলক নাটক অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এতে অনেকের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন সর্বজনাব নাট্যে শান্তি রঞ্জন মুর্খাজী, কালিপদ সেন, উৎপল বড়ুয়া, তুলিপ, কুতুব উদ্দিন আহামদ, আমজাদ হোসেন, বাহাউদ্দিন ভুলু, সংগীত ও গণসংগীতে সোহরাব হোসেন, আনছার, সেলিম আহমেদ, লুৎফর রহমান, সাইয়েদুর রহমান।



৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবঙ্গুর আহবানে সভাতে যোগদানের জন্য বিশাল প্রস্তুতি চলতে থাকে এবং ৭ই মার্চ সকাল থেকেই শতাধিক বাস ট্রাক যোগে, নারায়ণগঞ্জ এবং সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজি থেকে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ বাঁশের লাঠি, লগি, বৈঠা নিয়ে সভায় যোগদান করেন। সভা থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষনে স্বাধীনতার মন্ত্র “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম” নির্দেশনা নিয়ে ফিরে আসে।

 


উল্লিখিত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ২নং রেলগেইটস্থ রহমত উল্লা মুসলিম ইন্সটিটে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেন। এই কন্ট্রোল রুম থেকেই নেতৃবৃন্দের নির্দেশে প্রায় প্রতিদিন মিটিং, মিছিল, মশাল মিছিল, গনসঙ্গীত, বিদ্রোহী মূলক কবিতা আবৃত্তি, নাট্যাভিনয় চলতে থাকে। ১৬ ই মার্চ থেকে বঙ্গবঙ্গুর সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, তৎপর জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আলোচনার সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ প্রায় প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ীতে যেতেন। নেতৃবৃন্দ ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু বলেন “জোহা ওদের সকলকে নিয়ে চলে যা, গিয়ে এখনই রাস্তায় ব্যারিকেট সৃষ্টি কর। ওরা হয়ত আজ রাতেই হামলা চালাবে।

 


নেতৃবৃন্দ রাত সাড়ে ১১টা থেকে রাত ১২ ঘটিকার দিকে নারায়ণগঞ্জে চলে আসার পথে উৎসুখ জনতা সর্বশেষ অবস্থা জানতে চায়। রাত ২টার দিকে নেতৃবৃন্দের নির্দেশে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের, পাগলায়, ফতুল্লা, পঞ্চবটিতে মাসদাইর কবরস্থানের সম্মুখে ফতুল্লা আওয়ামী ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ডা. লেহাজ উদ্দিন, ইদ্দিস মেম্বার, আ. রশিদ, মোহাম্মদ আলী, মমিন হাজী, আ. লতিফ, ফজলুল হক, আয়াত আলী, আ. গনি, রতন সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে ব্যারিকেট দিতে থাকে। তখন ঢাকার দিক থেকে মুহু মুহু গোলার আওয়াজ আসতে থাকে এবং অগ্নি স্ফুলিংক জলতে থাকে। পাক আর্মি ই.পি.আর, রাজারবাগ পুলিশ, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। খবর আসে ই.পি.আর, পুলিশ বাহিনী প্রবল ভাবে মরনপন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।

 


২৬শে মার্চ সকালে এম.এল.এ আফজাল হোসেন, এম.এল.এ গোলাম মোর্শেদ ফারুক, আলী আহাম্মদ চুনকা, খোকা মহিউদ্দিন, খাজা মহিউদ্দিন, সুলতান মাহমুদ মল্লিক লিলু মিয়া, এ.কে.এম বজলুর রহমান, আনছার আলী প্রমুখ এবং ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ দপ্তর সম্পাদক খোরশেদ আলম দুদু, এম.এ আউয়াল, মরন সাত্তার, ফয়েজুর রহমান, মো. শাহজাহান, শাহ আলম চৌধুরী, আবদুর রহমান, আ. রব, আব্দুর রাশেদ রাশু, আ. কাদির দেওয়ান, নরিংগা সালাউদ্দিন, মো. ওবায়েদ উল্লাহ ও নূরুল হুদা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ রহমত উল্লাহ, মুসলিম ইনষ্টিটিউট কন্ট্রোল রুমে জড়ো হয়। তাদের নির্দেশনায় এস.ডি.ও কোর্টের মালখানায় রক্ষিত রাইফেল, বন্ধুক, গোলাবারুদ, এস.ডি.ও কোর্টের কর্মচারী নুরু মিয়া চৌধুরী বাচ্চুর সহায়তায় খাজা মহিউদ্দিন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার, সাহাবউদ্দিন আহমদ, খোরশেদ আলম দুদু, আ. মোতালিব, মোহর আলী চৌধুরী, এম.এ আউয়াল, ফয়েজুর রহমান, আব্দুর রাশেদ রাশু, তমিজ উদ্দিন রিজভী, শাহ আলম চৌধুরী, আজমল হোসেন, মনিরুল ইসলাম, মরন সাত্তার, শরীফুল আশরাফ, মো. আসাদুজ্জামান, আমি নুরুল হুদা প্রমুখ কোর্টের অস্ত্রাগার ভেঙ্গে এনে কন্ট্রোল রুমে জমা দেই।

 

নারায়ণগঞ্জ থানা, কুমুদীনি ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্ট, র‌্যালি ব্রাদার্স, সোনাকান্দা ডকইয়াড থেকে ডকইয়ার্ডের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সহায়তায় বেশ কিছু রাইফেল, বন্ধুক, গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রহমত উল্লা কন্ট্রোল রুমে জমা দেন। নেতৃবৃন্দ কিছু রাইফেল ও বন্দুক দিয়ে নাগমহাশয়ের মাঠে ট্রেনিং এর জন্য পাঠান এবং বাকী অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরিয়ে দেওভোগ সমাজ উন্নয়ন সংসদে পরে সংলগ্ন মফিজুল ইসলাম সাহেবের দোতলা বাড়ীতে রাখেন। এই অস্ত্র দিয়েই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা হয়। প্রতিরোধের জন্য ২৬ শে মার্চ বিকাল থেকেই আওয়ামীলীগ ও ছাত্র লীগের নেতৃত্বে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে অবস্থান নেই।

 


মাসদাইর ও কবরস্থান এলাকায় সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে সফি উদ্দিন সারোয়ার বাবু, মোহাম্মদ আলা, মমিন হাজী, খোরশেদ আলম দুদু, জয়নাল আবেদীন টুলু, আব্দুস সাত্তার মরন, মীর শাহজাহান, মনসুর আহাম্মদ, মোঃ শামসুদ্দিন, আমজাদ হোসেন পুতুল, মোঃ আসাদুজ্জামান, আমি সহ প্রমুখ অসংখ্য নেতাকর্মী।

 


মাসদাইর জামতলা রাস্তার পশ্চিম দক্ষিন পাশে আব্দুস সাত্তার, মো. জানে আলম, শরীফুল আশরাফ, সাহাবউদ্দিন আহাম্মদ, সহিজান, আব্দুল মজিদ, মোহর আলী চৌধুরী, আঃ কাদির দেওয়ান, নরিংগা সালাউদ্দিন, আঃ রব, আনোয়ার হোসেন খান, আব্দুল আউয়াল মিলন (মুক্তিযোদ্ধা শহীদ) সমিউল্লাহ মিলন, রতন, মুন্সিগঞ্জের ছাত্রনেতা আনিস বাবুল প্রমুখসহ অসংখ্য বাঙ্গালী মিলিটারী, পুলিশ, আনছার, জনতা।

 


তোলারাম কলেজের সাথে কুন্ড বাড়ী এলাকায় ফয়েজুর রহমান, মোঃ শাহজাহান, এম.এ আউয়াল, মনিরুল ইসলাম, মোঃ ওবায়েদ উল্লা, আব্দুল মোতালিব, শরফুদ্দিন রবি, খবির উদ্দিন আহাম্মদ, আব্দুর রাশেদ, সামসুল ইসলাম ভূইয়া, তমিজ উদ্দিন রিজভী, এনায়েত উল্লা, আব্দুল গফুর, নূরুউদ্দিন আহম্মদ, ননি সারোয়ার, শহিদ বাঙালী, আমিনুল ইসলাম, মুসলে উদ্দিন প্রমুখ এর নেতৃত্বে অবসর ও ছুটিতে থাকা বাঙালী সেনা, ইপি.আর পুলিশ এবং আনছার সহ অসংখ্য ছাত্র জনতা মরনপন প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে।

 


২৭শে মার্চ পাক বাহিনী ঢাকা থেকে পোস্তগোলা হয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে রওনা দেন। রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেট সরিয়ে আসাতে পথে বৃষ্টির মত মেশিন গানের গুলি ও ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। ছাত্র জনতার প্রতিরোধে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত তাদের রাইফেল, বন্ধুক, তীর, ধনুক, বল্লম দিয়ে সাহসি ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধ করে আটকিয়ে রাখেন।

 


পাক বাহিনী জামতলায় সাবেক মন্ত্রী আব্দুস সাত্তারের ছেলে তৌফিক সাত্তার, ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার, হক সাহেব, তার স্ত্রী সহ ২৫ জন কে হত্যা করে, এ সময় ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক খোরশেদ আলম দুদু সহ বেশ কয়েকজন আহত হয়।

 


ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্র, জনতার প্রতিরোধের সময় শহরের লোকজন শীতলক্ষ্যা এবং বুড়িগঙ্গা পাড় হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে সক্ষম হয়।
২৮ শে মার্চ রবিবার সকালে পাক সেনারা সাজোয়া যান ও ট্যাংক নিয়ে অনবরত গুলিবর্ষন করতে করতে নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কন্ট্রোল রুম রহমত উল্লাহ মুসলিম ইনষ্ট্রিটিউট, ন্যাশনাল ক্লাব, দেওভোগ সমাজ উন্নয়ন সংসদ, মফিজুল ইসলাম সাহেবের বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। দুপুর ১২ টার দিকে আমিনা মঞ্জিলের মালিক আমিনা বেগম ছাদে উঠে পতাকা উত্তোলন কালে পৌরসভার সম্মুখ থেকে গুলি করে হত্যা করে।

 


২৯শে মার্চ টান বাজার অগ্নি সংযোগ করে ছাত্রলীগ নেতা মোশারফ হোসেন মাশার ও চিত্তকে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। পাক বাহিনী নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল সংলগ্ন টিএন্ডটি অফিসে তাহাদের দপ্তর স্থাপন করে। এই দপ্তরে অনেককে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করে। ২নং বাবুরাইল গান পাউডার দিয়ে সম্পূর্ণ বাড়ীঘর ভস্মিভূত করে।

 


নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষ ২৬ মার্চ থেকে ভয়ে বাড়ীঘর সব ফেলে প্রাণ ভয়ে শীতলক্ষা, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীপাড়ি দিয়ে বন্দর, মদনগঞ্জ, কলাগাছিয়া, ডিগ্রিরচর, বক্তাবলী, আলীরটেক, কাশিপুর, গোগনগর, মুন্সিগঞ্জ, কমলাঘাট, মিরকাদীম, বিক্রমপুরের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে।

 


(এডভোকেট মোঃ নুরুল হুদা)
বীর মুক্তিযোদ্ধা
ডেপুটি কমান্ডার না.গঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
নারায়ণগঞ্জ।