মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ৫ ১৪৩০

বন্দরে সরকারি খালে ভাইস চেয়ারম্যানের অবৈধ কালভার্ট

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২২ জুন ২০২১  

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় সরকারি একটি খালের স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে নিয়মবহির্ভূতভাবে কালভার্ট নির্মাণ করেছেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা সানাউল্লাহ সানু। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। খালের ওপারে কোনো লোকালয় না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ কালভার্টটি নির্মাণ করেছেন। নিজ খরচে এই কালভার্ট নির্মাণ করলেও সরকারিভাবে সেই টাকা বরাদ্দ নেওয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন তিনি।

 

সরেজমিনে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নরপদী গ্রামের জেলে পাড়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেঁষে খালটির অবস্থান। স্থানীয়রা এটি জাউল্লাপাড়া খাল বলেও পরিচিত। খালটি ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে কলাগাছিয়া বাজার পর্যন্ত গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে মিলিত হয়। বর্ষাকালে এই খাল দিয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ ট্রলারে নির্মাণসামগ্রী (ইট, বালু, সিমেন্ট) আনা-নেওয়া করেন। স্থানীয় জেলেরা নৌকা বেয়ে কলাগাছিয়া বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করেন।

 

তবে কালভার্ট নির্মাণ করায় জলপথের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সড়কপথই এখন একমাত্র ভরসা। স্থানীয়দের মধ্যে অন্তত দশজনের সাথে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তাদের ভাষ্য, খালের ওপারে কোনো লোকালয় নেই। তাছাড়া অদূরেই একটি সেতু রয়েছে। এই কালভার্ট গ্রামবাসীর কোনো উপকারে আসছে না। বছরখানেক পূর্বে খালের ওপারে ৩০ শতাংশেরও বেশি জমি বালু দিয়ে ভরাট করেছেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ সানু। ব্রহ্মপুত্র নদ ঘেঁষা ওই জমি তিনি কিনেছেন বলেই জানেন এলাকাবাসী। তিনি সেখানে ডকইয়ার্ড নির্মাণ করবেন। বিষয়টি ভাইস চেয়ারম্যান নিজেই নিশ্চিত করেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে এই কালভার্টটি নির্মাণ করছেন তিনি।

 

কথা হয় স্থানীয় জেলে পরিমল রাজবংশী ও মাহবুব হোসেনের সাথে। তারা বলেন, এই খাল দিয়ে নৌকায় কলাগাছিয়া বাজারে যেতেন তারা। কেনাকাটা শেষে আবার নৌকাতেই ফিরতেন। কালভার্ট করার পর থেকে নৌ পথটি বন্ধ হয়ে গেছে। নরপদী গ্রামের বাসিন্দা মাছ ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এই কালভার্টের কোনো প্রয়োজনই এলাকাবাসীর ছিল না। উল্টো এই খাল দিয়ে বর্ষাকালে অসংখ্য ট্রলার-নৌকা চলাচল করতো। কালভার্ট নির্মাণ করেছেন ভাইস চেয়ারম্যান, তাই এলাকাবাসী কেউ কথা বলার সাহস পাননি।’

 

জানতে চাইলে অভিযুক্ত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও মহানগর জাতীয় পার্টির আহবায়ক সানাউল্লাহ সানু বলেন, খালের ওইপারের জমিতে ডকইয়ার্ড নির্মাণ করবেন তিনি। সেজন্যই কালভার্ট নির্মাণ করেছেন। তবে এলাকাবাসীর এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না দাবি তার। তবে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গত ৩১ মে উপজেলা প্রশাসনের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা প্রেস নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘এলাকাবাসীর দাবি, ওই কালভার্টের কোনো প্রয়োজন সেখানে ছিল না। একজন জনপ্রতিনিধি এইভাবে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে খালের উপর কালভার্ট নির্মাণ করতে পারেন না।’

 


বন্দর উপজেলা পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রামবাসীর জন্য অপ্রয়োজনীয় কালভার্টটি নির্মাণ করতে সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। ৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি কালভার্ট নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ সানু। উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ রশীদ তাতে সুপারিশও করেন। তবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এই কাজের অনুমতিপত্র (ওয়ার্ক অর্ডার) এখনও দেয়নি। অনুমতিপত্র না দিলেও কালভার্ট নির্মাণ হয়ে গেছে আরও দুই মাস আগেই।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডি’র বন্দর উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী ইফতেখারুল ইসলাম পাটোয়ারি বলেন, ওইখানে একটা কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প তাদের রয়েছে। সরকারিভাবে উপজেলা চেয়ারম্যানের (এম এ রশীদ) নিজের একটা বরাদ্দ থাকে। সেই খাত থেকে এই বরাদ্দ দিয়েছেন তিনি। তবে এই প্রকল্পের ওয়ার্ক অর্ডানা হলেও ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ সানু নিজের টাকায় এটি নির্মাণ করে ফেলেছেন আগেই। ওয়ার্ক অর্ডার হওয়ার আগে সরকারি বরাদ্দের কাজ কেউ নিজের থেকে করতে পারেন কিনা, জানতে চাইলে ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে বিস্তারিত চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরাই বলতে পারবেন। কেননা এই স্কিম উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের। এইটা তো আমরা বাতিল করতে পারবো না। আমাদের কাজ ছিল কেবল টেন্ডারের মাধ্যমে কালভার্ট নির্মাণ করে দেওয়া।’

 

সরকারি বরাদ্দের কাজ তিনি কীভাবে শেষ করলেন, এই বিষয়ে জানতে চাইলে ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ সানু কথা বলতে রাজি হননি। তবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ রশীদ প্রেস নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার ইস্টিমেট দিবেন, সে অনুযায়ী ওয়ার্ক অর্ডার হবে, তারপর কাজ হবে। ওয়ার্ক অর্ডার না হলে এই কালভার্ট নির্মাণ করা যাবে না। ভাইস চেয়ারম্যান তো এইটা করতে পারেন না। আর এটি আমার স্কিমে হয়েছে কিনা তা এই মুহুর্তে বলতে পারছি না। আমি এ বিষয়ে খোঁজ নেবো।’

 

জানতে চাইলে বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুক্লা সরকার বলেন, ‘যেই প্রকল্পের আওতায় উনি (ভাইস চেয়ারম্যান) এই কালভার্ট নির্মাণ করেছেন, সেই প্রকল্পটি আমরা দেইনি। আমরা ওই প্রকল্পের টাকা আটকে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে উনি সেই কালভার্ট নির্মাণ করেছেন। সরকারি খালে ব্যক্তিগতভাবে কালভার্ট নির্মাণ করা যায় না। ওনার সাথে আমাদের কথা হয়েছে, উনি কালভার্টটি ভেঙে দিবেন।’

এই বিভাগের আরো খবর