শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বন্যা আতঙ্কে বক্তাবলীর কৃষকেরা

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ১৩ জুন ২০২১  

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষিরাজ্য বলা হয় বক্তাবলী ইউনিয়নকে। ধলেশ্বরী নদী বেষ্টিত কৃষিপ্রধান ওই অঞ্চলের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। উর্বর ভূমি এবং মিঠা পানির বদান্যতায় ফসলের ভালো ফলন হলেও বর্ষা মৌসুমে চরম শঙ্কায় কাটে তাদের প্রতিটি মুহুর্ত। কেননা বছরের এই সময়টিতে নদীর বানের জলে তলিয়ে যায় তাদের ফসলি মাঠ।

 

গত বছরও ঘটেছিলো সেই একই ঘটনা। শত শত বিঘা জমির আবাদি ফসল পানিতে তলিয়ে অপূরনীয় ক্ষতির মুখে পড়েছিলো বক্তাবলীর কৃষকরা। তাই বর্ষা মৌসুম যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই আঁতকে উঠছেন তারা। গতকাল বক্তাবলী এলাকা ঘুড়ে দেখা যায়, ইউনিয়নটির কানাইনগর ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার সীমানা নির্ধারণ করেছে ধলেশ্বরীর একটি শাখা নদী। নদীর এপাড়ে বক্তাবলীর কানাইনগর ঘাট আর ওপারে মুন্সিগঞ্জ জেলা অবস্থিত। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর প্রভাব এবং গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে ধলেশ্বরীর ওই শাখা নদীটির পানি ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

 

স্থানীয়রা বলছেন, গেল কয়েক দিনে অন্তত ৬ ফুটেরও বেশি উচ্চতা বেড়েছে নদীর পানি। ফসলি জমি থেকে আর মাত্র ৫ ফুট নিচে অবস্থান করছে ধলেশ্বরীর ওই শাখা নদীর পানি। স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর আষাঢ়ে নদীর পানিতে ফসলি মাঠ তলিয়ে যায়। এবারও সেই সম্ভাবনাই বিদ্যমান। কেননা ইতিমধ্যেই ফুলে ফেঁপে উঠছে নদী আর অভ্যান্তরিন খালগুলোতেও আসতে শুরু করেছে উজানের পানি। সাম্প্রতিক সময়ে যারা নতুন করে ফসল আবাদ করেছিলেন তারা এখনও নতুন ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। বানের পানির একবার কৃষি জমিতে উঠলে তা নিষ্কাশন হতে সময় লাগবে অন্তত তিন মাস।

 

জানা গেছে, কৃষকদের অনেকেই ব্যাংক বা বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন উত্তোলন করে জমি বর্গা এবং আবাদ করেছেন। অর্ধ লাখ থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকাও ঋণ করেছিলেন কৃষকরা। আবার কেউ কেউ বিগত দিনে অন্যান্য ফসলাদি উৎপাদন করে যা লাভ করে ছিলেন, তা থেকে এই মৌসুমে চাষাবাদে ব্যায় করেছেন। কিন্তু বানের জলে আবারও ফসল তলিয়ে গেলে ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে বাড়বেই। কানাইনগর এলাকার কৃষক আব্দুস সাত্তার দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে ধলেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে আমাদের ফসলি জমি তলিয়ে যায়। গতবারও তলিয়ে ছিলো। সেবার অপূরনীয় ক্ষতি হলেও সরকারী কোন সহায়তা পাইনি।’

 

তিনি বলেন, ‘কানাইনগর এলাকায় আমি আড়াইশত শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে পাট ও বোরো ধান সহ অন্যান্য সবজি চাষ করেছি। প্রতি ৩০ শতাংশ জমির বাৎসরিক বর্গা ২০ হাজার টাকা। আড়াইশ শতাংশ জমির বাৎসরিক বর্গা ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। চাষাবাদের অন্যান্য খরচ মিলিয়ে আরো লক্ষ্যাধিক টাকা ব্যায় হয়েছে। পুরো টাকাই ঋণ করে জোগাড় করেছি। রবি মৌসুমে কিছু ফসল ঘরে তুললেও এখনো ঋণ পরিশোধ হয়নি। এই অবস্থায় যদি আষাঢ় মাসে ফসলি জমি তলিয়ে যায়, তাহলে আমার অপূরনীয় ক্ষতি হবে। আমার মত অন্যান্যদের একই অবস্থা। জমির পাশে মাটির বাধ দিয়ে রেখেছি। কিন্তু বানের পানি আসলে এই বাঁধও কাজে দেবে না। এখন আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি।

 

কারণ আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হলে সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রণোদনা পাই না।’ আব্দুস সাত্তারের পাশের জমি বর্গা নিয়ে সেখানে সবজির আবাদ করেছেন কৃষক জকির হোসেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গতবার বন্যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক হিসেবে আমাদের তালিকা নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমরা কোন সহায়তা পাইনি। শুনেছি কেউ কেউ সরকারের সহায়তা হিসেবে সামান্য বীজ পেয়েছেন, কিন্তু আমাদের এতোটাই দূর্ভাগ্য যে, তালিকাভুক্ত কৃষক হওয়ার পরও আমাদের কপালে সরকারের সেই সামান্য সহযোগিতাও জুটেনি।’ কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে কৃষকদের তালিকা হয় এবং সেই তালিকা ধরেই কৃষকদের সরকারী সহায়তা প্রদান করা হয়। তাই কোন কৃষক যদি তালিকা থেকে বাদ পরে থাকলে এর জন্য স্থানীয় ইউপি সদস্যদের দ্বায় আছে বলে জানান তারা।

 

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার মোট ৩ হাজার ৭শত ৫৮ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে বক্তাবলী ও আলীরটেক ইউনিয়নেই অন্তত ২ হাজার হেক্টরের বেশি পরিমান কৃষি জমি রয়েছে। এর মধ্যে চাষাবাদে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বক্তাবলী ইউনিয়নটি।  তবে, এই ইউনিয়নের প্রকৃত কৃষকরা সরকারের ওই ক্ষুদ্র সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত হয়ে আসছে।   অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ইউপি সদস্য ও মাদবরদের দ্বারা কৃষকদের তালিকা তৈরী করায় তাদের গ্রæপিং বা ‘মুখ চেনা নীতির’ কারণে বাদ পড়ছেন প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে অনেকেই। আর তালিকায় অন্তর্র্ভূক্ত হয়েছেন প্রণোদনা গ্রহণ করা প্রয়োজন নেই এমন ব্যক্তিরা। বীজ ব্যবসায়ীকেও দেয়া হয় সরকারী প্রণোদনার বীজ! তা নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে প্রকৃত কৃষকদের। এমনসব আক্ষেপ ও দুশ্চিন্তায় নির্ঘূম রাত কাটানো মানুষদের পরিশ্রমেই জমে উঠে শহুরে বাজার আর দিন শেষে বঞ্চিত মানুষগুলোর মাঝে থেকে যায় হাহাকার।  

 

বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম শওকত আলী দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে আমাদের ইউনিয়নের ফসলি জমি তলিয়ে যায়, তবে এবার এখনো ফসলি জমিতে পানি উঠেনি। আমি সরেজমিনে খোঁজ খবর নিয়েছি। মূলত পানিটা আসে নদী থেকে। নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে তা বন্যার মত ফসলি জমিতে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে নদীর পানি আটকানোর মত কোন উপায়ও নেই। তবে, কোন কৃষক যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে তাদের সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করবো।’  
 

এই বিভাগের আরো খবর