শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বাংলা বাঙালির আত্মার আত্মীয় রবীন্দ্রনাথ

রনজিৎ মোদক 

প্রকাশিত: ৫ আগস্ট ২০২০  

জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ/ধন্য হল, ধন্য হল মানব জীবন। জগতের আনন্দ যজ্ঞে যে মহান পুরুষটি পৃথিবীতে পদার্পণ করলেন, বৈশাখী মেঘের শঙ্খ বাজিয়ে তিনি হলেন বাঙলার এক প্রকৃতির সন্তান কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

চৈত্রের খরতাপ দগ্ধ ধরণী যেমন বৈশাখী মেঘকে আহবান করে ঠিক তেমনি এ বাঙলা মায়ের যেন শান্ত সৌম্য সন্তানের প্রতীক্ষায় যেমন দিন গুনতে ছিলেন, ঠিক তাঁর বিগত দিনেও অশ্রু ঝরিয়েছেন বাঙালি।

আজ সেই ২২ শ্রাবণ। এই দিনেই বাংলা-বাঙালির পরম আত্মীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধরণীর সবুজ বাংলার শ্যামল প্রান্ত থেকে বিদায় নিয়েছেন। কবি শ্রেষ্ঠ বর্তমান বিশ্বের এক বিরাট বিস্ময়। বিরল প্রতিভার অধিকারী। কেবল কবি শ্রেষ্ঠ হিসেবেই নয়। সর্ব শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ রূপেও তিনি সারাবিশ্বে সম্মানিত।

মানব জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নাই, এমন কোন চিন্তা নেই, এমন কোন ভাব নেই, যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার এমনকি মিলন-বিরহের জলে সিক্ত করে। তার কবিতায় গানে, প্রবন্ধ-গল্পে, উপন্যাসে মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথ। এই মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। সেই দিনের সেই স্মৃতিকে নারায়ণগঞ্জবাসী আজও স্মরণ করে।

ব্যাথা-বেদনা ও হতাশাময় এ পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথই আমাদের একমাত্র ভরসা। আমরা রবীন্দ্রনাথের ভাব তরঙ্গে অবগাহন করি, তার চিন্তা চেতনায় চিন্তা করি, তার সুরে গান গাই, তার ভাষায় কথা বলি। সাগরের তল রয়েছে কিন্তু রবীন্দ্র সাগরের তল নেই। অথৈ সে সাগর এ সাগর মন্থন রবীন্দ্র প্রেমিকরাই করে আসছেন।

কিন্তু অনন্ত সাহিত্য সমুদ্রের তল খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে রবীন্দ্র সাগরে অবগাহন করে নিজেদেরকে খুঁজে নিতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আজ কোন কিছুই ভাবা যাচ্ছে না। বাংলা এবং বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথ একহাজার বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বিশ্বের কাছে বাংলা ভাষাকে মহিমান্বিত করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ।

কলকাতার জোড়া সাঁকো ঠাকুর পরিবার, উনিশ শতকের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। কাব্য-কবিতা ও শিল্প সংস্কৃতি চর্চা হতে শুরু করে জাতীয় জাগ্রতির উদ্বোধন পর্যন্ত এ পরিবারের অবদানের কথা সমগ্র জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আসছে।

ঠাকুর পরিবারের উন্নত শিক্ষাদীক্ষা মার্জিত সাংস্কৃতিক চেতনা এবং পিতার আলোকিত ধর্ম বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিস্ময়কর রূপে মুগ্ধ হয়ে উঠেছিল। প্রেম, প্রকৃতি, সৌন্দর্য ও স্বদেশ রবীন্দ্র কাব্যের এই চার দিগন্ত পড়েছিল তার জ্যোতির্ময় প্রভাব শৈশবে কিছুকাল ওরিয়েনটাল সেমিনারীতে ও কিছুকাল নর্মাল স্কুলে পড়েছিলেন।

স্কুল-কলেজের কুন্ঠিত বিদ্যা তার জুটল না সত্য, কিন্তু বিশ্ববিদ্যার সকল দোর তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। তের বছর বয়সে রচিত তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘তত্ত্বাবোধনী’ পত্রিকায়। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতা সারদা সুন্দরী দেবী। ৮ ভাই ৫ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।

তার ৫ সন্তান-মাধবীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেনুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ। কবির জীবদ্দশাতেই বড় মেয়ে মাধবীলতা, মেজ মেয়ে রেনুকা ও ছোট ছেলে শমীন্দ্র মারা যায়। বিয়োগ বেদনা কবিকেও স্পর্শ করেছে। কবি রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন। তিনি নিজকে তাই মানুষের মাঝে মানুষের সেবায় নিবেদন করেছেন।

আহমাদ রফিক ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বলেছেন, বিশ্ব সাহিত্যে এমন দ্বিতীয় প্রতিভার সন্ধান মিলবে না যা সাহিত্য সংস্কৃতিক প্রতিটি শাখা সফলভাবে স্পর্শ করে গেছে। এমনকি চিত্র শিল্প ও বাদ পড়েনি। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়! এদিকে হোসেনুর রহমান তার ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং ইতিহাস, প্রবন্ধে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে যা সত্য, যা সুন্দর, যা শাশ্বত, যা প্রেম, তাই চেয়েছেন।

১৯৩৭ সালে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ম্যান’ শীর্ষক একটি বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ডড়ৎষফ গধহ, ঝঁঢ়বৎ গধহ, ওহভরহরঃব গধহ, ঊঃবৎহধষ গধহ ধহফ টহরাবৎংধষ গধহ. মানুষকে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুদ্র পরিচয়ে দেশকালের মধ্যে ধরে রাখতে চাননি। মানুষকে তাঁর ইচ্ছা দেবতা এইটিই ঘোষনা করেছেন। আবদুল গাফফার তার ‘রবীন্দ্রনাথের অন্যভূবন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে একজন দক্ষ রাধুনী বলে উল্লেখ করেছেন।

দক্ষ পাচকের মতো ঠিকঠাক মসলা দিয়ে এবং সঠিক তাপমাত্রা প্রয়োগ করে কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ- নিজের সৃজনশীল রচনাকে যিনি নিয়ে গেছেন মুখরোচক কিন্তু মনোত্তীর্ন রসনার পর্যায়ে, তাকে রাধুনী না বলে উপায় আছে! ড. করুণাময় গোস্বামী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে একই সাগরের দুটি রূপ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বায়ান্ন বছর বয়সে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের আগে কবির ভাগ্যে তাঁর স্বদেশবাসীর লান্দীর বদলে নিন্দাই জুটেছে বেশি।যথীন্দ্র সরকার তার ‘রবীন্দ্র কথা সাহিত্যের প্রথম সমালোচক সুখরন্ধন’ প্রবন্ধে এ কথা উল্লেখ করেন এ কথার যতেষ্ট প্রমান রয়েছে।

নোবেল পুরস্কার লাভের পর কলিকাতায় কবিকে বিরাটভাবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেখানে কবি বলেছিলেন, আপনাদের এ সংবর্ধনা আমার ঔঠ্য পর্যন্ত পৌছায় নি কারণ আমি ‘গীতাঞ্জলি’ বাংলাদেশে বসেই বাংলায় লিখেছিলাম। যা হোক সবাই সে সূর্যকে সূর্যের আলোকে ভালবাসবে তা নয়। পেঁচা কখনোই সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে পাকিস্তান আমলে এ দেশেরই এক শ্রেনীর মানুষ রবীন্দ্র সঙ্গীতকে জাতীয় সম্প্রচার থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলো কিন্তু সূর্যকে তো তার কুলো দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। রবীন্দ্র প্রেমিক সূর্য সন্তানদের আন্দোলনের তোপের মুখে বাধ্য হয়েছে মৌলবাদের শকুনরা রবীন্দ্র সঙ্গীতকে প্রচার করতে।

রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কে বলেছেন, আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদে আমার লোভের অন্ত ছিল না। ১৩১২ সালে বিজ্ঞান সভায় কবি বলেছেন, ‘যতদিন পর্যন্ত না বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই বাহির হইতে থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটির মধ্যে বিজ্ঞানের শেকড় প্রবেশ করিতে পারিবে না।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রতি কবির দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে। ১৯২৬ সালে ১০/১১/১২/১৩ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গ ভ্রমনে আসেন। সেই সুবাদে পূর্ববঙ্গবাসী তথা নারায়ণগঞ্জবাসীও কবিকে সমাদর ও অভ্যর্থনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

কবি বলেছেন, ‘যে দেশ তাহার কবিকে ভালবাসেনা, তাহার মত দূর্ভাগা কে? দেশের ভক্তি শ্রদ্ধা না পাইলে কবি বঞ্চিত হন না। দেশই ভগবানের শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ হইতে বঞ্চিত হয়।’

 

লেখক-
শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব।
ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ।