শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বালু ও শীতলক্ষ্যার পঁচা পানির দুর্গন্ধ

রূপগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৮ এপ্রিল ২০২১  

বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দুটির পানি যেন আলকাতরা। দেখতে কালো এ পানির পঁচা দুর্গন্ধই এখন নদী পাড়ের লোকজনের ভোগান্তির কারণ। অথচ ২ যুগ আগেও এ শীতলক্ষ্যার পানি পান করতেন তারা। কথিত আছে, এ নদীর পানি পানে বারোমাসি রোগীও ভালো হয়ে যেত। ছিল এ পানির বৈজ্ঞানিক গুণাগুণও। কাপড় তৈরীর  উপাদান সুতা প্রস্তুুতের জন্য এ নদীর পানি ব্যবহারের সুফল গল্পও রয়েছে। নদীটি রাজধানী ঢাকা থেকে অল্প দূরত্বের শহর নারায়ণগঞ্জের উপর দিয়ে গাজীপুর হয়ে ব্রহ্মপূত্রে মিলেছে। আবার রাজধানী ঘেষা ছোট নদী হিসেবে পরিচিত বালু নদীও জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া থেকে গাজীপুরে তুরাগ হয়ে ধলেশ্বরীতে মিলেছে। সূত্র জানায়,  প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী বহুদিন ধরেই  রাজধানীও আশপাশের জেলায় যোগাযোগ ও পরিবেশগত ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ।  পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীটি সারা বছরই নৌ চলাচলের উপযোগী থাকে। কিন্তু এই নদীর পানি এখন এতটাই দূষিত যে, একদিকে জলজ প্রাণের অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে। অন্যদিকে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের ৬ মাস পঁচা পানির দুর্গন্ধে চরম ভোগান্তি নিয়ে বসবাস করছেন। এছাড়াও নদী পথে যাত্রী ও  পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের ভোগান্তিও রয়েছেই।  শুধু তাই নয়,  খোদ পরিবেশ অধিদপ্তর একে মৃত নদী বলছেন। আর শীতলক্ষ্যা ও বালুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন এ নদী দুটির উভয় পাড়ের শিল্প বর্জ্য ও মানুষের সাধারণ বর্জ্য। নদী তীরের বাসিন্দাদের দাবী , শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানার বর্জ্য এই দূষণের কারণ। সেইসাথে বিভিন্ন বাড়ি ঘরের তরল বর্জ্যও আসছে নদীতে। এর  তীর ধরে হাঁটতে থাকলে বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়েবে নদীর তীর ঘেঁষে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা। আর সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত হচ্ছে বিভিন্ন তরল বর্জ্য। মুশুরী গ্রামের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম বাবু বলেন , এক সময় সবাই  এই নদীতে গোসল করতাম। এখন এমন দূষিত পানির কারণে শরীরে কোনও রোগ বালাই হতে পারে তাছাড়া পানি হাতে স্পর্শ করতেও ঘৃণা হয়। আর নদী পাড়ে খুব কষ্ট করে বসবাস করছি। অথচ এ নদী দুটির  পানির স্বচ্ছতা এবং শীতলতার জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল।পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের সহকারী পরিচালক, মোহাম্মদ মুজাহেদুল ইসলাম বলেন, এই নদী দুটির পানিতে সহনীয় মাত্রার অক্সিজেন নেই। ফলে জলজ প্রাণির জন্য এখন আর উপযোগী নেই। ফলে নদীতে মাছও আগের মতো নেই। এমনকি গৃহস্থালির কাজেও শীতলক্ষ্যার পানি ব্যবহারের উপযোগি নয়। তিনি আরো বলেন,“নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৪ মিলিগ্রামের কম রয়েছে। এমনটা হলে কোনও মৎস্য সম্পদ কিংবা জলজ সম্পদই বেঁচে থাকার অক্সিজেন পায় না”। এই নদীতে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ  করেন পিতলগঞ্জের দীনা মাঝির ছেলে অতীশ চন্দ্র।  তিনি বলেন, আগে তৃষ্ণা পেলে এ নদী থেকেই পানি  পান করতাম। এখন জীবিকার তাগিদে নৌকা চালাই কিন্তু রোগ বালাই আর সারে না। ডাক্তার বলছে এ পাানির কারণেই নাকি অসুস্থ থাকি বেশি। কাঞ্চনের কেন্দুয়া জেলে পাড়ার জেলে হরবিলাস দাস বলেন, আমাদের বাপ দাদার পেশা জেলে। আমিও এ নদী থেকে মাছ ধরে সংসার চালাই। কিন্তু এখন সারাদিনে ৩শ টাকার মাছ ধরতেও কষ্ট হয়। তাছাড়া মাছে আগের মতো স্বাদ নেই। তিনি আরো বলেন, প্রায়ই দেখি পঁচা পানির কারণে মাছ মইরা ভাইসা ওঠে। তবে আশায় থাকি বর্ষাকালের। সে সময় কিছুটা মাছ পাওয়া যায়।  পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শুধূমাত্র শীতলক্ষ্যার তীর ঘিরে রয়েছে দুই হাজার দুইশর বেশি শিল্প কারখানা। আবার বালু নদীতে রামপুরা খাল দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করে রাজধানীর নানাবর্জ্য।  বিধি অনুযায়ী  এসব প্রতিষ্ঠান বা সিটি কর্পোরেশন কিংবা পৌর অঞ্চল্যে তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি চালুর নিয়ম থাকলেও সবখানে তা নেই।  “যেসব প্রতিষ্ঠান ইটিপি স্থাপন করেছে তাদের মধ্যে সবগুলো প্রতিষ্ঠান তা ব্যবহার করছে কি-না পরিবেশ অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তার পক্ষে তা মনিটর করা সম্ভব নয়। শীতলক্ষ্যার দূষণ কেবল নদী তীরের বাসিন্দা ও খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের প্রভাব ফেলছে তা নয়। নির্মল মনোরম পরিবেশের আশায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন নদীর পাড় থেকে। পরিবেশ কর্মকর্তাদের দাবী,  যেসব কারখানা ইটিপি স্থাপন করেনি এবং যারা ব্যবহার করছে না, তাদের বিরুদ্ধে শুধু জরিমানা আদায় করে দূষণ বন্ধ করা যাবে না। এজন্য কারখানা বন্ধ করে দেয়া কিংবা গ্রেপ্তারের মত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলেও তিনি মনে করেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নদী পাড়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলছে। নদী পারে দাড়ানো যাচ্ছে না পঁচা পানির দুর্গন্ধে।  এ নদী  যেন কিছু অসাধু লোকজনের নর্দমাস্থল। পানিতে নর্দমার আর তাতে পূর্বের রুপে রাজধানীর ময়লা আবর্জনা ফেলার অন্যতম  ভাগারে রূপ নেয়া বালু নদ ফিরতে শুরু করেছে আগের রূপে। এতে রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দুই পাড়েই পঁচা পানির দূর্গন্ধে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে এখানকার জনজীবন। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ২২ কিলোমিটার জুড়ে বালু নদীতে রাজধানী ঢাকার পয়োবর্জ্য ও শিল্পকারখানার বর্জ্য পড়ে এ নদীর পানি আবারো আলকাতরার মতো কালো রূপ নিতে শুরু করেছে। প্রতিবছর পানি  কমলে এ রূপধারণ করে  এ ছোট নদীটি। সূত্র জানায়, বালু, নড়াই ও দেবধোলাই নদীর তীরবর্তী লাখো মানুষের এখন বাধ্য হয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই রূপগঞ্জের কোলঘেঁষে প্রবাহমান এ নদীদুটি এখন দূষণ-দখলে মৃতপ্রায়। ইছাপুরা এলাকার বাসিন্দা জাহিদ হাসান বলেন, বর্ষা এলে নদী থেকে কোন দুর্গন্ধ পাওয়া যায় না। তবে পানি সরে যাওয়ার পর শুরু হয় ভোগান্তি। বেড়ে যায়  মশার উপদ্রব। তাছাড়া পঁচা পানি থাকায়  নদী পাড়ের জমিতে কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। বাসিন্দাদের মাঝে বেড়েছে রোগবালাই। এর প্রতিকার চেয়ে তিনি আরো জানান, রাজধানী ঢাকার খিঁলগাও, ডেমরা, বেড়াইদ, গুলশান ও রূপগঞ্জের ৫০ গ্রামে লাখ মানুষের কাছে বালু নদীর পঁচা এখন অভিশাপ।  এদিকে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী দাবী করে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পণা কর্মকর্তা ডাক্তার নুর জাহান আরা খাতুন বলেন, যেখানে পঁচা দূর্গন্ধে বসবাস দায় সেখানে এ পানির ব্যবহার কিভাবে নিরাপদ হয়! তাছাড়া এ পানি ব্যবহার করে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে এ নদী পাড়ের রোগীরা। তাদের মধ্যে চর্মরোগ, ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ নানা পানিবাহিত জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। তাদের অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাই এ নদী দুটির পানি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনের আহবান জানাচ্ছি। 

এই বিভাগের আরো খবর