শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিদ্যুতের দাম আবার কবে বাড়বে  

করীম রেজা

প্রকাশিত: ৪ মার্চ ২০২৩  

 

খুচরা পর্যায়ে আবার বিদ্যুতের দাম নতুন করে বাড়ানো হল। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম প্রজ্ঞাপন জারি করে বাড়ানো হল। মার্চ ২০২৩ এর শুরু থেকেই এই নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। প্রিপেইড মিটার গ্রাহকদের আবার রিচার্জ করতে দুই শতাধিক ডিজিটের বোতাম চাপতে হবে। সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দাম বাড়ার এই তালিকা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড। কথা সত্য, রেকর্ড তো বটেই, কেননা বিদ্যুতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে, বাড়ছে নিত্যপণ্যসহ সব ধরণের জিনিস ও সেবার মূল্য। প্রান্তিক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির সেই বোঝা টানতে হবে দেশের সাধারণ মানুষকেই।

 

বলা হচ্ছে এভাবে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন। সব মিলিয়ে চলতি বছরের দুই মাসে সরকার ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ালো। এই বারে ৫ ভাগ দাম বাড়লো এবং অবশ্যই নির্বাহী আদেশে। গত মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়। নতুন দাম মার্চ মাস থেকে কার্যকর হবে। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগ পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই দাম ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়। তার আগে আরেকবার ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

 

বলা হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করে দাম কমানো বা বাড়ানো হবে। কিন্ত বঙ্গ লক্ষ্মীর কপালে এ পর্যন্ত কেবল বাড়ানোর টিকাই জুটেছে। কমাবার ফলিত যোগ এই কয়েক মাসে সুরঙ্গ কিংবা গলির শেষ মাথায় আলোর রশ্মি বা কুপি-মোমবাতির শিখার মতও নজরে আসে নাই। মরার উপর খাঁড়ার ঘা দেয়ার মত জায়গাও ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে।

 

পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, আবাসিক গ্রাহক ছাড়াও বেড়েছে সব ধরনের বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে কৃষি, ধর্মীয়, দাতব্য, হাসপাতাল, রাস্তার বাতি, পানির পাম্প, ক্ষুদ্র শিল্প, মাঝারি শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুসারে কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাম্পের গ্রাহকদের আগে ইউনিট প্রতি ৪ টাকা ৪৯ পয়সা দিতে হত। এখন থেকে ইউনিট প্রতি ৪.৮২ টাকা হারে বিল দিতে হবে। ক্ষুদ্র শিল্পে এই হার ৯.৪১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯.৮৮ টাকা। শিক্ষা, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালে ৬.৬৪ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬.৯৭ টাকা।

 

অন্যদিকে রাস্তার বাতি ও পানির পাম্প ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য ৮.৪৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮.৯১ টাকা। নির্মাণ শিল্পে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুৎ বিল ১৩.২৩ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৮৯ টাকা। ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের দাম ৮.৮২ টাকা থেকে বাড়িয়ে (ফ্ল্যাট) ৮.৮৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পিক আওয়ারে এই বিল দিতে হবে ১১.০৬ টাকা হারে। সুপার অফ পিকে যারা ব্যবহার করবে তাদের জন্য এই রেট ৭.০৮ টাকা। বাণিজ্যিক অফিসে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য ১১.৩৬ (ফ্ল্যাট) টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১.৯৩ টাকা।

 

উপরে উল্লিখিত তালিকার কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রাত্যহিক জীবনের সব উপকরণে এই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া এই দেশে সাধারণত কোনও জিনিসের দাম বাড়লে তা আর কোনওভাবেই আগের অবস্থায় ফিরে যায় না। আসন্ন রমজান উপলক্ষে জিনিস পত্রের দাম ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের ব্যক্তিবর্গ যদিও বলছেন রোজায় কোনও জিনিসের দাম বাড়বে না বা বাড়ার সম্ভাবনা নেই। কথা ঠিক, যা বাড়ার তা তো আগেই বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের ফায়দা যা হবার তা নিশ্চিত হয়ে গেছে।

 

তাছাড়া কিছুদিন আগেও বিজ্ঞজনসহ প্রায় সবার মুখেই একটি কথা খুব চালু হয়েছিল যে, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। তাই কোনও জিনিসের দাম বাড়লে জনগন খুব একটা অসুবিধায় পড়বে না। এই অকাট্য(?) যুক্তিতে সমানে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তেল নিয়ে তেলেসমাতি দেখা গেছে অতীতে। চিনির স্বাদ এখনও তিতা মিঠার দোলায় দুলছে। তারই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিও সেই বিবেচনায় দেখা যেতে পারে।

 

অন্তত তাতে নীতি প্রস্তাবকদের আত্ম সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়ার ভাল রকম মওকা থাকে। তাছাড়া আমাদের দেশের জনগণের সহনশীলতাও বহুগুন বেড়েছে। তারা আর আগের মত কথায় কথায় আন্দোলনের জুজু ডেকে রাস্তায় নামে না। অপেক্ষা করে, বিশ্বাস করে এই দুর্দিন চিরকালের না, একদিন শেষ হবে। সেই সুদিনের আশায় অসীম ধৈর্যে বর্তমানকে কৃচ্ছতার আবরণে ঢেকে নিয়ে কোনও রকমে টিকে থাকতে চায়, থাকছেও।

 

দাম যারা বাড়াবার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা কি জনগণের এই অসুবিধার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে কিছু খবরবার্তা রাখেন না? এই রকম একটি সহজ প্রশ্ন উচ্চারিত হতেই পারে। উত্তরটিও খুব সহজ। রাখেন তবে তারা সাধারণ জনতার কাতারের কেউ নন। তাছাড়া দাম বাড়ার ফলে যে অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা তা বহন করে সরকার। বেতনের বাইরেও আছে তাদের জন্য নানা নামে নানান রকম ভাতা, উপভাতা, তস্য ভাতা এবং আরও অনেক কিছু দৃশ্য অদৃশ্য।

 

আর তাতেও যদি না কুলোয় তাহলে আছে মহার্ঘ নামের এক মূল্যবান ভাতা। মোদ্দা কথা হল নীতি নির্ধারণ বা রচনাকারীদের জন্য আছে অব্যর্থ সরকারি সুরক্ষা আয়োজন, ব্যবস্থা। কিন্তু সাধারণ মানুষ বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চকুরিজীবিদের জন্য তা নেই। বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানে নামে মাত্র কিছু থাকলেও থাকতে পারে তবে জনগণের জন্য কিছুই নাই। ভ্যাট, ট্যাক্স এবং মূল্যবৃদ্ধির যাবতীয় খড়গের চাপ শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভোক্তা জনগণের কাঁধেই চেপে বসে। বাকিরা তাদের সাথে দুঃখ প্রকাশ করে সান্ত্বনাবাণীতে সবকিছু মুছিয়ে দিতে চায়।

 

আশা করা যায় আগামিতে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়বে, মাঝখানে একবার হয়ত দেখানো রকমের জন্য দাম কমানোও হবে। তবে টাকার অংকে তা সাধারণের ভোগান্তি কমাবে এমন স্বপ্ন হয়ত দেখা যেতে পারে কিন্তু অবাস্তব বলেও বিশ্বাস রাখতে হবে নিরাপদ থাকার জন্য। শুধু বাইরের চাপ বা আর্থিক সহায়তা দানকারীদের পরামর্শে দেশকালের বাস্তবতা বর্জিত নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সরকারের জন্য, উন্নয়নের গতিপথে দীর্ঘমেয়াদে কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা গভীর বিচার বিশ্লেষণ ও বিবেচনার দাবী রাখে।

এস.এ/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর