বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বিনামূল্যের ইপিআই টিকা দিতে টাকা নেয় ‘সূর্যের হাসি’ ক্লিনিক

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২৬ আগস্ট ২০২১  

বিনামূল্যের ইপিআই টিকা দিতে টাকা নিচ্ছে আমেরিকান দাতা সংস্থা ইউএসএইড পরিচালিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সূর্যের হাসি ক্লিনিক। পরিবার পরিকল্পনার জন্য বিনামূল্যে বিতরণের গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট ও কনডমও বিক্রি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন যাবৎ এই কার্যক্রম চলে আসলেও রা নেই জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের।

 

উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন। এদিকে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মকর্তাদের দাবি, টিকা দিতে টাকা নেন না, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ‘সার্ভিস চার্জ’ হিসেবে সামান্য টাকা নেন। সূর্যের হাসির কয়েকটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক ও কেন্দ্রে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই ‘সার্ভিস চার্জ’র পরিমাণ ৮০-৪০০ টাকা পর্যন্তও হয়। যদিও সম্প্রসারণ টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় নারী ও শিশুদের বিনমূল্যে টিকা প্রদানের জন্য সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাংলাবাজার আনছার ক্লাবে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের কার্যক্রম চলে সপ্তাহে দুইদিন। এই ক্লিনিকের সেবাগ্রহীতাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ। এখানে গর্ভবতী মায়ের চেকআপ, প্রসব পরবর্তী সেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, সাধারণ রোগের সেবা, ছোট বাচ্চাদের সর্দি, কাশি, গ্রোথ মনিটরিং সেবা প্রদান করা হয় বলে জানান স্বাস্থ্যকর্মীরা।

 

তবে এখানে ৮০ শতাংশ মানুষ আসেন টিকা নিতে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য কিছু টাকা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও বিনামূল্যের ইপিআই টিকা প্রদান করেও টাকা নেয় সূর্যের হাসি ক্লিনিক। লুকোচুরি নয় এই টাকা তারা রসিদ কেটেই নেন। বুধবার (২৫ আগস্ট) এই কেন্দ্রে শিশু সন্তানের টিকা দিতে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা হাসিনা বেগম। ইপিআই টিকা দিতে প্রতিবারই তাদের কাছ থেকে ৮০ থেকে ১৩০ টাকা করে রাখা হয়। প্রথম রেজিস্ট্রেশনের সময় তার নিজের সন্তান ও এক আত্মীয়ের সন্তানের জন্য সাড়ে ৪শ’ টাকা দিতে হয়েছিল। অথচ এই টিকা বিনামূল্যেই পাওয়া যায় বলে জানেন হাসিনা বেগম।

 

তিনি বলেন, ‘কেবল বাচ্চাদের টিকা দিতেই ৮০-১৩০ টাকা দিতে হয়। বড়দের টিকা দিতে আরও টাকা লাগে। সরকারি বিনামূল্যের টিকা টাকা দিয়ে নিতে হয়। সবাই জানে এইটা ফ্রি কিন্তু টাকা দেওয়ার নিয়ম হয়ে গেছে। তাই কেউ কিছু বলেও না।’ একই কথা বললেন হাফসা আক্তার নামে আরেক নারী। তার দেড় বছরের শিশুকে প্রতিবারই এই কেন্দ্র থেকে টাকার বিনিময়ে টিকা দিয়েছেন তিনি। স্থানীয় আরও কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশ কয়েক বছর যাবৎ আনছার ক্লাবে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের কার্যক্রম চলছে। শুরুতে সর্বোচ্চ ২০ টাকা নিতেন তারা। সেই টাকার পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ।

 

একইভাবে টাকা নেওয়া হয় সদর উপজেলার কাশীপুরের ভোলাইল, ফতুল্লার শাসনগাঁও, এনায়েতনগরের ধর্মগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সূর্যের হাসি স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলোতেও। টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেননি সূর্যের হাসি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মকর্তারাও। মুক্তি আক্তার নামে এক স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, টিকার জন্য প্রথম রেজিস্ট্রেশনের সময় ১৩০ টাকা করে নেওয়া হয়। পরে প্রতিবার ৮০ টাকা করে দিতে হয়। টিকা তো বিনামূল্যে দেওয়ার কথা, প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের পর নিজের পূর্বের দেওয়া উত্তর পাল্টে ফেলেন এই স্বাস্থ্যকর্মী। তিনি বলেন, টিকা দেওয়ার জন্য তারা টাকা নেন না। নারী ও শিশুকে স্বাস্থ্যসেবামূলক বিভিন্ন পরামর্শ তারা দেন। এজন্য একজন প্যারামেডিক নিযুক্ত থাকেন। সেই হিসেবে সার্ভিস চার্জ নেন তারা। এদিকে টিকাগ্রহীতা শিশুদের অভিভাবকরা বলছেন, শিশুর ওজন পরিমাপ এবং টিকা দেওয়া ছাড়া আর কোনো সেবা তারা পান না। টিকা দেওয়ার পর তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় জ্বরের সিরাপ। তবে সেজন্যও ২০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। তবে স্বাস্থ্যসেবামূলক পরামর্শ দেওয়ার জন্য যেই প্যারামেডিক থাকার কথা তাকে প্রায় সময়ই কেন্দ্রে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে গত একমাসের পর্যবেক্ষণে এমন অভিযোগর সত্যতাও মিলেছে। বুধবার বাংলাবাজার আনছার ক্লাব কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা প্যারামেডিক মিতা আক্তারকে পাওয়া যায়নি।

 

এদিকে সরকারিভাবে বিনামূল্যে দেওয়া জন্মনিরোধক ট্যাবলেট ও কনডমও বিক্রি হয় সূর্যের হাসি ক্লিনিক থেকে। প্রতি কনডমের প্যাকেট ৬ টাকা এবং এক প্যাকেট জন্মনিরোধক ট্যাবলেট ৫ টাকায় বিক্রি হয়। এই ট্যাবলেট ও কনডম ক্লিনিকের বাইরেও বিভিন্ন নারীর মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিক্রি করা হয়। তখন এর মূল্য দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা।

 


সদর উপজেলা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলোর তদারকির দায়িত্বে আছেন শফিকুল ইসলাম। সূর্যের হাসি ক্লিনিকের নগরীর ভূঁইয়াপাড়া ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তিনি। শুরুতে এই বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি শফিকুল ইসলাম। পরে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সদর ও সিটি এলাকায় বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক তাদের রয়েছে। সবগুলোতেই স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য টাকা নেন তারা। তবে টিকার জন্য কোনো টাকা নেওয়া হয় না। এ বিষয়ে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অনিক বিশ্বাসের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।

 

তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ মোস্তফা আলী বলেন, টিকার জন্য টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ইপিআই টিকা দেওয়ার কথা। তবে প্রায় সময়ই টাকা নেওয়ার অভিযোগ আসে। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সার্ভিস চার্জের কথা বলে। এই বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, সবগুলো কেন্দ্রে খোঁজ নেওয়া হবে। টাকা নেওয়ার প্রক্রিয়া যেন বন্ধ হয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
 

এই বিভাগের আরো খবর