মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বিভাজন রেখা মুছে দিতে চান আইভী

প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২০  

যুগের চিন্তা রিপোর্ট : বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে  কোন কমতি ছিল না। বরং দিনভর এবং রাতে ছিল বর্ণিল আতশবাজি পোড়ানোর কর্মসূচী। 


নারায়ণগঞ্জ জেলা  ও মহানগর আওয়ামীলীগ  নেতৃবৃন্দ বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মধ্যে দিয়ে স্মরণ করেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানকে। অঙ্গসংগঠন গুলোও কর্মসূচী পালন করেছে। 

কথায় আছে প্রদীপের নীচেই অন্ধকার ! সেই অন্ধকার লক্ষ্য করা গেছে জেলা আওয়ামীলীগের মধ্যে। সবনেতা মাঠে নামলেও কেহ দেখা পাননি এমপি শামীম ওসমানের। তবে এমপি সেলিম ওসমান রাজাকারপুত্র হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তিতে সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। বক্তব্য দিয়েছেন। 


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কাজল একজন চিহ্নিত রাজাকারের ছেলে। সে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানে থাকে কি করে। আমরা বয়সের ভারে ন্যুজ তাই প্রতিবাদ করতে পারিনা। 


তাই বলে এমপি সেলিম ওসমান যা খুশি তাই করে বসবেন। কাজলের প্রতি আমাদের কোন ঘৃনা বিদ্বেষ নেই। যত ঘৃনা তার পিতার প্রতি। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানে কেনো রাজাকারের পুত্র থাকবে। এতে করে কার লাভ। কে তাকে পছন্দ করে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারাতো পছন্দ করিনা। 


এদিকে, একটি মহতি দিনেও বিভেদের রেখা ফুটে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগে। দেওভোগ ব্লকই বেশি সক্রিয় ছিল দিবসটি উদযাপনে। চাষাড়া ব্লক খুব জোরালো ভাবে মাঠে নামেনি। 


দেওভোগের কয়েকজন প্রবীন আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, নাসিক মেয়র দিবসটি উপলক্ষ্যে শহরবাসীকে একটি নতুন চত্ত্বর উপহার দিল। ডায়মন্ড চত্ত্বরে উদ্বোধন করে ‘বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর’। এই চত্ত্বরটি পেয়ে শহরবাসী বেজায় খুশি। 


দলমত নির্বিশেষে লোকজন বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারছে। গতকাল নাসিক মেয়র ডাঃ আইভী চত্ত্বরটি উদ্বোধনকালে দলের বিভাজন দূর করে ঐক্য ফিরিয়ে আনার কথাই বলেছেন। ডাঃ আইভী এখানেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। একটু ব্যাতিক্রম চিত্র দেখাগেল জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারীর বেলায়। তাঁরা জেলা আওয়ামীলীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করলেও নতুন ‘বঙ্গবন্ধু’ চত্ত্বরে যাননি। 


বিষয়টি নিয়ে অনেক সিনিয়র নেতা ভাল মানসিকতা দেখাতে পারেনি। ওসমান পরিবার ঘনিষ্ঠরা  জেলাসি ফিল করছেন। তাদের অনেকে বলেছেন, পুরো নগরী মেয়রের। সে যা খুশি তা করতে পারেন।  

দেওভোগের লোকেরা সেখানে বসে আড্ডা দিবে। আমাদের কি। আমাদেরতো কেউ যেতেও বলেনি। তাছাড়া আমরা সেদিকে খুব একটা যেতেও আগ্রহী না। বঙ্গবন্ধুর নামে চত্ত্বর করাটা নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ। 


শহরের পাইকপাড়া এলাকার কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, নাসিক মেয়র ডাঃ আইভী শহরবাসীকে নতুন বিষয় উপহার দিয়েছেন। শহরের বুকে বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর চালু করলেন। যা আগে ভাবাই যেতনা। মুখে বঙ্গবন্ধু বলে নিজের স্বার্থোদ্ধারের বিষয়টি যোলআনা বুঝে নেন-এমন নেতার সংখ্যাই শহরে বেশি। 


এদের কেহ কেহ নিজেকে কখনো বাঘ, কখনো সিংহ পুরুষ বলে দাবি করেন। মঞ্চে উঠে গলা ফাটিয়ে বক্তব্য দেন। স্বাধীনতার ৪০ বছরেও এ সকল সিংহ পুরুষরা বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ ম্যুরাল শহরে স্থাপন করতে পারেননি। অথচ আমাদের মেয়র শেখ রাসেলের নামে বিশাল লেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন। এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে শহরবাসীকে উপহার দিলেন ‘বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর’। 


অথচ তথাকথিত সিংহপুরুষরা বঙ্গবন্ধুর ইস্যুতেও এক হতে পারলেন না। সিংহপুরুষরা ভিরু কাপুরুষের পরিচয় দিলেন নেতাকর্মীদের কাছে। অথচ সিটি মেয়র শেখ রাসেল পার্ক প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও সিংহ পুরুষদের বাধার মুখে পড়েছিলেন। হার মানেননি। বরং সিংহপুরুষরা লেজ গুঁটিয়ে পালিয়ে ছিল। এ কারণেই মঙ্গলবার তাঁরা বিভেদের রেখা স্পষ্ট করেছেন। 


পৌরপিতা চুনকার সুযোগ্য কন্যা ডাঃ আইভী মঙ্গলবার পাইকপাড়ায় ঐতিহ্যবাহী মিউচুয়েল ক্লাব এর নতুন ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনকালে বিভেদ ভুলে ঐক্যের কথা বলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কলহ-বিবাদ চাই না, আমরা ঐক্য চাই। উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঐক্য চাই। আমি রাজনীতিতে পদপদবীর লোভী নই। পদ-পদবীর আমার কোনো দরকারও নাই। 


আমি চাই, আমার জনগণ আমার পাশে থাকুক। তবে এটা সত্য, আমি যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে পথে নামতে প্রস্তুত আছি। আর সেই হত্যাকাণ্ডে যেই থাকুক না কেন, সেটা যদি আমার নিজের সন্তানও হয়! আমি তার বিরুদ্ধাচারণ করতে একটুও ছাড় দিব না।

কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে, সামাজিকতার ক্ষেত্রে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে, শেখ হাসিনার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপনারা যে কোনো ধরণের কথা বলবেন, আমি সে কথা শুনতে প্রস্তুত আছি। আমরা চাই নারায়ণগঞ্জে শান্তি।


আমাদের এই নারায়ণগঞ্জকে বিগত সময় বিভিন্নভাবে সন্ত্রাসী করে কলঙ্কিত করা হয়েছে। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যে কিন্তু আমরা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। শৃঙ্খলা বজায় রেখে বিভিন্ন ধরণের অপকৌশল, অপরাজনীতির বিরুদ্ধে আমরা আমাদের নারায়ণগঞ্জকে প্রতিষ্ঠিত করবো।’ 


মিউচুয়েল ক্লাব প্রসঙ্গে মেয়র আইভী বলেন, আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিলো; এই মিউচুয়েল ক্লাব নিয়ে। 

আমরা যখন থেকে জেনেছি, বোঝার বয়স যখন থেকে হয়েছে, তখন আমি বাবার কাছ থেকে জেনেছি, নাজমা রহমান, আনসার আলী, মফিজ কাকা থেকে এমনকি এখনও যারা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আছেন তারা আওয়ামী লীগ অফিসে বক্তব্যে বলতেন  যে, এই নারায়ণগঞ্জ থেকেই আওয়ামী লীগের জন্ম এই মিউচুয়েল ক্লাব থেকে । 


তখন থেকেই আমার ভেতরে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা ছিলো যে আমি এ মিউচুয়েল ক্লাবের জায়গাটি, এর ইতিহাস ঐতিহ্য কিভাবে সংগ্রহ করবো! আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আরো বেশি উৎসাহ যুগিয়েছে বছর দুই-এক আগে যখন আমাদের সিটি করপোরেশনে দু‘জন বিদেশী মুক্তিযোদ্ধা এসেছিলেন। 


তার সাথে এসেছিলেন রোজ গার্ডেনের মালিক এবং রোজ গার্ডেনের মালিক আমাকে বললেন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোজ গার্ডেনের যে ভবনটি ছিলো তা পুরোটাই তিনি কিনে নিয়েছেন। সেখানে জাতির পিতার স্মৃতি সংগ্রহ করার জন্য। 


প্রথম সভাটি মিউচুয়েল ক্লাবে হয়েছিলো পরবর্তীতে তিনদিন পর ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে  যে সভাটি হয়েছিলো যেখানে আওয়ামীলীগের কমিটির আত্মপ্রকাশ করেছিলো। আমি ওনার কাছ থেকে এ তথ্যগুলো জানার পর থেকেই আমার মনে হল যে সে জায়গাটি যদি প্রধানমন্ত্রী কিনে সংরক্ষণ করে নিতে পারেন তাহলে আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী কেন এ মিউচুয়েল ক্লাবটি সংরক্ষণ করতে পারবো না। 


নারায়ণগঞ্জে আওয়ামীলীগের যত স্মৃতিবিজরিত স্থান রয়েছে তা সংরক্ষণের উপর জোর দিয়ে মেয়র বলেন, এর জন্য আমি আপনাদের সকলের সহযোগিতা চাই। 

শহরের ২নং রেলগেট এলাকার নবনির্মিত বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর প্রসঙ্গে মেয়র আইভী বলেন, ‘আমরা ২নং রেলগেটে রহমতউল্লাহ্ ইন্সস্টিটিউটের সামনে বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরাল উদ্বোধন করেছি। সে জায়গায়ও বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন।  


সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসি ও পুলিশ প্রশাসনের অস্ত্র লুট করে এসে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সংগ্রহ করে নারায়ণগঞ্জ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আমরা সর্বজনের জন্য জায়গাটি উন্মোচন করে দিয়েছি। কারণ বঙ্গবন্ধু সকলের।’ 


২০১১ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান জাতীয় স্লোগান করার দাবির কথা জানিয়ে মেয়র আইভী বরেন,  ‘ওইবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব গ্রহণকালে বলেছিলাম যে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের একক নয়। 


‘জয়বাংলা’ স্লোগান আওয়ামীলীগ কুক্ষিগত করেছে। জয়বাংলা স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, জয় বাংলা কৃষক-শ্রমিক, দিনমজুরের স্লোগান, জাতীয় স্লোগান। ওই কথাটির ভিডিও ক্লিপটি অনেকে কাটছাঁট করে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব জায়গায় দেখিয়েছিলো। বলেছিলো আমি নাকি এ আওয়ামীলীগের বদনাম করেছি। বলেছি জয় বাংলা স্লোগান আওয়ামীলীগ কুক্ষিগত করেছে। 


আজকে কিন্তু হাইকোর্ট জয়বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ২০১১’তে আমি আমার মেধা, বুদ্ধি, দর্শন দিয়ে কথাটি বলেছিলাম। আমি জানি না কোনো ভুল করেছিলাম কিনা! এটা আপনারা এখানে যারা বড়রা আছেন, তারা বলতে পারবেন। কিন্তু সাত বছর পর হাইকোর্ট জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে রায় দিয়ে তা প্রমাণ করে দিল।’


পর্যবেক্ষক মহলের মতে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বাঙ্গালীর গর্ব, মহান স্বাধীনতার ঘোষক জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সারা বাংলাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগ সহ এর সহযোগী সংগঠনের আয়োজন নজর কেড়েছে বিশিষ্টজনদের। 

তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীতেও এক হতে পারেনি নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগ। দিনটি উদযাপন করার   ক্ষেত্রে তুমুল বিভাজন দেখা গেছে জেলার নেতৃবৃন্দদের মধ্যে। 


জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দদের বিভাজন হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করার বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এতবড় একটি উৎসবের সময় নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ বিভেদ ভুলে এক কাতারে আসতে পারেনি।


নিজেদের মধ্যকার বিভাজন রেখা মুছে দিয়ে কবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের বিজ্ঞ নেতৃবৃন্দ- এ প্রশ্নের উত্তর নেই। 
 

এই বিভাগের আরো খবর