শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বেপরোয়া বাল্কহেড-কার্গোতে মৃত্যুপুরী শীতলক্ষ্যা!

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ৬ এপ্রিল ২০২১  

নারায়ণগঞ্জের বুক চিরে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন এই নৌপথে দিন রাত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাল্কহেড ও কার্গো জাহাজ। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া গতিতে দাপিয়ে বেড়ানো এই বাল্কহেড ও কার্গো জাহাজের কারণে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে শীতলক্ষ্যা নদী। প্রতিনিয়তই ঘটছে দূর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যু মিছিল। তবে, তা প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তাদের। সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল মৃত্যুপুরি শীতলক্ষ্যায় রচিত হলো আরো একটি দুঃসহ অধ্যায়। নারায়ণগঞ্জের চরসৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে নির্মাণাধীন সেতুর সামনে দ্রুতগতির কার্গো জাহাজের ধাক্কায় মুন্সীগঞ্জগামী একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবির ঘটনায় ২৮ জনের মরদেহ উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে। গতকাল এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আরো কয়েক জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছে নৌপুলিশ। 

 

এদিকে, স্বজনহারাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে লক্ষ্যাপাড়ের আকাশ-বাতাস।এদিকে, একেরপর এক দূর্ঘটনায় বেপরোয়া বাল্কহেড ও কার্গো জাহাজ এখন শীতলক্ষ্যার জমদুতে পরিণত হয়েছে। তবে, এযাবৎ শীতলক্ষ্যায় এমন দূর্ঘটনা ও হতাহতের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট নৌপুলিশ কর্মকর্তার কাছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপুলিশের ইনচার্জ মো. শহীদুল আলম দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমি যোগদানের পর এখানে দুটি দূর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বিগত সময়ে কতগুলো দূর্ঘটনা ঘটেছে, বা এসকল দূর্ঘটনায় কতজনের প্রাণহানি ঘটেছে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই।’তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, এযাবৎ শীতলক্ষ্যায় নৌকা, ট্রলার ও বাল্কহেড ডুবির দূর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক!

 

 

এর মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রোববার বিকেল সাড়ে ৩টায় বন্দর ১নং খেয়াঘাট থেকে শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দেওয়ার সময় বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে হতাহত বা নিখোঁজের ঘটনা না ঘটলেও শিশুসহ ৫ যাত্রী আহত হয়। এ ঘটনায় স্থানীয়রা বাল্কহেডটি আটক করে। ২০২০ সালের ১৭ই মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীতে বালুবাহি বাল্কহেডের ধাক্কায় একটি সিমেন্টবাহি ট্রলার ডুবে মাসুদ (৩৫) নামে এক শ্রমিক নিহত হয়। সে মুন্সিগঞ্জ জেলার টাঙ্গীবাড়ি থানার দীঘিরপাড় এলাকার বাসিন্দা। পুলিশ জানায়, ১৭ মার্চ সকালে এমভি নানা-নাতি নামের একটি বালুবাহি বাল্কহেড পাঁচ হাজার ব্যাগ সিমেন্ট বোঝাই ওই ট্রলারটির উপরে দিলে মুহুর্তেই ট্রলারটি তলিয়ে যায়। 

 

২০২০ সালের ৭ জুলাই বিকেল ৩টায় শীতলক্ষ্যার ৫নম্বর ঘাট এলাকায় একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় আল কুদ্দুস নামক একটি বাল্কহেড ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে বাদল মাস্টার (৫৫) নামে বাল্কহেডের চালক নিহত হয়। ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর পাঁচ নম্বর ঘাটের সামনে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সিমেন্টবাহী ট্রলার ডুবির ঘটনায় জুয়েল (২৪) নামক এক শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় ট্রলারে থাকা অন্যদুই শ্রমিক ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলেও তারা আহত হয়। ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাটে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় একটি যাত্রীবাহী ট্রলার ডুবে যায়। এতে সুমাইয়া (৮) ও ফাহিম (৪) নামে দুই শিশু মৃত্যুর খবর শোনা যায়। ওই দূর্ঘটনায় ট্রলারের ১০ যাত্রী গুরুত্বর আহত হন। ট্রলারে থাকা অন্যান্য যাত্রীরা সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হয়। নৌপুলিশ সূত্র জানিয়েছিলো ওই ট্রলারে কমপক্ষে ৫০ জন যাত্রী ছিলেন।

 

এদিকে, ২০১৪ সালের ২০ জুলাই শীতলক্ষ্যা নদীতে ট্রলার ডুবির ঘটনায় দুই যুবক-যুবতীর মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে একজন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র রাকিবুল হাসান এবং অপরজন ময়না রানী নামের যুবতী।এর আগে ২০১০ সালের ৪ জুলাই প্রায় শতাধীক আরোহী নিয়ে শীতলক্ষ্যা মাঝ নদীতে পৌছালে একটি কার্গো ট্রলারের ধাক্কায় ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। এতে দীর্ঘক্ষন নিখোঁজ থাকার পর বেশ কয়েকজনের লাশ ভেসে উঠে নদীতে। এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে মৃত্যুপুরিতে রূপ নিয়েছে শীতলক্ষ্যা। লাশের মিছিল দীর্ঘ হলেও দূর্ঘটনা রোধে শীতলক্ষ্যায় বাল্কহেড ও কার্গো চলাচলে এখনো শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও অন্যান্য কর্তব্যক্তিরা। অভিযোগ রয়েছে, শীতলক্ষ্যায় যারা শৃঙ্খলা ফেরাবে, সেই তারাই হয়ে উঠেন উশৃঙ্খল! অর্থাৎ রাতের আঁধারে বাল্কহেড থেকে চাঁদা উত্তোলনের মতো অভিযোগও উঠেছিলো ইতিপুর্বে দায়িত্ব পালন করা কিছু অসাধু নৌপুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। 

 

জানা গেছে, রাতের আঁধারে লাইটার জাহাজ চলাচলের অনুমতি থাকলেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বাল্কহেড চলাচলে। তবে, সেই নিষেধাজ্ঞার বালাই নেই শীতলক্ষ্যায়। রাতের আঁধারে ব্যস্ততম এই নৌরুটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাল্কহেড। এই বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শহিদুল আলম দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘নৌ পথে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আমরা সচেষ্ট। আর রাতের আঁধারে বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ২০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বাল্কহেডের বিরুদ্ধে।’
 

এই বিভাগের আরো খবর